
কাগজে-কলমে মাদ্রাসা আছে কিন্তু বাস্তবে শিক্ষক বা শিক্ষার্থী কোনো কিছুরই অস্তিত্ব নেই। এর মধ্যে অধিকাংশ মাদ্রাসার ঘর নেই। আর যেগুলোর আছে, তা জরাজীর্ণ, ভঙ্গুর অবস্থায় পড়ে আছে। এমন চিত্র দেখা গেছে বরগুনার আমতলী ও তালতলী উপজেলায়।
স্থানীয়রা বলছেন, গত ২০ বছরেও মাদ্রাসার নাম শোনেননি বা ঘর দেখেননি, এখন তারা শুনছেন তা জাতীয়করণ হচ্ছে। এ নিয়ে ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করেছেন তারা।
অভিযোগ রয়েছে, নামসর্বস্ব এসব স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা জাতীয়করণের ঘোষণার পর থেকে আমতলী-তালতলীতে দালাল চক্র মাদ্রাসাপ্রতি ১০ লাখ টাকা আদায় করছে। দালাল চক্রের ফাঁদে পড়ে চাকরি জাতীয়করণের লোভে মাদ্রাসার শিক্ষকরা টাকা দিচ্ছেন। তবে দ্রুত ওই দালাল চক্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন স্থানীরা।
স্থানীয় একাধিক সূত্র জানিয়েছে, আমতলী ও তালতলী উপজেলায় ১১৯টি নামসর্বস্ব স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা রয়েছে। এর মধ্যে আমতলীর ৭৬টি ও তালতলীর ৪৩টি। আমতলী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা অলি আহাদ অস্তিত্বহীন এসব মাদ্রাসার তালিকা বরগুনা জেলা শিক্ষা অফিসে পাঠিয়েছেন। এই তালিকা তৈরিতে মোটা অঙ্কের অর্থের লেনদেন হয়েছে।
আমতলীর ৭৬টি ও তালতলীর ৪৩টি ইবতেদায়ি মাদ্রাসা। এর মধ্যে দুই উপজেলায় অনুদানভুক্ত স্বতন্ত্র মাদ্রাসার সংখ্যা মাত্র ছয়টি। এগুলো হলো পূর্ব চিলা হাসানিয়া, মধ্য পাতাকাটা আমানদিয়া, উত্তর ঘোপখালী, মোহাম্মদপুর মাহমুদিয়া নাচনাপাড়া, কুতুবপুর ইসরাইলিয়া ও তালতলীর চামোপাড়া মজিদিয়া স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা। এই ছয়টি মাদ্রাসা অনুদান পেলেও গত দু-এক বছরে কোনো শিক্ষার্থী মাদ্রাসায় আসেনি। শিক্ষকরা কাগজে-কলমে শিক্ষার্থী দেখিয়ে আসছেন। বাস্তবে কোনো শিক্ষার্থী খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। শিক্ষকরা মাঝেমধ্যে মাদ্রাসায় এলেও উপস্থিতি রেজিস্টারে সই করে তা বোগলদাবা করে চলে যান।
এলাকাবাসী অভিযোগ করে জানান, এসব মাদ্রাসায় কোনো দিন শিক্ষার্থী ও শিক্ষককে আসতে দেখেননি তারা। ঘর সব সময়ই তালাবদ্ধ থাকে। তাও জরাজীর্ণ। এ ছাড়া অনুদানবিহীন ১১৩ মাদ্রাসার মধ্যে অধিকাংশ মাদ্রাসারই অস্তিত্ব নেই। ২০১৮ সালে ওই সব মাদ্রাসার ঘর তুলে শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে রেখেছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসে এসব মাদ্রাসার নামে কাগজে-কলমে শিক্ষার্থী দেখানো হয়েছে। আমতলীর ৭৬টি মাদ্রাসায় ৯ হাজার ৭৫০ জন শিক্ষার্থী এবং তালতলীর ৪৩টি মাদ্রাসায় ৫ হাজার ৯৫০ জন শিক্ষার্থী দেখানো হয়েছে। তবে বাস্তবে দু-একটি মাদ্রাসা ছাড়া কোনো মাদ্রাসায় কোনো শিক্ষার্থীই দেখেন না কেউ।
গত ২৮ জানুয়ারি অন্তর্বর্তী সরকার স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা জাতীয়করণ ঘোষণা দিলে উৎসবে মেতে ওঠে আমতলী-তালতলীর একাধিক দালাল চক্র। তারা মাদ্রাসা জাতীয়করণের নামে মাদ্রাসাপ্রতি ১০ লাখ থেকে ১৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার উৎসবে মেতেছে।
দালালদের বক্তব্য, ‘দ্রুত টাকা দেন, নইলে মাদ্রাসা জাতীয়করণের তালিকায় নাম যাবে না। যারা আগে টাকা দেবে, তাদেরটা আগের তালিকায় জাতীয়করণ হবে। বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে টাকা দিতে হবে। নইলে জাতীয়করণ হবে না।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন শিক্ষক বলেন, প্রত্যেক শিক্ষকের কাছ থেকে তিন লাখ টাকা করে দালালরা মাদ্রাসাপ্রতি ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা চাচ্ছে। ইতোমধ্যে বেশ কিছু শিক্ষক দালালদের টাকা দিয়েছেন।
