
স্থলভাগে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে নিয়োজিত আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানির (আইওসি) কাছ থেকে উৎপাদন বণ্টন চুক্তিতে (পিএসসি) কেনা গ্যাসের দাম বাড়ানো হচ্ছে। এরই মধ্যে স্থলভাগের পিএসসি করতে নিয়োগ দেওয়া আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান সংশোধিত খসড়া পিএসসি পেট্রোবাংলার কাছে জমা দিয়েছে। খসড়ার ওপর মতামত দিতে গত রোববার পেট্রোবাংলা, বাপেক্সসহ বিভিন্ন পর্যায়ের বিশেষজ্ঞরা বৈঠক করেছেন। বিশেষজ্ঞ মতামত অন্তর্ভুক্ত করে খসড়া চূড়ান্ত করতে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান দুই সপ্তাহ সময় চেয়েছে। পার্বত্য অঞ্চলের দুটি ব্লককে লক্ষ্য করে স্থলভাগের পিএসসি সংশোধন করা হচ্ছে। পেট্রোবাংলার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান, পরামর্শক প্রতিষ্ঠান সংশোধিত খসড়া চূড়ান্ত করে জমা দেওয়ার পর অনুমোদনের জন্য জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগে পাঠানো হবে। পরে সেখান থেকে আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। সেখানে যাচাই-বাছাই শেষে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরে যাবে। প্রধান উপদেষ্টার অনুমোদনের পর উপদেষ্টা পরিষদে প্রস্তাব আকারে উত্থাপন করা হবে। উপদেষ্টা পরিষদের অনুমোদনের পর স্থলভাগে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হবে।
পেট্রোবাংলার পরিচালক (প্রশাসন) ও অতিরিক্ত দায়িত্ব (অপারেশন অ্যান্ড মাইন্স) মো. আলতাফ হোসেন কালবেলাকে বলেন, ‘পরামর্শক প্রতিষ্ঠান সংশোধিত খসড়া জমা দিয়েছে। এতে গ্যাসের দামের ক্ষেত্রে তিনটি অপশন দিয়েছে। গ্যাসের দাম নয়-সাড়ে নয় ডলার দিয়েছিল। সেটা নিয়ে আমাদের বিশেষজ্ঞরা মতামত দিয়েছেন। তারা আরও দুই সপ্তাহ সময় চেয়েছেন, আমাদের দেওয়া মতামত ইনপুট দিয়ে চূড়ান্ত করতে।’
পেট্রোবাংলার সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যুক্তরাজ্যভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান উড ম্যাকেঞ্জি খসড়া পিএসসিতে প্রতি হাজার ঘনফুট গ্যাসের দাম নয় থেকে সাড়ে নয় ডলার রাখার প্রস্তাব করেছে। গত রোববারের বৈঠকে পেট্রোবাংলা, বাপেক্সসহ বিভিন্ন পর্যায়ের বিশেষজ্ঞরা এই দাম আট ডলার রাখার প্রস্তাব করে।
এক কর্মকর্তা জানান, গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান করা পিএসসিতে গ্যাসের দাম কম বলে আপত্তি জানিয়েছে কয়েকটি কোম্পানি। এই অভিজ্ঞতা থেকে স্থলভাগের পিএসসিতে গ্যাসের দাম আর্কষণীয় করা হচ্ছে, যাতে দরপত্রে আইওসিগুলো অংশ নেয়।
বর্তমানে স্থলভাগে কাজ করা দুটি আইওসির একটি শেভরন থেকে প্রতি হাজার ঘনফুট গ্যাস কেনা হয় দুই দশমিক ৭৬ ডলার, আরেক কোম্পানি তাল্লোর কাছ থেকে কেনা হয় দুই দশমিক ৩১ ডলারে। বহুজাতিক কোম্পানি ছাড়া রাষ্ট্রীয় ৩টি কোম্পানির কাছ থেকে গ্যাস কেনে পেট্রোবাংলা। সিলেট গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি ও বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড কোম্পানিকে প্রতি হাজার ঘনফুটের দাম দেওয়া হয় ২৮ টাকার মতো, যা ডলারের হিসেবে মাত্র ২৫ সেন্ট। আর বাপেক্সকে দেওয়া হয় ১১২ টাকার মতো, যা ১ ডলারের কাছাকাছি। অন্যদিকে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ৭ মাসে কাতার থেকে আমদানি করা প্রতি হাজার ঘনফুট এলএনজির দাম পড়ে ১০ দশমিক ৬৬ ডলার এবং ওমান থেকে আনা এলএনজির দাম পড়ে ১০ দশমিক শূন্য ৯ ডলার।
জানা গেছে, খসড়া পিএসসিতে গ্যাসের দাম নির্ধারণে তিন ধরনের ফর্মুলা উপস্থাপন করা হয়। এতে ব্রেন্ট ক্রুড অয়েলের দামের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখার প্রস্তাব করা হয়। অর্থাৎ ব্রেন্ট ক্রুডের দাম বাড়লে গ্যাসের দাম বাড়বে, আর কমলে দাম কমে আসবে। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান দাম ক্রুডের মূল্যের ৯ শতাংশ করার প্রস্তাব দিলেও যৌথ সভায় ক্যাপিং করে দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা হয়। অর্থাৎ ক্রুডের দাম অনেক বেড়ে গেলেও গ্যাসের দাম ৮ ডলারের বেশি হবে না।
