Image description

রাজধানীর গুলিস্তান। প্রধান সড়ক থেকে গলির রাস্তা সর্বত্রই দোকান। কোথাও জুতা-স্যান্ডেল, কোথাও জামা-কাপড়, কসমেটিক্‌সসহ বিভিন্ন পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছেন ব্যবসায়ীরা। এমন অবস্থা দেখে বোঝার উপায় নেই রাস্তা না বাজার। গণ-অভ্যুত্থানের পর একটি পক্ষ বিদায় নিলেও বর্তমানে নিজেদের ক্ষমতাসীন জাহির করে এই সব দোকান থেকে লাখ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করছে আরেকটি চক্র। আর এই চাঁদার টাকা না দিলে চলে নির্যাতন। রাজধানীর গুলিস্তান, বঙ্গবন্ধু এভিনিউ, জিপিও, পল্টনসহ আশপাশের এলাকা ঘুরে এ তথ্য পাওয়া গেছে। 

সরজমিনে গুলিস্তান এলাকায় দেখা গেছে, জিরো পয়েন্ট থেকে শুরু করে বায়তুল মোকাররমের সামনে হয়ে চলে যাওয়া বঙ্গবন্ধু এভিনিউ সড়ক ও পীর ইয়েমেনী মার্কেটের সামনে হয়ে যাওয়া বঙ্গবন্ধু সড়কের দুই পাশের ফুটপাথের পুরোটা জুড়েই বিভিন্ন জামা-কাপড়ের দোকান বসানো হয়েছে। জিরো পয়েন্ট থেকে গোলাপ শাহ্‌ মাজার হয়ে তাঁতী বাজারের দিকে যেতেই রাস্তার দুই পাশ দখল করে বসেছে শত শত ভ্রাম্যমাণ দোকান। টি-শার্ট, প্যান্ট, শার্ট, বাচ্চাদের জামা-কাপড়সহ নানা ধরনের পোশাক নিয়ে বসেছেন দোকানিরা। ফুটপাথ দখল করে এসব দোকানগুলোতে ক্রেতার ভিড়ে ছোট-বড় যানবাহনতো দূরের কথা পায়ে হেটে পথ চলাও দায়। এই রাস্তার মাথায় গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারের নিচের অংশেও বসানো হয়েছে সারি সারি জুতার দোকান।

এদিকে জিপিও’র সামনে হয়ে বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেট দিয়ে গুলিস্তান বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশ দিয়েও রয়েছে বিভিন্ন পণ্যের দোকান। গুলিস্তান বাসস্ট্যান্ড থেকে পাতাল মার্কেটের পাশ দিয়ে বঙ্গবন্ধু চত্বরের দিকে যেতে ফুটপাথের ওপর ছাউনি দিয়ে দুই পাশ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে দোকান। মানুষ চলাচলের ফুটপাথে তৈরি হওয়া এসব অস্থায়ী দোকান বছরের পর বছর ধরে রূপ নিয়েছে স্থায়ী দোকানে। এসব দোকানের মাঝ দিয়ে পা ফেলাতো দূরের কথা, মাথা সোজা করে হেঁটে যাওয়াও দুষ্কর। আর বঙ্গবন্ধু চত্বরের পেছন থেকে শুরু করে গোলাপ শাহ্‌ মাজার পর্যন্ত গুলিস্তান শপিং কমপ্লেক্সের সামনের মূল রাস্তা দখল করে বসানো হয়েছে একাধিক ভ্রাম্যমাণ দোকান। এ সবের মধ্যে জুতা-স্যান্ডেল ও বাচ্চাদের জামা-কাপড়ই বেশি। সকালে ফাঁকা রাস্তাটি দিয়ে সহজেই গাড়ি চলাচল করলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভাসমান দোকানে পুরো রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। বেলা ১১/১২টার দিকে গেলে মনে হবে, কোনো বাজারের মধ্যে যানবাহন ঢুকে পড়েছে। দুপুরের পর ওই রাস্তা দিয়ে দোকানের ভিড়ে সাধারণ মানুষও হেঁটে চলতে পারে না। ফুলবাড়িয়া মার্কেটের সামনে দিয়ে ফ্লাইওভারের নিচের রাস্তার ওপর বসানো হয়েছে হকারি দোকান। সাদা চোখে দেখে মনে হবে, খালি জায়গা পেয়ে নিম্ন আয়ের মানুষ দোকান নিয়ে বসেছে। কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন। মনোয়ার হোসেন নামে এক ব্যবসায়ী বলেন, এই সব দোকান ও দোকানের জায়গা আগে থেকে নির্ধারিত। প্রতি ৫০ ইঞ্চি জায়গা নিয়ে একটা ভিটি বা ভ্যানগাড়ির দোকান নির্ধারণ করা হয়। কে কোথায় বসবে, কার সামনে বসবে সবই আগে থেকে ঠিক করা থাকে।

