Image description

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের লক্ষ্য নিয়ে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার পদ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন মো. নাহিদ ইসলাম। এরপর গঠন করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)।

আন্দোলনে তোপের মুখে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর নোবেল বিজয়ী প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম সেই সরকারে প্রায় সাত মাস দায়িত্ব পালনের পর ফেব্রুয়ারিতে পদত্যাগ করেন এবং তার নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের ঘোষণা দেন। এই নবগঠিত রাজনৈতিক দল নিয়ে ভাবনা, চলমান সংস্কারপ্রক্রিয়া, বাংলাদেশে আগামী জাতীয় নির্বাচনসহ নানা বিষয়ে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য ডিপ্লোম্যাটের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। চলুন দেখে নেয়া যাক সাক্ষাতকারে মো. নাহিদ ইসলাম কোন কোন বিষয়গুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন:

প্রথমেই মো. নাহিদ ইসলামে জিজ্ঞেস করা হয় যে তিনি আন্দোলন থেকে গিয়েছেন সরকারে, এরপর ফিরে এসেছেন রাজনীতিতে। তারপর আবার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করেছেন। সব মিলিয়ে তার অভিজ্ঞতা কী?

উত্তরে নাহিদ ইসলাম বলেন, সরকারকে ভেতর-বাইর: উভয় দিক থেকে দেখাটা একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন অভিজ্ঞতা। যখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়, তখন বাংলাদেশের জন্য এটি একটি বিশেষভাবে চ্যালেঞ্জিং সময় ছিল, যা আমার জন্য একটি তীব্র এবং কঠিন অভিজ্ঞতা। সময়ের চাহিদা মেনে আমি পদত্যাগ করি এবং মূলধারার রাজনীতিতে প্রবেশ করি। এখন আমি এই অভিজ্ঞতাটি ব্যবহার করে আমার ভবিষ্যত রাজনৈতিক যাত্রাকে গঠন করতে পারি, বিশেষত যখন সামনের পথটি কঠিন বলে মনে হচ্ছে। একটি রাজনৈতিক দল গঠন করা আমার জন্য একটি নতুন চ্যালেঞ্জ, তবে আমি এটি অতিক্রম করার জন্য প্রস্তুত রয়েছি।

অন্তর্বর্তী সরকারে আপনার সময়কালে আপনি কতটা সংস্কার করতে পেরেছিলেন?

উত্তরে নাহিদ ইসলাম বলেন, আমার স্বল্প সময়ের দায়িত্বকালে আমরা বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নিয়েছিলাম। আমরা ইন্টারনেট অবকাঠামোর স্তরগুলো সংশোধন করি। এছাড়াও আইসিটি বিভাগের জন্য একটি সংস্কার রোডম্যাপ প্রস্তুত করি এবং তথ্যের প্রবাহ উন্নত করতে সেন্সরশিপ আরোপকারী বিভিন্ন আইন নিয়ে কাজ করেছি। যদিও এই সংস্কারগুলির পূর্ণ প্রভাব তাৎক্ষণিকভাবে দৃশ্যমান নাও হতে পারে, তবুও আমি নিশ্চিত যে এগুলি দেশের জন্য দীর্ঘমেয়াদী সুবিধা বয়ে আনবে।

এনসিপির জন্য আপনার পরিকল্পনা কী? এটি কি ডানপন্থী না বামপন্থী দল হবে?

নাহিদ ইসলাম জানান, উভয়ই নয়। এনসিপি একটি মধ্যবর্তী রাজনৈতিক দল, এবং আমরা এই আদর্শ বজায় রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমাদের লক্ষ্য হলো নতুন কণ্ঠস্বর, বিশেষ করে তরুণ এবং সমাজের সকল শ্রেণির মানুষ, যারা বছরের পর বছর ধরে ঐতিহ্যবাহী রাজনীতি থেকে বাদ পড়েছেন, তাদের জন্য জায়গা তৈরি করা।

আমরা একটি গণপরিষদ গঠনের মাধ্যমে একটি ‘দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা করতে চাই, যার মাধ্যমে আমরা একটি নতুন সংবিধান প্রবর্তন এবং দেশের ক্ষমতার গতিশীলতা পুনর্গঠন করতে চাই। আমরা আমাদের ভিশনকে আরও গঠন করতে সক্রিয়ভাবে ধারণা অন্বেষণ এবং মতামত সংগ্রহ করছি।

অনেকে বলছেন যে এনসিপি হলো ‘কিংস পার্টি’ এবং সরকার কাছ থেকে বিশেষ সুবিধা পাচ্ছে। এটি কি সত্য?

