Image description

ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন বেক্সিমকো গ্রুপের বিরুদ্ধে অবিশ্বাস্য জালিয়াতির তথ্য উদ্ঘাটিত হয়েছে। গ্রুপটির নামে এতদিন যে খেলাপি ঋণের তথ্য প্রকাশিত হয়েছে বাস্তবে তা দ্বিগুণের বেশি। অর্থাৎ খেলাপির অঙ্ক গোপন রেখে অর্ধেকের কম দেখানো হয়েছে। এখন পর্যন্ত সম্পন্ন হওয়া তদন্তে বেক্সিমকো গ্রুপের নামে-বেনামে ৫৩ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণের তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে। এটি আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।

শুধু তাই নয়, আমদানি-রপ্তানির আড়ালে সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকার হিসাব এখনও মিলছে না। এসব টাকা পাচার হয়েছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে ১ হাজার ১৪০ কোটি টাকা পাচারের তথ্য শনাক্ত করা হয়েছে। আর সব মিলিয়ে মোট ৬১ হাজার কোটি টাকার সম্পদ জব্দ, লেনদেন স্থগিত বা আটক করা হয়েছে। বিদেশে ৫টি শেল কোম্পানির (প্রকৃত মালিকের পরিচয় গোপন করে বেনামি কোম্পানি) অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এছাড়া পিতা (সালমান) পুত্রের মতো চাচা (সালমান) ভাতিজা মিলেও টাকা পাচার করেছেন।

সরকারের সংশ্লিষ্ট একাধিক সংস্থার দেশে-বিদেশে পরিচালিত বিভিন্ন তদন্ত এবং অন্যান্য প্রতিবেদন থেকে পাওয়া গেছে উল্লিখিত সব চাঞ্চল্যকর তথ্য। বেক্সিমকো গ্রুপের বিরুদ্ধে আরও তদন্ত চলছে। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে গ্রুপটি ব্যাংকসহ বিভিন্ন খাতে নজিরবিহীন লুটপাট করেছে। তাদের দুর্নীতির তথ্য উদ্ঘাটনে বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ), দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও সিআইডি তদন্ত করছে। এসব তদন্তের আলোকে গ্রুপটির বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। আরও ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোর (সিআইবি) প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, গ্রুপটির বিভিন্ন কোম্পানি নামে-বেনামে নেওয়া ঋণের পরিমাণ ৩৬ হাজার কোটি টাকা। উপদেষ্টা পরিষদের গঠিত কমিটির তদন্তে দেখা যায়, গ্রুপটির নামে-বেনামে নেওয়া ঋণের পরিমাণ ৪০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ১৬ হাজার কোটি টাকাই বেনামি ঋণ। আলোচ্য ঋণের মধ্যে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগ পর্যন্ত কোনো খেলাপি ঋণ ছিল না। ওই সময়ে বেক্সিমকো গ্রুপ ব্যাংক থেকে শুধু ঋণ নিয়েছে। কোনো ঋণ পরিশোধ করেনি। খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত করার যোগ্য ঋণকেও তাদের চাপের মুখে কোনো ব্যাংক খেলাপি হিসাবে শনাক্ত করেনি। কিন্তু রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর গ্রুপটির ঋণ খেলাপি হতে থাকে। কারণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিধি অনুযায়ী জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে নেওয়া ঋণকে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক সরাসরি মন্দ হিসাবে খেলাপি করতে পারে। পাশাপাশি তদন্তে নতুন নতুন বেনামি ঋণের তথ্য উদ্ঘাটন হতে থাকে। ফলে সিআইবির তথ্যে গ্রুপটির খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৯ হাজার কোটি টাকায়। কিন্তু বিএফআইইউ বেক্সিমকো গ্রুপের বিষয়ে আরও বিশদ তদন্ত করে। সেখানে বেনামি ঋণের আরও তথ্য উদ্ঘাটন হওয়ায় এবং সেগুলো খেলাপি করায় বেক্সিমকো গ্রুপের নামে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় ৫৩ হাজার কোটি টাকায়। যা এখন পর্যন্ত গ্রুপভিত্তিক ঋণখেলাপিদের মধ্যে শীর্ষ অবস্থান। ফলে গ্রুপটির খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৪ হাজার কোটি টাকা। ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে সাড়ে ৩ লাখ কোটি টাকায়। মোট ঋণের ১৫ দশমকি ১৫ শতাংশই গ্রুপটির হাতে। ফলে এখন পর্যন্ত নতুন তদন্তে গ্রুপের নামে-বেনামে ঋণের পরিমাণ ৬০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। যা আগে ছিল ৪০ হাজার কোটি টাকা। ঋণের অঙ্ক আরও বাড়তে পারে। এছাড়া বিভিন্ন ব্যাংক থেকে আমদানির নামে ও অফশোর ব্যাংকিং ইউনিট থেকে নেওয়া আরও ঋণের তথ্য উদ্ঘাটনে তদন্ত অব্যাহত রয়েছে। তাদের খেলাপি ঋণ সবচেয়ে বেশি রয়েছে জনতা ব্যাংকে। এরপরেই রয়েছে ইসলামী ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংক ও এবি ব্যাংকে। খেলাপি ঋণের বড় অংশই জালিয়াতির মাধ্যমে নেওয়া। এসব অর্থের বড় অংশই বিদেশে পাচার করে দেওয়া হয়েছে ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহার করে বৈদেশিক বাণিজ্যের মাধ্যমে। প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, ট্রেড বেজ মানি লন্ডারিংয়ের বা আমদানি- রপ্তানি বাণিজ্যের আড়ালে ৮ কোটি ৩০ লাখ পাউন্ড বা বাংলাদেশি মুদ্রায় ১ হাজার ১৩ কোটি টাকা যুক্তরাজ্যে পাচার করা হয়েছে। এসব অর্থের অবস্থান সুনির্দিষ্টভাবে শনাক্ত করা হয়েছে। এখন সেগুলো বেক্সিমকো গ্রুপের নিয়ন্ত্রণ থেকে বাংলাদেশ সরকারের নিয়ন্ত্রণে (দেশে ফিরিয়ে আনা) আনার পদক্ষেপ নেওয়া হবে। তদন্তে যুক্তরাজ্যের রাজধানী লন্ডনে সালমান এফ রহমানের ছেলে আহমেদ সায়ান ফজলুর রহমানের নামে ২টি বিলাসবহুল ফ্ল্যাটের তথ্য সুনির্দিষ্টভাবে শনাক্ত করা হয়েছে। এগুলোর মূল্য ৭৭ লাখ ৫০ হাজার পাউন্ড বা বাংলাদেশি মুদ্রায় ১২৬ কোটি টাকা। এসব ফ্ল্যাটের নিয়ন্ত্রণ সায়ানের কব্জা থেকে বের করে সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।

