
শতভাগ কাজ না করেই সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে ৮০৫টি উন্নয়ন প্রকল্প। এর মধ্যে কোনোটির অগ্রগতি ২৫ শতাংশেরও কম। পতিত আওয়ামী লীগ সরকার আমলের ২০১৮-১৯ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত ছয়টি অর্থবছরের শেষ করা প্রকল্প পর্যালোচনা করে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। এ ছাড়া গত ফেব্রুয়ারি মাসে বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) থেকে এসংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, যেনতেনভাবে প্রকল্প হাতে নেওয়া, রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রকল্প নেওয়া, সাবেক এমপিদের চাহিদা পূরণে প্রকল্প নেওয়া এবং সম্ভাব্যতা সমীক্ষা না করেই প্রকল্প গ্রহণসহ নানা কারণে এমন দশা বিরাজ করেছিল। এতে করে সময় ও অর্থের অপচয়ের পাশাপাশি এসব প্রকল্পের প্রকৃত উদ্দেশ্য পূরণ হওয়া নিয়ে শঙ্কা রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আইএমইডির সাবেক সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রথম দিকে দেখা যায়, অনেক সময় তড়িঘড়ি করে প্রকল্প নেওয়া হয়। এ ছাড়া সম্ভাব্যতা সমীক্ষাও ঠিকমতো হয় না।
আইএমইডির প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের সংশোধিত এডিপির (আরএডিপি) আওতায় মোট ৩২৫টি প্রকল্প শেষ করার লক্ষ্য ছিল। কিন্তু এসব প্রকল্পের মধ্য থেকে বাস্তবায়ন হয় ২৭৭টি এবং লক্ষ্যের বাইরে থেকে হয় ২৪টি প্রকল্প। সব মিলিয়ে সমাপ্ত প্রকল্পের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩০১। কিন্তু এগুলোর মধ্যে শতভাগ কাজ শেষ না করেই বিভিন্ন পর্যায়ে সমাপ্ত ঘোষণা করা হয় ১২৯টি প্রকল্প। ১৭২টির কাজ শতভাগ শেষ হয়েছে।
পুরো কাজ শেষ না করে সমাপ্ত করা প্রকল্পের মধ্যে কয়েকটি হলো বাংলাদেশ রেলওয়ের রোলিং স্টক অপারেশনের জন্য টেকনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স টু ইমপ্রুভ এনার্জি ইফিসিয়েন্সি প্রকল্প। এটির আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ৫৭.৬৩ শতাংশ এবং বাস্তব অগ্রগতি ৯০ শতাংশ। এ ছাড়া এনহ্যান্সিং ক্যাপাসিটি ইন কটন ভ্যারাইটিস ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের আর্থিক ৮৭ শতাংশ, বাস্তব অগ্রগতি ছিল ৮৮ শতাংশ। জোনস অ্যান্ড ট্রান্সবাউন্ডারি এনিম্যাল ডিজিজ প্রিভেনশন অ্যান্ড কন্ট্রোল রিসার্চ প্রজেক্টটির আর্থিক এবং বাস্তব অগ্রগতি ছিল ২৫ শতাংশ। জয়িতা টাওয়ার নির্মাণ প্রকল্পের আর্থিক ৭৪ এবং বাস্তব অগ্রগতি ৮০ শতাংশ। ন্যাশনাল ওকুপেশনার হেলথ অ্যান্ড সেফটি ট্রেনিং অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট প্রকল্পের আর্থিক ৪২ এবং বাস্তব অগ্রগতি ছিল ৪৫ শতাংশ। আরো আছে, এস্টাবলিশমেন্ট অব ২৫ বেড পিস শেল্টার ইন এইট গভর্নমেন্ট চিলড্রেনস ফ্যামিলিজ প্রকল্পের আর্থিক ১৯ এবং বাস্তব অগ্রগতি ছিল ২০ শতাংশ এবং এস্টাবলিশমেন্ট অব সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার বিল্ডিং প্রকল্পের আর্থিক ৬৮ এবং বাস্তব অগ্রগতি ছিল ৭০ শতাংশ। এ অবস্থায়ই প্রকল্পগুলো সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়েছিল।
আইএমইডি জানায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে শতভাগ কাজ না করেই সমাপ্ত ঘোষণা করা হয় ১১৭টি উন্নয়ন প্রকল্প। শুধু তা-ই নয়, এগুলোর মধ্যে কোনোটির আর্থিক ও বাস্তব অগ্রগতি ৩০ শতাংশের নিচে ছিল। ওই অর্থবছরের এ রকম কয়েকটি প্রকল্প হলো ‘ডেমোস্ট্রেশন অব বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট অ্যাকটিভিটিস’ প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি ৩৪ ও বাস্তব অগ্রগতি ছিল ৪০ শতাংশ। ওই অর্থবছরে মোট ৩৭৭টি প্রকল্প শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা ছিল। ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত শেষ হয়েছে ২৬৪টি প্রকল্প। এ ছাড়া সমাপ্ত করার জন্য নির্ধারিত না থাকলেও ওই সময়ের মধ্যে শেষ করা হয়েছে ১৩টি প্রকল্প। সব মিলিয়ে মোট সমাপ্ত প্রকল্পের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৭৭টি। কিন্তু এগুলোর মধ্যে শতভাগ কাজ শেষ হয়েছে ১৬০টির।
একইভাবে ২০২১-২২ অর্থবছরে শতভাগ কাজ শেষ না করেই সমাপ্ত করা হয়েছে ১৮৬টি প্রকল্প। শুধু তা-ই নয়, এগুলোর কোনোটির আর্থিক ও বাস্তব অগ্রগতি ছিল সাড়ে ৩ শতাংশ পর্যন্ত। ওই অর্থবছরে মোট বাস্তবায়ন হয় ৩৩৬টি প্রকল্প। ২০২০-২১ অর্থবছরে কাজ বাকি রেখেই সমাপ্ত ঘোষিত প্রকল্পের সংখ্যা ছিল ১২৪টি। ওই অর্থবছরে মোট বাস্তবায়ন হয় ২৬৪টি। এর মধ্যে শতভাগ কাজ শেষ করেই সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়েছিল ১৪০টি প্রকল্প। ২০১৯-২০ অর্থবছরে শতভাগ কাজ শেষ না করেই সমাপ্ত ঘোষণা করা হয় ৯২টি প্রকল্প। সে সময় মোট বাস্তবায়ন হয়েছিল ১৮২টি। এর মধ্যে শতভাগ কাজ সম্পন্ন হওয়া প্রকল্প ছিল ৯০টি। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে কাজ অসমাপ্ত রেখে সমাপ্ত করা হয় ১৫৭টি প্রকল্পের। ওই অর্থবছরে মোট বাস্তবায়ন করা হয় ৩১২টি প্রকল্প। এর মধ্যে শতভাগ করা হয়েছিল ১৫৫টির।
ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তফা কে মুজেরী বলেন, এভাবে ২০ থেকে ৩০ বা ৮০ ভাগ কাজ করেই প্রকল্প সমাপ্ত করার মানে কী? এটি খতিয়ে দেখতে হবে। এর কারণ হতে পারে প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রেই ত্রুটি ছিল। এ ক্ষেত্রে জবাবদিহি নিশ্চিত করা দরকার। তিনি আরো বলেন, এসব প্রকল্পের পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে কি না সেটি অবশ্যই দেখতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা দরকার।