
কক্সবাজার বিমানবন্দরের রানওয়ে সম্প্রসারণ প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে ৮৪ শতাংশ। চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পটির কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।
কক্সবাজার বিমানবন্দরের রানওয়ে সম্প্রসারণ প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে ৮৪ শতাংশ। চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পটির কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। সম্প্রসারিত রানওয়ে ও উড়োজাহাজ উড্ডয়ন-অবতরণে সহায়ক বাতি স্থাপন করা হয়েছে বাঁকখালী নদী ও সাগরের মোহনায় মহেশখালী চ্যানেলের মুখে। নদীর দিকে নদীপ্রস্থের প্রায় ৫৯ শতাংশজুড়ে স্থাপন করা হয়েছে অবকাঠামো। অস্থায়ী জেটিসহ অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে নদীর ফোরশোর বা তীরভূমিতে। এতে কাজ শেষ হওয়ার আগেই আশপাশের প্রতিবেশে প্রকল্পটির বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। নাব্য হারাচ্ছে প্রকল্প বাস্তবায়ন এলাকাসংলগ্ন মহেশখালী চ্যানেলের আড়াই কিলোমিটার অংশ। বড় ধরনের পরিবেশগত ঝুঁকিতে পড়েছে চ্যানেলটি। এমনকি অদূরে সোনাদিয়া দ্বীপের জনজীবনও হুমকির মুখে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এ অবস্থায় চ্যানেলে পাইলিং করে নির্মিত রানওয়ের সহায়ক কাঠামো উচ্ছেদে ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)।
প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। এতে শুরুতে ব্যয় ধরা হয়েছিল প্রায় ১ হাজার ৫৬৮ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। পরে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ব্যয় আরো ২২৫ কোটি টাকা বাড়ানোর অনুমোদন দেয়া হয়। নির্মাণকাজ বাস্তবায়ন হচ্ছে চীনের দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চাংজিয়াং ইচাং ওয়াটার ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যুরো (সিওয়াইডব্লিউসিবি) ও চায়না সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন করপোরেশন-জেভির মাধ্যমে। সমুদ্র চ্যানেলে কক্সবাজার বিমানবন্দর সম্প্রসারণের এ প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০২১ সালে। পরের বছর প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করে যান বিআইডব্লিউটিএর প্রতিনিধিরা। সে সময় নৌ-চ্যানেলের অভ্যন্তরে রানওয়ে সম্প্রসারণের ধারাবাহিকতায় বাঁকখালী নদী, মহেশখালী চ্যানেলসহ কক্সবাজার নৌ-রুট বিলুপ্ত ও আশপাশের প্রতিবেশে বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা করেছিল সংস্থাটি।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কক্সবাজার বিমানবন্দর ভূমিতে সম্প্রসারণ করতে হলে বিপুল পরিমাণ বেসরকারি স্থায়ী অবকাঠামো, বিশেষ করে হোটেল-মোটেল ভাঙতে হতো। সেক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি ও ব্যয়বহুল ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া এড়িয়ে বেবিচক সমুদ্র চ্যানেলে রানওয়ে সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেয়। এজন্য নদীবন্দর ও নৌ-রুটের সংরক্ষক প্রতিষ্ঠান বিআইডব্লিউটিএর মতামত না নিয়েই নদীতীরবর্তী ৬৮২ একর ভূমি অধিগ্রহণের উদ্যোগ নেয়া হয়।
বিষয়টি নিয়ে বিআইডব্লিউটিএর পক্ষ থেকে একাধিকবার শঙ্কা প্রকাশ এবং ফোরশোর ও নদী ব্যবহারের অনুমোদন নেয়ার চিঠি দেয়া হলেও সেটি আমলে নেয়নি প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। প্রকল্পটির কারণে নদীতে নাব্য হারানোর ঝুঁকি তৈরি হলে নৌ-চ্যানেলের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করতে বিআইডব্লিউটিএর একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গত বছরের ৮ নভেম্বর প্রকল্প এলাকা সরজমিনে পরিদর্শন করে। সংস্থাটির পরিচালক (বন্দর ও নদীবন্দর) একেএম আরিফ উদ্দিনকে আহ্বায়ক করে গঠিত কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন অতিরিক্ত পরিচালক (হাইড্রোগ্রাফি বিভাগ) মো. নজরুল ইসলাম, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (ড্রেজিং) মো. মিজানুর রহমান ভূঁইয়া ও প্রকৌশল বিভাগের ভারপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী এএসএম আশরাফুজ্জামান। কমিটির পক্ষ থেকে চলতি মাসেই একটি প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়েছে।