যদি এনসিপি ‘কিংস পার্টি’ হতো, তাহলে আমি অন্তর্বর্তী সরকার থেকে কেন পদত্যাগ করতাম? আমি থেকে যেতে পারতাম, আমার অবস্থান ব্যবহার করে ভেতর থেকে রাজনীতি করতে পারতাম।

আমরা সরকার থেকে কোনো বিশেষ সুবিধা পাচ্ছি না—শুধুমাত্র আমাদের ভূমিকার জন্য সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলির থেকে প্রেরণা এবং স্বীকৃতি পাচ্ছি। তাছাড়া, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একটি একদলীয় সরকার নয়। এতে বিভিন্ন মতাদর্শের মানুষ রয়েছেন। ফলে, প্রতিটি দল সরকার থেকে একই ধরনের আচরণ পেয়ে থাকে।

এনসিপি কি জামায়াতে ইসলামীর ঘনিষ্ঠ? তাদের দাবিগুলো একই রকম মনে হচ্ছে। আশঙ্কা রয়েছে যে এনসিপি বাংলাদেশে উগ্রবাদ বৃদ্ধিতে অবদান রাখবে।

উত্তরে নাহিদ ইসলাম বলেন, বিএনপি, জামায়াত ইসলামী এবং এনসিপি—আমরা সবাই আওয়ামী লীগ নেতাদের বিচার দাবি করি। এর মানে কি আমরা একই? কিংবা একে অপরের কাছাকাছি? মোটেও না। যদি তা হতো, তাহলে তো আমরা একটি জোট গঠন করতাম।

এনসিপি এবং জামায়াত ইসলামী সম্পূর্ণ ভিন্ন দল, যাদের আলাদা এজেন্ডা রয়েছে। ওই দল এবং আমাদের মধ্যে কোনো সংযোগ নেই। জামায়াত ইসলামী আমাদের ঘনিষ্ঠ নয়। আমাদের কিছু দাবি ওভারল্যাপ হতে পারে, যেমন আমরা সংস্কার, গণপরিষদ প্রতিষ্ঠা এবং বৃহত্তর কাঠামোগত পরিবর্তনকে অগ্রাধিকার দেই। কিন্তু উগ্রবাদের সাথে আমাদের জড়িত থাকার দাবি একটি মিথ্যা বর্ণনা প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়। উদাহরণস্বরূপ, জুলাই অভ্যুত্থানকে কিছু মানুষ সন্ত্রাসী আন্দোলন বলে চিহ্নিত করেছে; যা সম্পূর্ণ ভুল কিংবা বলা যায় বিভ্রান্তিকর।

আপনি কখন সাধারণ নির্বাচন চান?

নাহিদ ইসলাম বলেন, আমাদের ফোকাস হলো আগের শাসনামলের অপরাধীদের বিচার করা, দেশে স্থিতিশীল আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিশ্চিত করা এবং একটি গণপরিষদ গঠন করা। আমরা সংবিধান ও নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কারের পক্ষে, যাতে একটি ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থা আবার মাথা তুলতে না পারে। তাই, নির্বাচন আমাদের তাৎক্ষণিক অগ্রাধিকার নয়। আমরা বর্তমানে নির্বাচনের জন্য একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ করছি না।

আপনার নতুন দলের জন্য সামনে কী চ্যালেঞ্জ রয়েছে?

নাহিদ বেশ কিছু যুক্তি তুলে ধরে বলেন, প্রথমত, বাংলাদেশে অনেক সুপ্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল রয়েছে। যার কারণে তাদের সাথে প্রতিযোগিতা করা আমাদের পক্ষে থেকে কঠিন হবে, বিশেষ করে নির্বাচনের আগে সীমিত সময়ের পূর্বেই। যদিও সঠিক তারিখ এখনও অনিশ্চিত, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ইঙ্গিত দিয়েছেন যে নির্বাচন চলতি বছরের শেষে কিংবা ২০২৬ সালের মাঝামাঝি হতে পারে।

দ্বিতীয়ত, তৃণমূল পর্যায়ে পৌঁছানো আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ। গ্রামীণ রাজনীতি ‘ক্যাম্পাস এবং শহুর’-এর রাজনীতি থেকে আলাদা এবং সেটির জন্য একটি ভিন্ন পদ্ধতির প্রয়োজন। আমরা আগামী মাসে ঢাকার বাইরে আমাদের প্রচার শুরু করতে যাচ্ছি।

তাছাড়া, এটি দেশের জন্য একটি কঠিন সময়। তাই আমাদের অবশ্যই জনগণের দাবির সাথে সামঞ্জস্য রেখে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য সক্রিয় থাকতে হবে। এছাড়াও, দেশের বর্তমান আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির মধ্যে রাজনৈতিক কার্যক্রম বজায় রাখাও একটি বড় চ্যালেঞ্জ হবে।

প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কি দলে সমান সুযোগ পাচ্ছে?