তিনি বলেন, এসব দোকান পেতে বছরে এককালীন ৭০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত দিতে হয়। দোকান পাওয়ার পর দিনপ্রতি দিতে হয় ৩০ থেকে ১০০ টাকা চাঁদা। আবার কেউ কেউ বছর চুক্তিতে না নিয়ে দিন চুক্তিতেও দোকান নেয়। দিনপ্রতি ২শ’ থেকে ৪শ’ টাকা দিয়ে দোকান নিয়ে বসে। যেদিন বসবে না আগে থেকে বলে দিতে হয়। তখন অন্য দোকানি সেখানে বসে। সোজা কথায় এই ভিটের জায়গায় যে দোকান বসাবে তাকেই টাকা দিতে হবে। টাকা না দিয়ে কেউ ব্যবসা করতে পারবে না। তিনি বলেন, এই গুলিস্তান এলাকায় এপাশ-ওপাশ দিয়ে ৩ থেকে ৪ হাজার ভিটি আছে। যা থেকে প্রতিদিনই কয়েক লাখ টাকা চাঁদা উঠানো হয়। বায়তুল মোকাররম থেকে ঢাকা ট্রেড সেন্টার পর্যন্ত হাজার হাজার দোকান। এইসব দোকানে ৫০ হাজার টাকা এডভান্স ও মাসে ১৫ হাজার টাকা ভাড়া দিতে হয় বলে জানান তিনি। 
রিপন আহম্মেদ নামে এক ব্যবসায়ী বলেন, ৫ই আগস্টের আগে এই জিপিও’র দক্ষিণ পাশের ফুটপাথে চাঁদা তুলতো লাইনম্যান সালাম, পীর ইয়েমেনী মার্কেট থেকে গোলাপ শাহ্‌ মসজিদের দুই পাশের ফুটের টাকা নিতো তসলিম, গোলাপ শাহ্‌ মসজিদ থেকে শুরু করে নগরভবন হয়ে টিএন্ডটির দক্ষিণ পর্যন্ত ফুটের চাঁদা শাহিন, সেলিম ও রাসুকে দিয়ে নিতো আমীর, ঢাকা ট্রেড সেন্টারের পশ্চিম পাশ হয়ে হানিফ ফ্লাইওভার পর্যন্ত ফুটপাথে চাঁদা নিতো বিমল, হান্নান এবং মিন্টু। আর হানিফ ফ্লাইওভারের নিচে জুতাপট্টিতে চাঁদা তুলতো সালেক, রজ্জব ও বাবুল, বায়তুল মোকাররম দক্ষিণ গেট থেকে মোটকা খলিল, পশ্চিম পাশে কোটন ওরফে ফুট কোটন এবং স্বর্ণ মার্কেটের সামনে চাঁদা তুলতো হারুন। বায়তুল মোকাররমের উত্তর পাশের ফুটপাথে চাঁদাবাজি করতো রহিম, কালা নূরু। আর বায়তুল মোকাররমের পূর্ব পাশের গেট থেকে ভিআইপি রোড পর্যন্ত বিশাল ফুটপাথ নিয়ন্ত্রণ করতো দুলাল, তার ছেলে শুভ এবং ছোট ভাই শরীফ। সরকার পতনের পর তারা সবাই পলাতক। কিছুদিন চাঁদা আদায় বন্ধ থাকার পর এখন বিএনপি’র বিভিন্ন বড় বড় নেতাদের নাম ভাঙিয়ে চাঁদা তোলা হচ্ছে। দিনপ্রতি ৩০ টাকা থেকে ৩শ’/৪শ’ টাকা পর্যন্ত চাঁদা ওঠানো হয়। তিনি বলেন, এই গুলিস্তান বিশাল এলাকা। তাই এই পুরো এলাকাকে কয়েকভাগে ভাগ করে চাঁদা আদায় করা হয়।

