Image description
 

ধর্ষণ মামলার তদন্ত ও বিচারের সময় কমিয়ে আনা, ডিএনএ রিপোর্ট ছাড়াই মেডিকেল সনদের ভিত্তিতে মামলার কাজ চালানোসহ বেশ কিছু নতুন বিধান রেখে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের সংশোধনীর ব্যাপারে নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে সরকার। পাশাপাশি শিশু ধর্ষণের বিচার দ্রুতœ শেষ করতে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করার বিধান রাখা হচ্ছে আইনে।

অন্যদিকে নারী ও শিশু নির্যাতনসংক্রান্ত অপরাধ নির্ণয়ের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য আপাতত চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিভাগে দুটি ফরেনসিক ডিএনএ ল্যাবরেটরি স্থাপন করা হবে।

গতকাল সোমবার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে এক বিশেষ সভায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন), অধ্যাদেশ, ২০২৫-এর খসড়ার নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে উপদেষ্টা পরিষদ।

পরে দুপুরে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে এ বিষয়ে কথা বলেন আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ও প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।

ব্রিফিংয়ে রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘আজ (গতকাল) উপদেষ্টা পরিষদের একটা বিশেষ বৈঠক ছিল। দেশে যেভাবে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন বেড়ে যাচ্ছে, সেই বিবেচনায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধন করতে বসেছিলাম। আইনটা সংশোধনের নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে।’

উপদেষ্টা বলেন, ‘মাগুরা ও বরগুনায় ধর্ষণ ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। সবকিছু বিবেচনায় রেখে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০-এর বেশ কিছু সংশোধন প্রস্তাব করেছে আইন মন্ত্রণালয়। ইতিমধ্যে আমরা কিছু মতামত পেয়েছি। সেই মতামতগুলো যাচাই-বাছাই করে বৃহস্পতিবার এ আইনটি চূড়ান্তভাবে অনুমোদন করা হবে বলে আশা করছি।’

চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে স্থাপিত হবে দুটি ডিএনএ ল্যাব : ধর্ষণের বিচার দ্রুত করার স্বার্থে দেশে ডিএনএ টেস্টের ল্যাব সংখ্যা বাড়ানো এবং এ ধরনের মামলার বিচারকাজে আরও বিচারক নিয়োগের বিষয়েও উপদেষ্টা পরিষদে সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানান রিজওয়ানা।

তিনি বলেন, ‘ধর্ষণের বিচারে বিলম্ব হওয়ার কারণ হচ্ছে পর্যাপ্ত পরিমাণ ডিএনএ ল্যাব না থাকা। এই মুহূর্তে একটি মাত্র ল্যাব আছে। উপদেষ্টা পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চট্টগ্রাম এবং রাজশাহীতে আরও দুটি ডিএনএ ল্যাব স্থাপন করা হবে। এ ছাড়া বিশেষ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে দ্রুত কিছু বিচারক নিয়োগ প্রক্রিয়াও শুরু করা হবে, যেন ধর্ষণসহ অন্যান্য মামলার বিচার ত্বরান্বিত করা যায়।’

আইনে যেসব পরিবর্তন আসছে : নারী ও শিশু নির্যাতন দমন অধ্যাদেশের খসড়ায় কী কী আছে, সেসব বিষয়ে তুলে ধরেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। তিনি বলেন, এ আইনে বিচার ও তদন্তের সময় কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে। খসড়ায় শিশু ধর্ষণে মামলার বিচার আলাদাভাবে করার জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল স্থাপনের বিধান রাখা হয়েছে। এ বিষয়ে উপদেষ্টারা নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছেন।

নারী ও শিশু আদালতে ধর্ষণের মামলার জট লাগার কথা উল্লেখ করে আইন উপদেষ্টা বলেন, কারণ এখানে দুই ধরনের মামলা আসছে। একটা হচ্ছে সম্মতিসহ বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ। এগুলোর অনেক আধিক্য ছিল। এসব মামলার কারণে সম্মতি ছাড়া যেসব ধর্ষণ, সেগুলোর বিচার আটকে থাকছে।

‘সেজন্য আমরা বিধান যুক্ত করেছি, বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে সম্মতিতে প্রতারণামূলকভাবে হোক বা যেভাবে হোক ধর্ষণের ঘটনাগুলো আলাদা অপরাধ। আর সম্মতি ব্যতিরেকে মাগুরার ক্ষেত্রে, বরগুনার ক্ষেত্রে যে ধর্ষণের ঘটনাগুলো ঘটেছে, সেই ধর্ষণ ঘটনা আলাদা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। সম্মতি ব্যতিরেকে যে ধর্ষণ, সেটার ক্ষেত্রে বিচার ও তদন্তের সময় কমানো হয়েছে। এ মামলাগুলোর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এগুলো প্রয়োজনে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হচ্ছে’ যোগ করেন তিনি।

