
Ahmed Rafique (আহমেদ রফিক) প্রথমা থেকে বিপ্লবী ছাত্রনেতার বই প্রকাশ জনগণকে কীসের বার্তা দেয়? যে কোনো গনতান্ত্রিক দেশের মতো বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে গণমাধ্যমের ভূমিকা বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ, তবে অনেক ক্ষেত্রেই তা নিরপেক্ষতার বদলে নির্দিষ্ট রাজনৈতিক স্বার্থের অনুগত থেকেছে। বিশেষ করে, যখন কোনো দল ক্ষমতায় থাকে, তখন অনেক সংবাদমাধ্যমই তাদের সেবাদাসে পরিণত হয়। কিন্তু রাজনৈতিক পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে তাদের অবস্থানও পরিবর্তিত হয়, যেন তারা কখনোই নির্দিষ্ট পক্ষের স্বার্থে কাজ করেনি।
এ রকম এক দ্বৈত আচরণের জ্বলন্ত উদাহরণ প্রথম আলো। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন এই পত্রিকা তাদের অন্যতম সহযোগী হিসেবে কাজ করেছিল, সরকারের কর্মকাণ্ডকে ইতিবাচকভাবে প্রচার করেছে, সমালোচনার কণ্ঠ রোধ করতেও পরোক্ষ ভূমিকা রেখেছে; এমনকি গুম-খুনের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের পক্ষে বয়ান নির্মানের জন্য কাজ করেছে। কিন্তু যখনই তারা নিশ্চিত হয়ে যায় যে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা হারাতে যাচ্ছে এবং দেশে নতুন রাজনৈতিক শক্তির উত্থান ঘটতে যাচ্ছে, তখন থেকে এই একই সংবাদমাধ্যম নতুন বিপ্লবী চেতনাকে তাদের প্ল্যাটফর্মে জায়গা দিতে শুরু করে। সাম্প্রতিক একটি ঘটনা এ দ্বৈত আচরণকে আরও সুস্পষ্ট করে তুলেছে—একজন বিপ্লবী ছাত্রনেতার লেখা বই প্রথম আলোর প্রকাশনা সংস্থা প্রথমা থেকে প্রকাশিত হয়েছে, যেখানে বিপ্লব, আন্দোলন ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের বিষয়গুলো উঠে এসেছে।
প্রশ্ন হলো, যেই পত্রিকা দীর্ঘ সময় ধরে শাসক দলের স্বার্থে কাজ করেছিল, তারা হঠাৎ করেই বিপ্লবের প্রচারক হয়ে উঠল কেন? এটা কি সত্যিকারের চেতনার পরিবর্তন, নাকি নিছকই রাজনৈতিক সুবিধাবাদ? ..... একমাত্র ইসলামবিরোধীতা ছাড়া প্রথম আলো কখনোই কোনো নির্দিষ্ট আদর্শের প্রতি অনুগত নয়, বরং তাদের মূল লক্ষ্য হলো রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিকভাবে নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণ করা। আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন প্রথম আলো তাদের সহযোগী ছিল, কারণ সেটাই ছিল "সুবিধাজনক"। আর এখন, যখন বিদ্রোহী তরুণদের উত্থান ঘটছে, তখন তারা সেই বিপ্লবী চেতনার প্রচারক সাজছে। এই ঘটনাটি আমাদের সামনে কয়েকটি গুরুতর প্রশ্ন তোলে— প্রথম আলো কি আদৌ বিপ্লবের প্রতি অনুগত, নাকি এটি কেবল একটি বাণিজ্যিক কৌশল? প্রকৃতপক্ষে, পত্রিকাটি কখনোই বিপ্লবের প্রতি দায়বদ্ধ ছিল না। তারা যে কোনো সময় নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করতে পারে, যদি রাজনৈতিক বাতাসের দিক পরিবর্তন হয়।
প্রথম আলো যখন আওয়ামী লীগের দোসর ছিল, তখন কি তারা বিপ্লবীদের দমন করতে ভূমিকা রাখেনি? নিশ্চয়ই রেখেছে। অতীতে আমরা দেখেছি, এই সংবাদমাধ্যম কীভাবে সরকারপন্থী প্রচারণা চালিয়েছে, ছাত্র আন্দোলন ও বিরোধী কণ্ঠস্বরের বিরুদ্ধে নানাভাবে প্রচার চালিয়েছে। এখন সেই একই গণমাধ্যম বিপ্লবী ভাবধারা ছড়াতে চাইছে—এটি তাদের নীতিহীনতারই প্রমাণ। ..... যেকোনো বিপ্লব টিকেই থাকে পরাজিত শক্তি, তাদের শাসনব্যবস্থা ও তাদের প্রচারযন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করার মধ্য দিয়ে। কিন্তু যদি বিপ্লবীরাই পতিত শাসকদের প্রাক্তন সহযোগীদের হাতেই নিজেদের বক্তব্য প্রচার করতে শুরু করেন, তাহলে সেই বিপ্লবের নির্ভরযোগ্যতা নিয়েই প্রশ্ন ওঠে। ..... ইতিহাস বলে, তারা কেবলমাত্র সেই পক্ষের সঙ্গে থাকে যারা ক্ষমতার সম্ভাবনাময় দাবিদার। যদি রাজনৈতিক পরিস্থিতি আবার পাল্টে যায়, তবে তারা পুনরায় নতুন ক্ষমতাসীনদের সুরে কথা বলবে।