এতে বলা হয়, নদীতে পিলার স্থাপন করা হলে স্রোত বাধাগ্রস্ত হয়ে গোড়ায় ধীরে ধীরে পলি জমে চর সৃষ্টির প্রবণতা দেখা যায়। একইভাবে পলি জমে মহেশখালী চ্যানেলের উৎসমুখ বন্ধ বা সরু হয়ে (বাঁকখালী) নদীটি এখন জীর্ণশীর্ণ হয়ে পড়ার পথে। নির্মিত রানওয়ের প্রভাবে এরই মধ্যে চ্যানেলের প্রবেশমুখে নাজিরারটেক অংশে নাব্য সংকট দেখা দিয়েছে। চ্যানেলের এ অংশের বিকল্প হিসেবে সোনাদিয়া দ্বীপ এলাকা দিয়ে নতুন চ্যানেল তৈরি হয়েছে, যাতে নৌপথের দৈর্ঘ্য তিন কিলোমিটার বেড়েছে। বিকল্প চ্যানেলটি এখন ধীরে ধীরে পশ্চিমে সম্প্রসারণ হচ্ছে। এতে সোনাদিয়া দ্বীপের জনজীবন একসময় হুমকিতে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। মহেশখালী চ্যানেলের উৎসমুখের ব্যাপ্তি বেড়ে যাওয়ায় এখন বিস্তীর্ণ অংশ দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এতে গোটা অংশেরই নাব্য কমে গিয়েছে। সব মিলিয়ে এখন নতুন চ্যানেলের আড়াই কিলোমিটার অংশে নাব্য সংকট দেখা দিয়েছে।
এতে আরো বলা হয়, রানওয়ে সম্প্রসারণের কারণে মহেশখালী চ্যানেলের উৎসমুখে পলি জমে কক্সবাজার-সেন্ট মার্টিন রুটে নৌ-চলাচল ঝুঁকিতে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। পলি জমে চ্যানেলটি বন্ধ হলে মহেশখালী-কক্সবাজার, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সব নৌপথই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এরই মধ্যে আশপাশ এলাকায় প্রকল্পটির বিরূপ প্রতিবেশগত প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। সামনের দিনগুলোয় সোনাদিয়া দ্বীপের জনজীবনও হুমকির মুখে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ অবস্থায় মহেশখালী চ্যানেল রক্ষায় সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও স্থানীয় প্রশাসনের সমন্বয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা আয়োজন, যথাযথ সমীক্ষা চালানো, বেবিচকের কাছ থেকে চ্যানেল-নদীর ফোরশোর ব্যবহারের জন্য বকেয়া ভ্যাট ও আয়কর আদায় এবং মহেশখালী চ্যানেলে পাইলিং করে নির্মিত উড়োজাহাজ অবতরণে সহায়ক অবকাঠামো (রানওয়ে) উচ্ছেদের সুপারিশ করা হয়েছে।
প্রকল্প বাস্তবায়নে নদী ও পরিবেশের ক্ষতির বিষয়টি অস্বীকার করে কক্সবাজার বিমানবন্দর রানওয়ে সম্প্রসারণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মো. ইউনুছ ভূঁইয়া বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সমুদ্রের একটি অংশ ভরাট করে রানওয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। সমুদ্রকে ভূমিতে রূপান্তর করায় আমরা ভূমি মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিয়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে অনাপত্তি নিয়েছি। সমুদ্রবক্ষে রানওয়ে নির্মাণে হাইড্রোমরফোলজিক্যাল সমীক্ষা ছাড়াও একাধিক সার্ভে করা হয়েছে। বিআইডব্লিউটিএ তাদের নিজস্ব মতামত প্রদান করলে তাতে আমাদের কিছু করার নেই। একনেকে পাস হওয়ার সময় সব মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের অনুমতি নিয়েই গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ফলে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে কোনো ধরনের নিয়ম লঙ্ঘনের সুযোগ নেই।’
নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, কক্সবাজার বিমানবন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্পের শুরুতে নদীতীর ব্যবহার ও তীরে প্রকল্পকাজ বাস্তবায়নে একটি অস্থায়ী জেটি নির্মাণের জন্য অনুমতি চেয়েছিল বেবিচক। এজন্য ২০২২ সালের ৬ জানুয়ারি বেবিচকের পক্ষ থেকে দেয়া একটি চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে একই বছরের ২ মার্চ এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বিআইডব্লিউটিএকে নির্দেশনা দেয় নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়। এরপর বিআইডব্লিউটিএর পক্ষ থেকে ২০২২ সালের ৩ জুলাই চট্টগ্রামের স্থানীয় ত্রিবিভাগীয় স্থায়ী কমিটিকে প্রকল্প এলাকার স্থান সরজমিন পরিদর্শন করে একটি