Image description
গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব, সিস্টেম লস কমানোর পরামর্শ

নিরবচ্ছিন্ন গ্যাসের অভাবে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ উৎপাদন কমায় দুরবস্থার মধ্যে পড়েছে শিল্পকারখানা। নতুন করে গ্যাসের ট্যারিফ বৃদ্ধির প্রস্তাব ব্যবসায়ীদের একটি অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। এতে কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছে। ফলে আতঙ্কিত শিল্প মালিক ও ব্যবসায়ীরা গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব বাতিলের দাবি জানিয়ে সরবরাহ কোম্পানিগুলোর দক্ষতা বাড়ানো এবং সিস্টেম লস কমিয়ে আনার পরামর্শ দিয়েছেন। জানা গেছে, প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি পূরণে বিদ্যমান গ্রাহকদের দর অপরিবর্তিত রেখে নতুন ও প্রতিশ্রুত গ্রাহকদের জন্য গাসের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিচ্ছে বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা)। প্রতিশ্রুত গ্রাহকদের (ইতোমধ্যে অনুমোদিত) গ্যাসের অর্ধেক বিল বিদ্যমান দরে (৩০ টাকা), বাকি অর্ধেক ৭৫.৭২ টাকা, নতুন শিল্প ও ক্যাপটিভে গ্যাসের দাম যথাক্রমে ৩০ ও ৩১.৭৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭৫.৭২ টাকা করার প্রস্তাব করেছে। পাশাপাশি বিদ্যমান শিল্পে অনুমোদনের বেশি গ্যাস ব্যবহার করলে বাড়তি গ্যাস ৭৫.৭২ টাকা নির্ধারণ করার প্রস্তাব করেছে পেট্রোবাংলা। এ বিষয়ে ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরকার যেখানে জনগণের উন্নয়ন ও কল্যাণের জন্য কাজ করার কথা সেখানে গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি করে বেসরকারি উদ্যোগকে রুখে দিলে জনগণের জন্য ন্যূনতম চাহিদা পূরণ করে বেঁচে থাকা কষ্টসাধ্য হবে। কারণ ৯০ শতাংশ কর্মসংস্থানকারী বেসরকারি খাত ক্ষতিগ্রস্ত হলে কর্মসংস্থানও বাধাগ্রস্ত হবে। শিল্প প্রবৃদ্ধি বর্তমানে নেগেটিভ এবং দিন দিন শিল্পপ্রতিষ্ঠান রুগ্ণ হচ্ছে। নতুন করে অন্যায্যভাবে শিল্প ও ক্যাপটিভ শ্রেণির নতুন সংযোগ ও বর্তমান সংযোগের লোড বৃদ্ধির ক্ষেত্রে গ্যাসের ট্যারিফ/মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাব কোনোভাবেই দেশের উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতার পক্ষে নয়। শিল্প খাত টিকে থাকা, ভবিষ্যৎ বিকাশ, শিল্প ও ব্যবসা ক্ষেত্রে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ এবং সামগ্রিক কর্মসংস্থান টিকিয়ে রাখা এবং বৃদ্ধি মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়বে।

তারা বলেছেন, গ্যাস সরবরাহ কোম্পানিগুলোর দক্ষতা বাড়িয়ে ও অপচয় কমিয়ে বিশেষ করে তিতাস গ্যাসের বিপুল পরিমাণ সিস্টেম লস (১৩.৫৩ শতাংশ) ন্যূনতম পর্যায়ে নামিয়ে গ্যাস সরবরাহ বাড়ানো দরকার। বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিকল্প জ্বালানি বিশেষ করে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রসমূহ পূর্ণ সক্ষমতায় চালানো উচিত। তা ছাড়াও এলএনজি আমদানিতে দ্বৈত ভ্যাট ও উৎসে কর প্রত্যাহার, সরবরাহে আরোপিত ট্যাক্স ও পেট্রোবাংলা/ বিইআরসির বিভিন্ন চার্জ কমিয়ে গ্যাসের মূল্য কমানো এবং সরকারের ভর্তুকি কমানো সম্ভব। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের একপেশে সিদ্ধান্তের পরও নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস না পাওয়ায় প্রতিটি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের উৎপাদন ৩০-৪০ শতাংশ কমেছে। বিশেষ করে গাজীপুর, আশুলিয়া, সাভার, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, ভালুকা ও নরসিংদী অঞ্চলে প্রায় সব ধরনের শিল্প বিদ্যমান। এসব শিল্প চাহিদা অনুযায়ী গ্যাসের সরবরাহ পাচ্ছে না এবং গ্যাসের চাপ খুব কম। সিরামিক ও স্টিল শিল্পের উৎপাদন কমেছে ৫০ শতাংশ। নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস না পাওয়ায় শিল্পে দুরবস্থা তৈরি হয়েছে। আগে শিল্পে জ্বালানি খরচ ৫-৬ শতাংশ হলেও ২০২৩ সালের অস্বভাবিক মূল্য বৃদ্ধির পর থেকে ১০-১৫ শতাংশ লাগছে। ঋণের ৯ শতাংশ সুদ এখন ১৬ শতাংশ। ২০২২ সালে প্রতি গজ কাপড় উৎপাদনের জ্বালানি খরচ ছিল ১৮ টাকা, ২০২৩ সালে নতুন মূল্যে খরচ পড়ছে ২৬ টাকা।

আবার নিট ইন্ডাস্ট্রির সুতা উৎপাদনে খরচ পড়ে ২.৪৫ ডলার প্রতি কেজি আর সেখানে পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে নিট কাপড় আমদানি করতে খরচ পড়ে ২.১৮ ডলার প্রতি কেজি। ফলে ২০২৪ সালে নিট সেক্টরে কাপড় আমদানি ৩৯ শতাংশ বেড়েছিল। এসব কারণে শিল্প বাঁচানোই এখন চ্যালেঞ্জিং মনে করছেন মালিকরা। ফলে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে শিল্পের জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে দাঁড়িয়েছে ৩.৫৭ শতাংশে। বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি গত বছরের ডিসেম্বরে নেমেছে ৭.২৮ শতাংশে। সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ ছয় মাসে ৭১ শতাংশ কমেছে। জিডিপিতে শিল্পের অবদান ২০২৪ সালে নেমেছে ৮.৭৭ শতাংশে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বরে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির ঋণপত্র খোলা কমেছে ২৬ শতাংশ। গত বছর এসএমই খাতের উৎপাদন কমেছে ৫.০৯ শতাংশ। বিবিএসের তথ্যমতে, গত বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে বেকারত্ব ৪.৪৪ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৬.৬ লাখে। এ বিষয়ে বিটিএমএ সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেন, গ্যাসের ট্যারিফ বৃদ্ধির প্রস্তাব শিল্প ও ব্যবসাসংশ্লিষ্ট সবাইকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য বর্তমানে উৎপাদন ধরে রাখা এবং নতুন শিল্প ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বৃদ্ধির উদ্যোগ দরকার। সেখানে নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠান যেন গড়ে না ওঠে এবং বর্তমান শিল্প যেন আর না চলতে পারে এরূপ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।