
দেশে বিদ্যুত্ উত্পাদনে প্রতিশ্রুত গ্যাস দিতে পারছে না পেট্রোবাংলা। ফলে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুত্ উত্পাদন কমে যাওয়ায় লোডশেডিং বাড়তে শুরু করেছে। পাশাপাশি বিদ্যুত্ উত্পাদনে সার্বিক খরচ বেড়ে যাচ্ছে। শিগিগরই পরিস্থিতির উন্নতি না হলে শিল্পে, বাণিজ্যে এবং আবাসিকে বিদ্যুতের লোডশেডিং বাড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ বিদ্যুত্ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) এবং বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) সূত্র জানায়, ২০২৫ সালের বিদ্যুত্ উত্পাদনে মাসভিত্তিক গ্যাস সরবরাহের একটি পরিকল্পনা পেট্রোবাংলা তৈরি করে। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী বিদ্যুত্ উত্পাদন পরিকল্পনা ও জ্বালানি সংগ্রহের পরিকল্পনা করে পিডিবি। ঐ পরিকল্পনা অনুযায়ী বিদ্যুত্ কেন্দ্রগুলোতে চলতি মার্চ মাসে দৈনিক গড়ে ১২০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করার কথা ছিল। কিন্তু দৈনিক গড়ে ৯৫ কোটি ঘনফুটের মতো গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। ফলে লক্ষ্য ও পরিকল্পনা অনুযায়ী বিদ্যুত্ উত্পাদন করতে পারছে না পিডিবি।
গত ১১ মার্চ পেট্রোবাংলায় দেওয়া এক চিঠিতে পিডিবি জানায়, পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহ না পেয়ে গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর উত্পাদন ক্ষমতা পুরোপুরি ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে না। তেলভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্রের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। এর ফলে উত্পাদন ব্যয়ও বাড়ছে। সরকারের বিদ্যুত্ খাতের উত্পাদন ব্যয় কমানোর কৌশলগত লক্ষ্যমাত্রা এভাবে ব্যাহত হওয়ায় জাতীয় অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এছাড়া জ্বালানি তেলের (ডিজেল ও ফার্নেস তেল) মজুত-সংকট তৈরি হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। তাই বিদ্যমান পরিমাণের সঙ্গে আরো ২০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ বৃদ্ধি করা হলে বিদ্যুেকন্দ্রগুলোর লোড বাড়ানো বা চালু করে সংকট মোকবিলা করা যাবে।
পেট্রোবাংলার এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার যতটুকু সম্ভব ঘাটতি পূরণ করে জ্বালানি সরবরাহের ব্যবস্থা করছে। কিন্তু দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত বকেয়া ও বড় ঘাটতি সহজেই মেটানো যাচ্ছে না। জ্বালানি ঘাটতির মূল কারণ নগদ অর্থের (টাকা ও ডলার) সংকট। তাই এলএনজি আমদানিতে এবং স্থানীয় গ্যাস উত্পাদনে—দুই দিকেই কমতি ও ঘাটতি চলছে। প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার বকেয়াও আদায় করতে পারছে না পেট্রোবাংলা। এলএনজি আমদানির জন্য কাঙ্ক্ষিত পরিমাণে পাওনাও পরিশোধ করতে পারছে না।
গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর দৈনিক মোট উত্পাদন ক্ষমতা ১১ হাজার ৬৭৭ মেগাওয়াট। বর্তমানে গ্যাস থেকে সর্বোচ্চ সাড়ে ৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত্ উত্পাদন হচ্ছে। গরমে গ্যাস থেকে ৬ হাজার ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ উত্পাদনের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। বিদ্যুত্ উত্পাদনে পেট্রোবাংলার ১২০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহের পরিকল্পনা ছিল। এর বিপরীতে এখন সরবরাহ করা হচ্ছে ১০০ কোটি ঘনফুটের মতো।
পেট্রোবাংলার এক কর্মকর্তা জানান, আসন্ন গরমকালে বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে অতিরিক্ত চার কার্গো এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) আমদানির পরিকল্পনা করা হয়েছে। এই চার কার্গো এলএনজি আনতে খরচ হবে ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। পিডিবি থেকে এই টাকা না পেলে এলএনজি আমদানি করা প্রায় অসম্ভব। তিনি বলেন, গত বছরের গ্রীষ্মে পেট্রোবাংলা বিদ্যুতের জন্য ১১০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করেছে। এবার আমরা ১২০ কোটি ঘনফুট দিতে বলেছি। এজন্য টাকা দেওয়ার বিষয়ে আমরা কোনো নিশ্চয়তা দিইনি। তবে ভর্তুকির টাকা পেলে তা পরিশোধ করা হবে বলে পেট্রোবাংলাকে জানানো হয়েছে।
এদিকে দৈনিক ২০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ বাড়ালে সাতটি বিদ্যুেকন্দ্রে উত্পাদন বাড়ানো হবে বলে জানিয়েছে পিডিবি। সংস্থাটির সচিব রাশেদুল হক প্রধান স্বাক্ষরিত চিঠিতে জানানো হয়, আরপিসিএল ২১০ মেগাওয়াট বিদ্যুেকন্দ্রের লোড বৃদ্ধি করে ময়মনসিংহ এলাকার ঘাটতি পূরণ সম্ভব হবে। চাঁদপুর ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুেকন্দ্রের লোড বৃদ্ধি করে কুমিল্লা এলাকার ঘাটতি পূরণ করা; ঘোড়াশাল কেন্দ্রের লোড বৃদ্ধি করে জোনাল ব্যালান্সিং বৃদ্ধি করা; মেঘনাঘাট এলাকার সামিট ৫৮৩ মেগাওয়াট, ইউনিক ৫৮৩ মেগাওয়াট, জেরা ৭১৮ মেগাওয়াটের যে কোনো একটি বিদ্যুেকন্দ্র চালু করে ঢাকা এলাকার নির্ভরযোগ্য বিদ্যুত্ সরবরাহ বৃদ্ধি করা; ভেড়ামারা ৪১০ মেগাওয়াট কেন্দ্রে লোড বৃদ্ধি করে জোনাল লোড ব্যালান্সিং ও সার্বিক উত্পাদন বৃদ্ধি করা; সিরাজগঞ্জ ইউনিট-২ এ ২২৫ মেগাওয়াট চালু করে সার্বিক উত্পাদন বৃদ্ধি করা; সিরাজগঞ্জ ইউনিট-১ এর ২২৫ মেগাওয়াট ও ইউনিট-৩ থেকে ২২৫ মেগাওয়াটের লোড বৃদ্ধি করে সার্বিক উত্পাদন বৃদ্ধি করা।
এদিকে পিডিবির দৈনিক বিদ্যুত্ উত্পাদন রিপোর্ট অনুযায়ী গত রবিবার সন্ধ্যা ৭টায় ঐ দিন দেশে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১৪ হাজার ৫৩৮ মেগাওয়াট। এর বিপরীতে উত্পাদিত হয় ১৪ হাজার ৪২৫ মেগাওয়াট। অর্থাত্ এ দিন ঐ সময়ে সাব স্টেশন পর্যায়ে ১১৩ মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়। গ্রাহক পর্যায়ে লোডশেডিং আরো বেশি।