Image description
 

স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার পদত্যাগের এক দফা দাবিতে গত বছরের ৪ আগস্ট ফেনীর মহিপালের ছাত্র-জনতার অবস্থান কর্মসূচিতে আওয়ামী সন্ত্রাসীদের গুলিতে প্রথম নিহত হন শহীদ ইশতিয়াক আহমেদ শ্রাবণ। তিন ভাই-বোনের মধ্যে শ্রাবণ ছিলেন সবার বড় এবং মা-বাবার একমাত্র পুত্র সন্তান।

 

ঢাকার রাজপথে অগণিত শিক্ষার্থীর রক্তস্রোত সেদিন প্রতিবাদের ঢেউ তুলেছিল তার কোমল হৃদয়েও। মাকে বললেন, ‘আম্মু, দেশে অবিচার হচ্ছে। প্রতিবাদ না করলে আল্লাহ ক্ষমা করবেন না।’

 

অসহযোগ আন্দোলনের প্রথম দিন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ফেনীর মহিপালে শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থান নিয়ে আন্দোলন করছিল ছাত্র-জনতা। শহীদ ইশতিয়াক আহমেদ শ্রাবণও অন্যদের মতো সেদিন সকালে বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে আন্দোলনে যোগ দেন।

 

জোহরের সময় হলে সড়কেই নামাজের উদ্দেশ্যে দাঁড়িয়ে যান শ্রাবণসহ আন্দোলনরত ছাত্র-জনতা। বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কিছু অসৎ সদস্যের মাধ্যমে তাৎক্ষণিক পৌঁছে যায় সন্ত্রাসী নিজাম হাজারীসহ তার ক্যাডার বাহিনীর কাছে।

 

দেশি-বিদেশি বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই সেখানে গিয়ে নামাজরত ছাত্র-জনতার ওপর হামলা চালায় আওয়ামী সন্ত্রাসীরা। আনুমানিক বেলা ২টার দিকে শিক্ষার্থীদের ওপর নির্মমভাবে গুলি চালায় সন্ত্রাসীরা। এ সময় একটি গুলি এসে লাগে শ্রাবণের বুকে। সেখান থেকে বন্ধুরা তাকে উদ্ধার করে প্রথমে শহরের বারাহীপুরে নিজ বাসায় নিয়ে যায়। পরে ফেনী জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

 

সহযোদ্ধারা জানান, উত্তাল জুলাইতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ ফেনীতেও তীব্র উত্তাপ ছড়াল। ওই আন্দোলনে শ্রাবণ ছিলেন নিয়মিত মুখ। ৪ আগস্ট খুনিদের বারুদ-বুলেটের গর্জনের মুহূর্তে ফেনীর মহিপালে বয়ে যায় রক্তের বন্যা। শ্রাবণের মতো জেলার ১০ শহীদসহ হাজারও ছাত্র-জনতার জীবনের বিনিময়ে পরদিন ৫ আগস্ট রাহুমুক্ত হয় পুরো দেশ।

 

মা ফাতেমা আক্তার শিউলি বলেন, ‘আমার ছেলে বলত, আম্মু এখনই সময় অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলার। আমি বারণ করার পরও সে দেশের জন্য প্রতিদিন আমার একটি ওড়না মাথায় বেঁধে তার নিজের নাম লেখা একটি জার্সি পরে আন্দোলনে চলে যেত। তার বাবাসহ সবাই তাকে বোঝাত, কিন্তু সে সবাইকে বলত, অন্যায়ের প্রতিবাদ না করলে আল্লাহর দরবারে জবাব দিতে হবে।’

 

অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে ফাতেমা আক্তার বলেন, ‘আমার শ্রাবণের বন্ধু মাহফুজ তার লাশ নিয়ে এসেছিল। স্থানীয় মানুষরূপী শয়তানরা তাড়াহুড়ো করে আমার ছেলেকে দাফন করতে নিয়ে যায়। আমি আমার বুকের ধন শ্রাবণকে একটু আদর করতে চেয়েছি, তার মুখটা আরেকটু দেখতে চেয়েছি। কিন্তু তারা সেই সুযোগটুকু আমাকে দেয়নি। আমার ছেলেকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়।’

 

পারিবারিক সূত্র জানায়, ইশতিয়াক আহমেদ শ্রাবণ ২০০৪ সালের ১২ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। ২০২৩ সালে ফেনী সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। উচ্চশিক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির অপেক্ষায় ছিলেন। তার বাবার নাম নেছার আহমেদ। পৈতৃক নিবাস ফুলগাজী উপজেলার আনন্দপুর ইউনিয়নে হলেও বাবা-মায়ের সঙ্গে বসবাস করতেন ফেনী শহরে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শহীদ শ্রাবণ ছিলেন একজন সংগঠক ও ক্রিকেটার। তিনি ন্যাশনাল চিলড্রেনস টাস্ক ফোর্সের (এনসিটিএফ) ফেনী জেলার ২০২১-২২ সালের কমিটির সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এনসিটিএফ থেকে আনুষ্ঠানিক অবসর নেওয়ার পর ইয়েস বাংলাদেশ ফেনী জেলার সক্রিয় সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

 

দাফনের ৩৭ দিন পর ফুলগাজী উপজেলার আনন্দপুর ইউনিয়নের কালীরহাট গ্রামের পারিবারিক কবরস্থান থেকে আদালতের নির্দেশে ময়নাতদন্তের জন্য তোলা হয় শ্রাবণের লাশ। পরে ফেনী জেনারেল হাসপাতাল মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে একই কবরস্থানে পুনরায় লাশ দাফন করা হয়।

 

গত ১৬ আগস্ট শ্রাবণের মা ফাতেমা আক্তার বাদী হয়ে ফেনী মডেল থানায় এ ঘটনায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।