গত সোমবার আমতলী উপজেলার অনুদানভুক্ত মাদ্রাসা কুতুবপুর ইসরালিয়া, মধ্য পাতাকাটা আমানদিয়া, মোহাম্মদপুর মাহমুদিয়া ও তালতলী উপজেলার একমাত্র চামোপাড়া মজিদিয়া স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা ঘুরে দেখা গেছে, মাদ্রাসার ঘর আছে। কিন্তু জরাজীর্ণ অবস্থা। কত দিন আগে এ মাদ্রাসাগুলো পড়ানো হতো, তা বোঝা মুশকিল।
কুতুবপুর ইসরাইলিয়া স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক গোলাম কিবরিয়া বলেন, এখনো বই পাইনি। তাই ক্লাস করতে পারছি না।
জানতে চাইলে স্থানীয় নুর জামাল, সফিকুল্লাহ ও আবিদ বলেন, মাদ্রাসার ভবন নেই, শিক্ষার্থীও নেই। কিন্তু কীভাবে তালিকায় নাম এল, তা আমরা জানি না। এগুলো দালালরা রমরমা ব্যবসা শুরু করেছে।
তালিকায় ২৯ নম্বর চরখালী স্বতন্ত্র মাদ্রাসায় ভবন আছে। কিন্তু কোনো শিক্ষার্থী নেই। স্থানীয় আব্দুর রব, অলি উল্লাহ, মোহাদ উল্লাহ, রাবেয়া ও নাসিমা বেগম বলেন, পাঁচ বছর আগে খালের পাড়ে মাদ্রাসা ঘর নির্মাণ করেছেন রাজ্জাক মৃধা। কিন্তু কোনো দিন কোনো শিক্ষার্থী আসেনি। এখন শুনছি আবার চালু হবে। আজব ব্যাপার।
সরেজমিনে ৬৫ নম্বর হাট চুনাখালী স্বতন্ত্র মাদ্রাসার কোনো অস্তিত্ব নেই। স্থানীয় মোস্তফা মাদবর বলেন, ইঞ্জিনিয়ার ইলিয়াস মিয়া এ মাদ্রাসা করেছেন। কিন্তু ভবন ও শিক্ষার্থী কিছুই নেই। এখন শুনি জাতীয়করণ হবে।
৭৬ নম্বর পশ্চিম কেওয়াবুনিয়া মুজাহিদিয়া, ১৪ নম্বর উত্তর কাউনিয়া, ৫৩ নম্বর কাউনিয়া স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসার কোনো অস্তিত্ব নেই। স্থানীয়রা বলেন, গত ২০ বছরে দেখিনি এই নামে কোনো মাদ্রাসার অস্তিত্ব আছে। তালতলীর ২৫ নম্বর পূর্ব গাবতলীতে স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসার কোনো অস্তিত্ব নেই। জাতীয়করণ ঘোষণার পর মাদ্রাসার নাম তালিকায় দিয়েছেন।
এসব বিষয়ে আমতলী উপজেলা স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসার শিক্ষক সমিতির সভাপতি মাওলানা আলাউদ্দিনের কাছে জানতে চাইলে তিনি টাকা নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মাদ্রাসার তালিকা চেয়েছে তাই তালিকা দিয়েছি। কিন্তু শিক্ষার্থী নেই, এমন মাদ্রাসার নাম তালিকায় দিলেন কেন? এমন প্রশ্নের জবাব না দিয়ে তিনি ফোনের লাইন কেটে দেন।
জানতে চাইলে তালতলী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা অলি আহাদের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আমতলী উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসের এক কর্মচারী বলেন, অনেক মাদ্রাসার অস্তিত্ব নেই। তারপরও বিভিন্ন চাপে পড়ে তালিকা করতে হচ্ছে।
বরগুনা জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. জসিম উদ্দিন বলেন, মন্ত্রণালয় তালিকা চেয়েছে, তাই তালিকা পাঠানো হয়েছে। নামসর্বস্ব মাদ্রাসার নাম কেন তালিকায় পাঠিয়েছেন, এমন প্রশ্নের কোনো জবাব দিতে পারেননি তিনি। তবে অর্থ লেনদেনের বিনিময়ে তালিকা করা হয়েছে, এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অভিযোগ পেলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আমতলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) ও সহকারী কমিশনার তারেক হাসান বলেন, মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারের সঙ্গে আলোচনা করে এ বিষয়ে অনিয়ম পেলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বরগুনা জেলা প্রশাসক মো. সফিউল আলম বলেন, মন্ত্রণালয় তো কোনো তালিকা চায়নি। খোঁজ নিয়ে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।