হ্যাঁ। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও রাজনীতিতে বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে। পূর্বে এমনটা ছিলো না। এছাড়াও তারা জুলাই অভ্যুত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। আমাদের দল সবার জন্য সমান সুযোগ এবং দায়িত্ব নিশ্চিত করে। সেই সাথে, সকলের জন্য একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক স্থান তৈরি করে।

এনসিপি কী ধরনের ‘সেকেন্ড রিপাবলিক কল্পনা করে?

নাহিদ বলেন, সেকেন্ড রিপাবলিকের জন্য আমাদের প্রাথমিক দাবি হলো একটি নতুন সংবিধান, যার জন্য গণপরিষদ গঠন অত্যন্ত প্রয়োজন। এই সংবিধান ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এবং জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনার ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা উচিত। এছাড়াও আমরা একটি ভারসাম্যপূর্ণ ক্ষমতা ব্যবস্থা এবং একটি স্বাধীন বিচার বিভাগের পক্ষে, যেখানে প্রধানমন্ত্রীর অফিসের সীমাহীন ক্ষমতা অপসারণ অন্তর্ভুক্ত।

বাংলাদেশের কূটনীতি সম্পর্কে এনসিপির অবস্থান কী? দলটি কি দেশ-কেন্দ্রিক রাজনীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে?

প্রথমত, আমরা চাই বাংলাদেশ একটি ভারসাম্যপূর্ণ এবং বেনেফিসিয়াল কূটনৈতিক পদ্ধতি অনুসরণ করুক, যা কোনো বিদেশী শক্তির আধিপত্য থেকে মুক্ত থাকবে। অতীতে আমরা দেখেছি যে দিল্লির প্রভাবের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল ছিলো ফ্যাসিস্ট সরকার। তবে আমরা বাংলাদেশের রাজনীতিকে ভারত কিংবা পাকিস্তানকে কেন্দ্র করে চলতে দেব না। এনসিপি সম্পূর্ণরূপে বাংলাদেশকেন্দ্রিক থাকবে এবং জাতীয় স্বার্থকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেবে।

আপনার দল কি আওয়ামী লীগকে রাজনীতি এবং পরবর্তী নির্বাচনে অংশ নিতে দেবে?

না, আমরা চাই না আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুক। প্রথমত, দলটির অভ্যন্তরে যারা অন্যায় কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলো, তাদের অবশ্যই বিচারের আওতায় আনতে হবে।

বিদ্যমান কোনো দল কি এনসিপির রাজনীতির জন্য হুমকি?

নাহিদ ইসলাম উত্তরে বলেন, ‘না’।

এনসিপির নেতৃত্ব থেকে একজন অধিকার কর্মীকে দল চালু হওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ ডানপন্থী গোষ্ঠীর চাপে সরিয়ে দেয়া হয়েছিল। এনসিপি কীভাবে এর সাথে তার অন্তর্ভুক্তিমূলক দাবির সমন্বয় করবে?

আমরা অন্তর্ভুক্তিতে বিশ্বাস করি, তবে আমাদের সমাজের ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক সংবেদনশীলতাও বিবেচনা করতে হবে। এজন্যই তাকে সরিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিলো। তবে, আমরা বৈচিত্র্যের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং বিভিন্ন সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে আমাদের একটি প্রশংসনীয় রেকর্ড রয়েছে।

জুলাই অভ্যুত্থানে নারীরা একটি বড় ভূমিকা পালন করেছিলো। এটি বিশ্বাস করা হয়েছিল যে এর ফলে দেশজুড়ে নারীরা বেশি নিরাপত্তা এবং স্বাধীনতা উপভোগ করবে। তবে, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা এবং ‘মোরাল পুলিসিং’ বেড়েছে। অভ্যুত্থানের একজন নেতা হিসেবে আপনি কীভাবে এটি ব্যাখ্যা করেন?

নাহিদ ইসলাম জোর দিয়ে জানান, নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা বেড়ে যাওয়া সত্যিই হতাশাজনক। এর বাইরেও, সামাজিক কুসংস্কার নারীদের সমাজের অনেক দিক থেকে পিছিয়ে রাখছে। একটি রাজনৈতিক শূন্যতার মধ্যে বাংলাদেশে বিশৃঙ্খলা বেড়েছে। ৫ আগস্ট আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পতন আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে আরও দুর্বল করে দিয়েছে। যার ফলে এমন সহিংসতা নির্বিঘ্নে চলছে।

তবে, সরকার কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে, এবং আমাদের দেখতে হবে সেগুলো কার্যকর হচ্ছে কি না। ব্যক্তিগতভাবে এবং একটি দল হিসেবে, আমরা আইন প্রয়োগের সমস্যা মোকাবিলায় সরকারকে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।