বর্তমানে ইউনিট বিএনপি ও যুবদলের সদস্য পরিচয়ে গুলিস্থানের জাতীয় স্টেডিয়াম, ভাসানী স্টেডিয়াম, আউটার স্টেডিয়াম এলাকার দোকানগুলো নিয়ন্ত্রণ করছেন এসএম আব্বাস ও চাঁদাবাজির অভিযোগে সদ্য বিএনপি থেকে বহিষ্কার হওয়া মিজানুর রহমান টিপু। আর বায়তুল মোকাররম দক্ষিণ গেট থেকে শুরু করে উৎসব কাউন্টার হয়ে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের নিচের বন্ধন কাউন্টার পর্যন্ত এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছেন স্বেচ্ছাসেবক দলের মনা বা মনু ভাই ও মিজানুর রহমান টিপু। গুলিস্তান নাট্যমঞ্চ ও ফলপট্টি নিয়ন্ত্রণ করা হয় যুবদলের নামে। বায়তুল মোকাররম দক্ষিণ গেটের ফুটপাথের ২শ’ দোকানের চাঁদা নেন কাদের ও খোখন। মোবাইলের চোরাই মার্কেট থেকে আউটার স্টেডিয়ামের পশ্চিম পাশ পর্যন্তও তারাই নিয়ন্ত্রণ করেন। মুক্তাঙ্গন, পল্টন মোড়, বায়তুল মোকাররমের লিংক রোড থেকে চাঁদা নেন যুবদলের জিয়া, তৌহিদ ও কামাল। তাদের পেছনে রয়েছে দক্ষিণ শ্রমিক দলের সদস্য সচিব বদরুল আলম সবুজ। 
সাইফুল, মো. আজিজ, শরিফসহ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন দোকানি বলেন, সরকার পতনের আগে চাঁদা দিতে একরকম বাধ্য করা হতো। খাই না খাই দিনপ্রতি চাঁদা দেয়া লাগতো। গণ-অভ্যুত্থানের পর আমরা স্বপ্ন দেখেছিলাম যে, আর কাউকে চাঁদা দিতে হবে না। আমরা যা আয় করবো তা আমাদেরই থাকবে। কিন্তু সেই সুখ আমরা বেশি দিন ভোগ করতে পারিনি। এখন আরেক পক্ষ প্রভাব খাটিয়ে আমাদের থেকে চাঁদা নেয়। আর চাঁদার টাকা না দিলে নির্যাতন চলে। উচ্ছেদের কথা বলে তারা নিজেরাই দোকান ভেঙে দেয় আমাদের। চাঁদার ভাগ খেয়ে প্রশাসনও চুপ থাকে। কেউ কিচ্ছু বলে না তাদের। যা খুশি তাই করছে। তাই বাধ্য হয়ে আমাদের চাঁদার টাকা দিতে হয়, মিছিল-মিটিংএ যেতে হয়। 

এসব রাস্তা দখল করে দোকান বসানোর বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা (উপ-সচিব) কাইজার মোহম্মদ ফারাবী বলেন, ফুটপাথ দখল করে এইসব হকার বসানোর পেছনে অনেক রাজনৈতিক নেতা অনেক সময় কাজ করেন। এজন্য আমরা আইন প্রয়োগ করেও লাভ হয় না। আমরা উচ্ছেদ অভিযান চালানোর পরই তারা আবারও ফিরে আসেন। তাই এই বিষয়ে রাজনৈতিক নেতাদেরই ভূমিকা নেয়া প্রয়োজন।
এদিকে বিএনপি’র পক্ষ থেকে বলা হয়েছে- বিএনপি’তে চাঁদাবাজের কোনো জায়গা নেই। দলের ভেতরে যাদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ পাওয়া যাবে তাদের বিরুদ্ধে দলের শৃঙ্খলা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।