এ ছাড়া খসড়া পিএসসিতে বাপেক্সের শেয়ার ১০ শতাংশ রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। বাপেক্স আগে কোনো বিনিয়োগ করবে না। গ্যাস পাওয়া গেলে তখন তারা ১০ শতাংশ মূলধন বিনিয়োগ করবে। অর্থাৎ বাপেক্সের কোনো ঝুঁকি থাকছে না। গ্যাস পেলে মূলধন বিনিয়োগ করে মুনাফার ভাগ পাবে তারা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, স্থলভাগের পিএসসি করা হচ্ছে পার্বত্য এলাকার ব্লক ২২(এ) ও ২২(বি)-কে লক্ষ্য করে। যেহেতু পার্বত্য চট্টগ্রামের পর্যাপ্ত তথ্য নেই, তেল-গ্যাস উত্তোলন করা কঠিন, রাস্তা তৈরি করা, গ্যাস পেলে পাইপলাইনের নির্মাণ ব্যয়বহুল। তাই স্থলভাগের অতীতের পিএসসির তুলনায় দাম অনেকটা বাড়িয়ে ধরা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
দেশের স্থলভাগের বিভিন্ন অংশে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম চালানো হয়। বর্তমানে দেশীয় গ্যাস উৎপাদনের শতভাগ আসে স্থলভাগের বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে। কিন্তু কখনো পার্বত্য অঞ্চলে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে কার্যক্রম চালানো হয়নি। এবারই প্রথমবারের মতো পার্বত্য অঞ্চলে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে কার্যক্রম শুরু করা হবে। এজন্য পার্বত্য অঞ্চলের দুটি ব্লকে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ধারণাগতভাবে এই ব্লকে তেল-গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। ব্লক-২২-এর অন্তর্ভুক্ত পার্বত্য অঞ্চলে রয়েছে বান্দরবান, থানচি, রুমা, আলীকদম, চকরিয়া, আনোয়ারা, কাপ্তাই এলাকা।
বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলে ১৯১৪ সালে প্রথম কূপ খনন (সীতাকুণ্ড) করে বার্মা (মিয়ানমার) অয়েল কোম্পানি। এরপর ১৯২২ সালে পাথারিয়ায় কূপ খনন করা হয়। এরপর প্রায় ১২টি কূপ খনন করা হয়েছে। সর্বশেষ কূপ খনন করা হয় হালদায়, ১৯৯৮ সালে। এর মধ্যে সেমুতাং ১, ২, ৩ ও ৪ নম্বর ব্লকে গ্যাস পেলেও বাণিজ্যিকভাবে উত্তোলনযোগ্য নয় বলে জানানো হয়। আর কোনো কূপে সামান্য মজুত আবার হালদা, সেমুতাং-৫ পটিয়ায় গ্যাসের আলামত পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া সেমুতাং-৪ কূপের রিপোর্টে কেয়ার্ন এনার্জি বলেছে, রিজার্ভ খুবই কম, পাইপলাইনের বিনিয়োগ ব্যয়বহুল হবে। বিনিয়োগ তুলে আনা কষ্টকর হবে। কূপ এলাকায় ৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র করা যেতে পারে।
স্থলভাগে মোট ২২টি ব্লক রয়েছে। এর মধ্যে ১১টিতে এখনো কোনো ধরনের অনুসন্ধান কার্যক্রম চালানো হয়নি। খালি থাকা ব্লকগুলো হচ্ছে ১, ২এ, ২বি, ৩এ, ৪এ, ৪বি, ৫, ৬এ, ২২এ, ২২বি ও ২৩ নম্বর। দেশের স্থলভাগে প্রথম পিএসসি করা হয় ১৯৯১ সালে। এর অধীনে শেভরন বিবিয়ানা, জালালাবাদ ও মৌলভীবাজার গ্যাসক্ষেত্রের কাজ পায়। পরে ১৯৯৭ সালে সংশোধিত পিএসসির অধীনে কুমিল্লার বাঙ্গুরায় কাজ পায় কানাডিয়ান কোম্পানি তাল্লো। এই কোম্পানিকে টেংরাটিলা গ্যাসক্ষেত্রের কাজ দেওয়া হয় পিএসসি ছাড়াই।
বর্তমানে দেশের ২২টি গ্যাসক্ষেত্রের ১১৩টি কূপ দিয়ে দৈনিক ১ হাজার ৬১৫ মিলিয়ন ঘনফুট উত্তোলন করা হচ্ছে। গতকাল পেট্রোবাংলার গ্যাস উৎপাদনের চিত্র বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এদিন এসব কূপ থেকে ১ হাজার ৬১৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন হয়েছে। এর সঙ্গে আমদানি করা ১১শ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি যোগ করে জাতীয় গ্রিডে মোট ২ হাজার ৭১৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয়েছে।