ধর্ষণের সংজ্ঞায় পরিবর্তনের কথা জানিয়ে আসিফ নজরুল বলেন, ‘বলাৎকারকেও এখানে যুক্ত করা হয়েছে। যেকোনোভাবে ধর্ষণ করা হলে সেটি ধর্ষণের শাস্তির আওতায় আনা হচ্ছে। ধর্ষণকালে বা ধর্ষণের উদ্দেশ্যে যদি জখম করা হয়, সেটিরও কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে।’

ডিএনএ পরীক্ষার সনদ পাওয়ার অপেক্ষায় অনেক মামলা বছরের পর বছর ধরে আটকে থাকত উল্লেখ করেন আইন উপদেষ্টা বলেন, ‘বিধান করা হচ্ছে ডিএনএ পরীক্ষার সনদ ছাড়াই আদালত যদি মনে করেন, চিকিৎসা সনদ ও পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যের ভিত্তিতে বিচার সম্ভব, তাহলে আদালত ডিএনএ সনদ ছাড়াই দ্রুত বিচারের জন্য চিকিৎসক সনদ ও পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যের ভিত্তিতে বিচার করবেন। ধর্ষণের উদ্দেশ্যে যদি গুরুতর আহত করা হয় সেটারও গুরুতর শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে।’

আসিফ নজরুল বলেন, ‘ধর্ষণের উদ্দেশ্য কারও ওপর আক্রমণ করে ব্যর্থ হওয়ার পর যদি ভুক্তভোগীর শারীরিক ক্ষতি করা হয়, তাহলে সেটাও শাস্তির আওতায় রাখা হচ্ছে। এ ছাড়া ঘটনার শিকার ব্যক্তির সুরক্ষায় ক্ষতিপূরণসহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা থাকবে এখানে।’ তিনি বলেন, ‘আগামী বৃহস্পতিবার এটা চূড়ান্ত অনুমোদন হয়ে যাবে আশা করছি। এরপর খুব দ্রুত গেজেট নোটিফিকেশনও হয়ে যাবে। তবে ক্লিয়ার করি, এর সঙ্গে মাগুরা হত্যা ও ধর্ষণ মামলার বিচারের সম্পর্ক নেই। ওই বিচার এগিয়ে চলেছে নিজস্ব গতিতে এবং আমরা মনে করি খুবই দ্রুততার সঙ্গে এ মামলার বিচার হবে।’

মাগুরায় বোনের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার হয়ে প্রাণ হারানো আট বছরের শিশুটির ঘটনাসহ নারী নিপীড়নের বেশ কিছু ঘটনায় সারা দেশে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কয়েক দিন আগেই আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল জানিয়েছিলেন, ধর্ষণ মামলার তদন্ত ও বিচারের সময় কমিয়ে অর্ধেক করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বিদ্যমান আইন পরিবর্তন করে এসব মামলায় তদন্তের সময় ৩০ থেকে কমিয়ে ১৫ দিন করা হচ্ছে। আর বিচার শেষ করতে হবে ৯০ দিনের মধ্যে। এ ছাড়া ডিএনএ সনদের পরিবর্তে শুধু চিকিৎসা সনদ ও পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যের ভিত্তিতে বিচারক এ মামলার বিচারকাজ পরিচালনা করতে পারবেন।

মাগুরার শিশু ধর্ষণের মামলার বিচার খুব দ্রুত : আইন উপদেষ্টা বলেন, মাগুরায় সেই শিশু হত্যা ও ধর্ষণ মামলা বিচারের সম্পর্ক নতুন অধ্যাদেশের সঙ্গে না থাকলেও খুবই দ্রুততার সঙ্গে এ মামলার বিচার হবে। তদন্ত শেষ হওয়ার পথে। ডিএনএ পরীক্ষার সনদ পাওয়া যাবে দুয়েক দিনের মধ্যে। কয়েক দিনের মধ্যেই মামলার বিচার শুরু হবে এবং দ্রুত নিষ্পত্তি হবে। যেহেতু অকাট্য অনেক প্রমাণ রয়েছে।

মাজারে হামলাকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে সরকার : ব্রিফিংয়ে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে দেশের বিভিন্ন স্থানে মাজার ভাঙার বিষয়েও আলোচনা হয়।

তিনি বলেন, ‘আমরা লক্ষ করছি মাজার ভাঙার নামে একটা নৈরাজ্য চলছে। এতদিন সরকার রিঅ্যাকটিভ অবস্থানে ছিল, দোষীদের গ্রেপ্তার করেছে। কিন্তু এখন সরকার সবার উদ্দেশে সতর্ক করে বলতে চায়, সরকার আর কোনোভাবেই মাজার ভাঙার বিষয়টি গ্রহণ করবে না। সবাইকে এ ধরনের কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। জড়িতদের ব্যাপারে কঠোর থেকে কঠোরতম আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

বর্তমানে দেশে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রয়েছে দাবি করে রিজওয়ানা আরও বলেন, দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখার বিষয়টি খেয়াল রাখার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-উপদেষ্টাদের প্রধান উপদেষ্টা নির্দেশ দিয়েছেন।