Image description
খেলাপি ঋণ এখন ৩ লাখ ৪৬ হাজার কোটি টাকা, ৫৬ হাজার কোটি ছাড়িয়েছে ১০ ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি

বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা মোটেও ভালো চলছে না। পলাতক হাসিনা সরকারের আমলে এই খাত থেকেই লুট করা হয়েছে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার। সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে ব্যাংক খাতের দগদগে ক্ষত। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে খেলাপি ঋণ। আর এই খেলাপি ঋণ মূলধন ঘাটতির চোরাবালির দিকে নিয়ে যাচ্ছে পুরো খাতকে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ বেড়ে তিন লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকায় ঠেকেছে। এটি মোট ঋণের ২০.২০ শতাংশ। নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোকে পরিচালন মুনাফার ০.৫ থেকে ৫ শতাংশ সাধারণ ক্যাটাগরির ঋণের বিপরীতে প্রভিশন হিসেবে রাখতে হয়।

নিম্নমানের খেলাপি ঋণের বিপরীতে ২০ শতাংশ এবং সন্দেহজনক খেলাপি ঋণের বিপরীতে ৫০ শতাংশ রাখতে হয়। এ ছাড়া প্রতিটি ব্যাংকের জন্য মন্দ বা লোকসান ক্যাটাগরির খেলাপি ঋণের বিপরীতে ১০০ শতাংশ প্রভিশনিং আলাদা করে রাখার বিধান রয়েছে। প্রভিশন ঘাটতি ব্যাংকিং খাতের জন্য একটি অশনিসংকেত। কারণ এটি ব্যাংকগুলোর দুর্বল আর্থিক অবস্থার চিত্র তুলে ধরে, যা মূলত উচ্চ খেলাপি ঋণের ফল।

ভালো ও মন্দ ঋণের বিপরীতে পর্যাপ্ত পরিমাণ নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) রাখতে পারছে না সরকারি ও বেসরকারি খাতের ১০টি ব্যাংক। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর শেষে এসব ব্যাংকে মোট প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ ৫৬ হাজার ৩৬ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। গত জুনে ব্যাংক খাতের প্রভিশন ঘাটতি ছিল ৩১ হাজার ৫৪৪ কোটি টাকা। অর্থাত্ মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে প্রভিশন ঘাটতি বেড়েছে ২৪ হাজার ৪৯২ কোটি টাকা।

অর্থনীতিবিদদের মতে, গ্রাহকের আমানতকৃত অর্থের নিরাপত্তা বিধানের জন্য নির্ধারিত হারে প্রভিশন সংরক্ষণের বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই যেসব ব্যাংক প্রভিশন শর্টফলের মধ্যে আছে, তাদের প্রভিশন ঘাটতি পূরণের জন্য নির্দেশনা দেওয়া যেতে পারে। প্রয়োজনে তাদের ব্যবসায়ের পরিধি কমিয়ে দেওয়া যেতে পারে। কোনো কারণেই প্রভিশন ঘাটতি নিয়ে ব্যাংককে ব্যবসা পরিচালনা করতে দেওয়া উচিত নয়।

ঋণের শ্রেণিমান বিবেচনায় প্রতিটি ব্যাংকের নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। ব্যাংকের খারাপ ঋণ যত বাড়ে, প্রভিশন সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা তত বেড়ে যায়। আর প্রভিশন রাখতে না পারলে স্বাভাবিকভাবে মূলধন ঘাটতি বাড়ে। আবার খেলাপি হওয়া ঋণের বিপরীতে কোনো ব্যাংক আয় দেখাতে পারে না, ফলে খেলাপি ঋণ না কমলে মূলধন ঘাটতি থেকে বের হতে পারে না। 

নিয়ম মেনে ১৬টি ব্যাংক মূলধন রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ ৪০ হাজার কোটি টাকার বেশি। তবে ব্যাংকগুলোতে মূলধন ঘাটতি যে পরিমাণ দেখানো হচ্ছে, তার তুলনায় প্রকৃত ঘাটতি অনেক বেশি। কারণ অনেক ব্যাংকই বিশেষ বিবেচনায় বাড়তি সময় বা ডেফারেল সুবিধাও গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সেপ্টেম্বরভিত্তিক (২০২৪) তথ্য মতে, ১৪টি ব্যাংক ৬৯ হাজার ৬২০ কোটি ৯০ লাখ টাকার ডেফারেল সুবিধা পেয়েছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান কালের কণ্ঠকে বলেন, একটা সময় বহু পরিমাণ ডেফারেল সুবিধা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখন আমরা প্রকৃত চিত্র অনুসন্ধান করে ব্যাংকগুলোকে প্রভিশন সংরক্ষণের জন্য ডেফারেল সুবিধা দেব। অথবা যদি কোনো নতুন বিনিয়োগকারী পাওয়া যায় তাহলে আরো ভালো। যাদের নতুন বিনিয়োগের মাধ্যমে ব্যাংকের ক্যাপিটাল বাড়ানো সম্ভব।

এ বিষয়ে বেসরকারি খাতের ইস্টার্ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী রেজা ইফতেখার এক আলোচনাসভায় বলেন, কিছু কিছু ব্যাংক কঠিন পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য খুবই সংগ্রাম করছে। কিন্তু ওই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে তাদের লম্বা সময় প্রয়োজন। ব্যাংকগুলোকে বাঁচানোর জন্য আপৎকালীন সহযোগিতা করা হলেও এটা আসলে পর্যাপ্ত নয়। আর এই প্রক্রিয়াটাও যথাযথভাবে কাজ করছে না।

তাঁর মতে, যেসব ব্যাংকের তারল্য সংকট, প্রভিশন ঘাটতি ও মূলধন ঘাটতি রয়েছে সেসব ব্যাংকের মালিকদের সঙ্গে বসে আলোচনা করে একটা পথ বের করা উচিত। পাশাপাশি দুই থেকে তিন বছরের একটি সময় বেঁধে দেওয়া উচিত। যদি সেই সময়ের মধ্যে তারা সংকট কাটাতে না পারে তাহলে তাদের রিমুভ (অপসারণ) করা হবে।