সালমান এফ রহমানের ভাতিজা আহমেদ শাহরিয়ার রহমানের নামে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে দুটি ব্যাংকে দুটি হিসাবের সন্ধান পাওয়া গেছে। এসব হিসাবে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি ও বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানির লেনদেন করার তথ্যও মিলেছে। এ বিষয়ে যুক্তরাজ্যের কেন্দ্রীয় ব্যাংক দ্য সেন্ট্রাল ব্যাংক অব দ্য ইউনাইটেড আরব আমিরাত (সিবিইউএই) ও এন্টি মানি লন্ডারিং কমিটি অব দুবাই আরও বিশদ তদন্ত করছে। তার নামে থাকা আরআর ট্রেডিং কোম্পানির সন্ধানও পাওয়া গেছে। এই কোম্পানির মাধ্যমে বেক্সিমকো গ্রুপ বাংলাদেশ থেকে পণ্য রপ্তানি করে সেগুলোর অর্থ দেশে না এনে বিদেশে পাচার করেছে। পাশাপাশি ওই কোম্পানি থেকে পণ্য আমদানির এলসি খুলে অর্থ পাঠিয়েও পণ্য দেশে না এনে টাকা পাচার করেছে। এসব বিষয়ে আরও বিশদ তদন্ত হচ্ছে। এর মাধ্যমে শুধু বাংলাদেশ ও সংযুক্ত আরব আমিরাতেই নয়, বিভিন্ন দেশে টাকা পাচার করা হয়েছে। এছাড়া সালমানের ছেলে আহমেদ সায়ান ফজলুর রহমান ও ভাতিজা আহমেদ শাহরিয়ার রহমানের নামে লন্ডনে ও দুবাইয়ে আরও একাধিক কোম্পানি রয়েছে বলে জানা গেছে।