প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়। কমিটি একই বছরের ৬ ডিসেম্বর প্রকল্প এলাকা সরজমিন পরিদর্শন করে। কমিটি দ্য পোর্ট অ্যাক্ট, ১৯৬৬-এর আলোকে কক্সবাজার বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের অনুকূলে ফোরশোর, পাইলিং ও অস্থায়ী জেটি নির্মাণ/স্থাপনের জন্য শর্ত সাপেক্ষে অনুমতি দেয়ার সুপারিশ করে। এরপর ২০২৩ সালের ২৬ জানুয়ারি ত্রিবিভাগীয় কমিটির দেয়া সুপারিশে প্রকল্প কর্তৃপক্ষকে বিআইডব্লিউটিএর অনাপত্তি গ্রহণ এবং ফি বাবদ ৭১ লাখ ২১ হাজার ৩৮১ লাখ টাকা এবং ভ্যাট (১৫ শতাংশ) ও আয়করসহ (৫ শতাংশ) মোট ৮১ লাখ ৮৯ হাজার ৫৮৮ টাকা প্রদানে চিঠি দেয়া হয়। বর্তমানে পাওনা ৪ কোটি ১২ লাখ টাকায় উন্নীত হয়েছে বলে বিআইডব্লিউটিএর প্রতিবেদনে দাবি করা হয়। এ বিষয়ে একাধিকবার চিঠি দেয়া হলেও বেবিচক তা পরিশোধ না করেই প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নেয় বলে অভিযোগ বিআইডব্লিউটিএর।
সংশ্লিষ্ট নথিপত্রের তথ্য অনুযায়ী, বিআইডব্লিউটিএর পক্ষ থেকে কক্সবাজার বিমানবন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্প বাস্তবায়নে নেভিগেশন চ্যানেলের ওপর প্রভাব বিষয়ে কোনো সমীক্ষা রয়েছে কিনা তা জানতে চাওয়া হয়েছিল। যদিও বেবিচকের প্রকল্প বিভাগ জানিয়েছে, রানওয়ের তীর রক্ষার জন্য হাইড্রোমরফোলজিক্যাল সমীক্ষা করা হলেও নেভিগেশন বা নৌ-চলাচল নিয়ে কোনো সমীক্ষা করা হয়নি।
প্রসঙ্গত, প্রকল্পটির ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ শুরু হয় ২০২২ জুলাইয়ে। যথাযথ অনুমোদন, পরামর্শ বা সমীক্ষা ছাড়াই কাজ শুরু হলে সে সময় নৌপথের গতিপথ পরিবর্তন, নাব্য ঝুঁকিসহ একাধিক আশঙ্কার কথা জানিয়েছিল বিআইডব্লিউটিএ। ওই সময়ে দেয়া এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, প্রকল্পটি বাস্তবায়নের পর কক্সবাজারসহ মহেশখালী চ্যানেল ছোট হয়ে যাওয়া এবং দিক পরিবর্তন হয়ে দক্ষিণাঞ্চলের নৌ-যোগাযোগ মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হবে বলে আশঙ্কা করা হয়েছিল। বিআইডব্লিউটিএর সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই না করে, মতামত না নিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন, পিয়ার তৈরি ও ভরাটের ফলে মহেশখালী চ্যানেল উত্তর দিকে সোনাদিয়া দ্বীপের দিকেও সরে যেতে পারে বলে ওই সময়ে মতামত দিয়েছিল বিআইডব্লিউটিএ।
জানতে চাইলে বিআইডব্লিউটিএর গঠিত কমিটির আহ্বায়ক এবং সংস্থাটির বন্দর ও পরিবহন বিভাগের পরিচালক একেএম আরিফ উদ্দিন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বাঁকখালী নদী ও আশপাশের নৌ-চ্যানেলের সংরক্ষক বিআইডব্লিউটিএ। বেবিচক প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আমাদের কোনো অনুমোদন নেয়নি, এমনকি যথার্থ স্টাডি করেনি। রানওয়ে নির্মাণে সমুদ্র চ্যানেল ভরাট করায় সেখানে বড় ধরনের নাব্য ঝুঁকি তৈরি হয়েছে, যা এখন দৃশ্যমান। এ বিষয়ে নানাভাবে প্রকল্প কর্তৃপক্ষকে জানানো হলেও তারা কর্ণপাত করেনি। বিআইডব্লিউটিএ একটি বিশেষ কমিটি করে সমুদ্র চ্যানেলের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। কমিটির প্রতিবেদন সরকারের ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে উত্থাপন করা হবে।’
বেবিচক সূত্রে জানা গেছে, কক্সবাজার বিমানবন্দরের রানওয়ে সম্প্রসারণ প্রকল্পে শুরুতে ৬ হাজার ৭৭৫ ফুট থেকে নয় হাজার ফুটে এবং প্রস্থ ১২০ ফুট থেকে ২০০ ফুট করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। বর্তমানে এটির দৈর্ঘ্য ১০ হাজার ৭০০ ফুটে উন্নীত করার কাজ চলছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৩০০ ফুট থাকবে বাঁকখালী নদীর মোহনা ও সমুদ্রের কিছু অংশে। মহেশখালী চ্যানেলের দিকে এ রানওয়ে সম্প্রসারণের প্রকল্পটি ২০২৪ সালের মে মাসের মধ্যে শেষ করার কথা ছিল। প্রকল্পের ব্যয় ধরা ছিল ১ হাজার ৫৬৮ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। কিন্তু ভূমি জটিলতাসহ বিভিন্ন কারণে বর্তমানে কাজ শেষ হয়েছে ৮৪ শতাংশ। এ কারণে প্রকল্পের সময় বাড়িয়ে চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত নেয়া হয়েছে। আর ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৭৯৪ কোটি টাকায়।