বিপ্লবের নাম করে যদি প্রথম আলোর মতো প্রতিষ্ঠানকে নির্ভরযোগ্য ধরে নেওয়া হয়, তাহলে তা বিপ্লবের আদর্শের সঙ্গে আপস করার শামিল। যারা সত্যিকারের বিপ্লব চায়, তাদের উচিত এই সুবিধাবাদী মিডিয়ার ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসা। প্রথোম আলোর মতো গণমাধ্যম বিপ্লবকে কেবলমাত্র নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে চাইবে, কিন্তু যখনই পরিস্থিতি বদলাবে, তারা আবারও পুরনো চরিত্রে ফিরে যাবে।
... এই বিপ্লবী ছাত্রনেতার প্রথমা থেকে বই প্রকাশের সিদ্ধান্ত যেসকল দিক থেকে গুরুতর ক্ষতির কারণ হতে পারে—
১. বিপ্লবের বিশ্বাসযোগ্যতা বিনষ্ট হবে বিপ্লবের মূল শক্তি হলো জনসমর্থন ও আদর্শিক স্থিরতা। কিন্তু যখন একজন বিপ্লবী নেতা অতীতে শাসকদলের দোসর হিসেবে পরিচিত একটি গণমাধ্যমকে নিজেদের বার্তা প্রচারের জন্য বেছে নেন, তখন সাধারণ জনগণের মনে সন্দেহ তৈরি হয়। জনগণ ভাবতে পারে, এই বিপ্লবী নেতারা আদর্শের জন্য নয়, বরং ক্ষমতা ও সুবিধার জন্য লড়ছেন। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ সহজেই তাদের বিরুদ্ধে প্রচার চালাতে পারে যে তারা আদর্শিকভাবে আপসকামী। এর ফলে তাদের সমর্থকদের মধ্যেও বিভ্রান্তি ও হতাশা ছড়িয়ে পড়বে, যা বিপ্লবের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে।
২. বিপ্লবের নিয়ন্ত্রণ সুবিধাবাদী শক্তির হাতে চলে যাবে প্রথম আলো একসময় পতিত শাসকদলের সহযোগী ছিল, আর এখন বিপ্লবীদের কণ্ঠ প্রচার করছে। কিন্তু ইতিহাস বলে, এই ধরনের সংবাদমাধ্যম চিরকাল সুবিধাবাদী থাকে এবং পরিস্থিতি বুঝে নিজেদের অবস্থান বদলায়। বিপ্লবের বার্তা যদি প্রথম আলোর মতো প্রতিষ্ঠান দ্বারা পরিচালিত হয়, তাহলে এই বিপ্লবী ছাত্রনেতা নিজের বিপ্লবের উপর নিয়ন্ত্রণ হারাতে পারেন। প্রথম আলো ভবিষ্যতে তাদের বক্তব্য পরিবর্তন করতে পারে, বিপ্লবের প্রকৃত চেতনা বিকৃত করতে পারে, এমনকি তাদের বিরুদ্ধে প্রচারণাও চালাতে পারে।
৩. রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতার জন্য দীর্ঘমেয়াদি হুমকি সৃষ্টি হবে যদি বিপ্লবী ছাত্রনেতারা সুবিধাবাদী গণমাধ্যমের মাধ্যমে নিজেদের বার্তা প্রচার করেন, তবে এটি শুধুমাত্র তাদের বিপ্লবের জন্য নয়, বরং রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতার জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। সুবিধাবাদী গণমাধ্যম রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটাতে পারে, যা অস্থিতিশীলতা বাড়িয়ে তুলবে। একটি শক্তিশালী বিপ্লবের জন্য জনগণের ঐক্য দরকার, কিন্তু বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়লে ভেতর থেকে আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়বে এবং রাষ্ট্র একটি দীর্ঘমেয়াদি অস্থিরতার মুখে পড়তে পারে। বিরোধী শক্তিগুলো এটিকে একটি দুর্বলতা হিসেবে ব্যবহার করে বিপ্লবীদের দমন করতে পারে, ফলে বিপ্লব সফল না হয়ে আরও বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে। ... একজন বিপ্লবী নেতা যদি সত্যিকারের পরিবর্তন আনতে চান, তবে তাকে অবশ্যই ভাবতে হবে—তিনি কি বিপ্লবের আদর্শ ধরে রাখতে পারছেন, নাকি সুবিধাবাদী শক্তির খেলা খেলছেন? যদি বিপ্লবের বার্তা প্রচারের জন্য সুবিধাবাদী গণমাধ্যমের ওপর নির্ভর করতে হয়, তাহলে সেই বিপ্লবের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। ...... শেষ কথা হলো, প্রথম আলোর মতো সুবিধাবাদী গণমাধ্যম কখনোই বিপ্লবের প্রকৃত বন্ধু হতে পারে না। তারা কেবলমাত্র পরিস্থিতির সুযোগ নেয়। অতএব, যারা প্রকৃত পরিবর্তন আনতে চায়, তাদের এই গণমাধ্যমের দ্বৈত চরিত্র বুঝতে হবে এবং নিশ্চিত করতে হবে যে বিপ্লব কখনোই এমন একটি প্রতিষ্ঠানের উপর নির্ভরশীল হয়ে না পড়ে, যারা অতীতে স্বৈরতন্ত্রের সঙ্গী ছিল। একজন বিপ্লবী নেতা যদি সত্যিকারের পরিবর্তন চান, তাহলে তাকে অবশ্যই ভাবতে হবে—তিনি কি সত্যিই একটি গণমাধ্যমকে বিপ্লবের হাতিয়ার বানাচ্ছেন, নাকি সেই গণমাধ্যমই তাকে তাদের রাজনৈতিক খেলায় ব্যবহার করছে?