এখন পর্যন্ত বিএফআইইউর তদন্তে যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে বেক্সিমকো গ্রুপের নামে-বেনামে থাকা সম্পদের সন্ধান মিলেছে। এসব সম্পদের অবস্থান, কি অবস্থায় আছে সেগুলো এখন সুনির্দিষ্টভাবে শনাক্ত করার কাজ চলছে। এছাড়া বিভিন্ন দেশে বেক্সিমকো বেনামে ৫টি শেল কোম্পানির সন্ধান পাওয়া গেছে। যেগুলো তারা মালিকানার প্রকৃত পরিচয় গোপন করে প্রতিষ্ঠা করেছেন। এসব বিষয়ে আরও বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করতে বাংলাদেশ বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার সহযোগিতা নিচ্ছে। পাশাপাশি শেল কোম্পানি ও পাচার করা সম্পদের তথ্য উদ্ঘাটনে ওইসব দেশের সঙ্গে মিউচুয়াল লিগ্যাল এসিস্ট্যান্স রিকোয়েস্ট (এমএলএআর) করার জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই জন্য ওইসব দেশের আইন পর্যালোচনা করে নথিপত্র প্রস্তুত করা হয়েছে।

বিএফআইইউর প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, বেক্সিমকো গ্রুপের বিষয়ে দেশের ভেতরে পরিচালিত তদন্তে ৩৭২টি ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে। এগুলোতে জমার স্থিতি ৫৫ কোটি ১৪ লাখ টাকা। একই সঙ্গে বেক্সিমকো গ্রুপের স্বার্থসংশ্লিষ্ট আরও ১৪টি ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে। এগুলোর জমা অর্থের স্থিতি ১৩ কোটি টাকা। গ্রুপের বিভিন্ন কোম্পানির নামে থাকা শেয়ার জব্দ করা হয়েছে ৬ হাজার ৭৪৪ কোটি টাকার। এছাড়া আরও জব্দ করা হয়েছে ১১ কোটি ৯৩ লাখ টাকা মূল্যমানের ১৯ দশমিক ৭০ একর জমি এবং দুটি অ্যাপার্টমেন্ট। সব মিলে গ্রুপের নামে-বেনামে থাকা মোট ৬১ হাজার কোটি টাকার সম্পদ জব্দ, লেনদেন বা হস্তান্তর স্থগিত বা আটক করা হয়েছে।

সূত্র জানায়, বেক্সিমকো গ্রুপ সম্পর্কে বিএফআইইউ নিজস্ব তদন্ত ও গোয়েন্দা সূত্র ব্যবহার করে যেমন তথ্য সংগ্রহ করেছে, তেমনি বিদেশি বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমেও ইতোমধ্যে বেশ কিছু তথ্য সংগ্রহ করেছে। আরও তথ্য সংগ্রহ করার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। এরই মধ্যে বিভিন্ন তদন্তে ওই গ্রুপের নামে যুক্তরাজ্য, আইল অব ম্যান এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতে সম্পত্তির সন্ধান পাওয়া গেছে। এসব দেশে গ্রুপের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে আরও কোম্পানি ব্যাংক হিসাবের খোঁজ পাওয়া গেছে। ওইসব সম্পদ সম্পর্কে তদন্ত চলছে।

সূত্র জানায়, গ্রুপের নামে এলপি গ্যাস আমদানির ক্ষেত্রে বিদেশে টাকা পাচারের তথ্য পাওয়া গেছে। এগুলো নিয়ে আরও বিশদ তদন্ত হচ্ছে। ওষুধ ও তৈরি পোশাক রপ্তানির আয়ের একটি বড় অংশ এখনো দেশে আসেনি। সেখানেও পাচার হয়েছে।

আগের তদন্তে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, বাংলাদেশ থেকে বেক্সিমকো গ্রুপের বিভিন্ন কোম্পানি থেকে দুবাই ও লন্ডনে যে কোম্পানিতে পণ্য রপ্তানি করা হতো তার মালিকানা ছিল সালমান এফ রহমানের ছেলে আহমেদ সায়ান ফজলুর রহমানের নামে। অর্থাৎ পিতা পণ্য রপ্তানি করতেন ছেলের কোম্পানিতে। একই গ্রুপের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কাছে পণ্য রপ্তানির কারণে তারা যোগসাজশ করে পুরো অর্থ দেশে না এনে বিদেশে পাচার করে দিতেন। এখনকার তদন্তে ছেলের কোম্পানিতে পণ্য রপ্তানির পাশাপাশি ভাজিতা আহমেদ শাহরিয়ার রহমানের কোম্পানিতেও পণ্য রপ্তানির তথ্য মিলেছে। ওইসব অর্থও যোগসাজশ করে পুরো অর্থ দেশে না এনে বিদেশে পাচার করে দিতেন। এছাড়া বেক্সিমকো গ্রুপের বেনামি কোম্পানি ৫টি শেল কোম্পানির মাধ্যমে তারা পণ্য আমদানি-রপ্তানির ব্যবসা করতেন। এসব কোম্পানির মাধ্যমেও বিদেশে অর্থ পাচার করেছেন।