Image description

চট্টগ্রাম শহর থেকে আনুমানিক ৪২ কিলোমিটার দূরে ফটিকছড়ি উপজেলার ঐতিহাসিক মাইজভাণ্ডার দরবার শরীফ। উপমহাদেশের তরিকতপন্থী মুসলিমদের আবেগের এ তীর্থস্থানে রমজানে প্রতিদিন হাজার, হাজার মানুষের সমাগম হয়। কে মুসলিম, কে হিন্দু; কে বৌদ্ধ, কে খ্রিস্টান- নেই কোনো ভেদাভেদ। প্রতিদিন সন্ধ্যায় ইফতারে তারা এক কাতারে শামিল হোন।

শত বছরের ধারাবাহিকতায় সৌহার্দ্য আর সম্প্রীতির এমন এক অনন্য নিদর্শন স্থাপিত হয়েছে মাইজভাণ্ডার দরবার শরিফে।

মাইজভাণ্ডার দরবার শরিফে প্রতিবছরই আয়োজন করা হয় উন্মুক্ত ইফতারের। একইভাবে আয়োজন করা হয় উন্মুক্ত সেহেরিরও। আর সেখানেই দরবারের ভক্ত আশেকান, গরিব-দুঃস্থ, নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী মানুষ, ভিক্ষুক থেকে বিত্তবান- এমন হাজারো মানুষ সমবেত হন। সাতাশ রমজানে দরবারে বড় আয়োজন করা হয়, যাতে প্রায় লাখো মানুষের সমাগম ঘটে।

জানা গেছে, আঠারো শতকের মধ্যভাগে ইসলামের আধ্যাত্মিক সাধক শাহসুফী সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী ফটিকছড়িতে অবস্থান করে একটি অধ্যাত্ম তরিকা প্রচারের সূচনা করেন, যেটি ‘মাইজভাণ্ডার তরিকা’ হিসেবে পরিচিতি পায়। তার বাসগৃহ ঘিরেই গড়ে ওঠে মাইজভাণ্ডার দরবার শরীফ। ১৯০৬ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

রমজানজুড়ে প্রতিদিনই এভাবে ইফতারের থালা সাজানো হয়। ছবি: সারাবাংলা

রমজানজুড়ে প্রতিদিনই এভাবে ইফতারের থালা সাজানো হয়। ছবি: সারাবাংলা

সারাদেশে মাইজভাণ্ডার দরবার শরিফের দশ লাখের বেশি অনুসারী আছেন। উপমহাদেশেও আছে লাখ, লাখ ভক্ত-আশেকান। সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারীর দরবার এখানে মূল মঞ্জিল। তার বংশধরদের মধ্যে অধ্যাত্ম সাধনায় যারা নিবেদিত হয়েছিলেন, সৈয়দ গোলামুর রহমান মাইজভাণ্ডারী, সৈয়দ দেলোয়ার হোসেন মাইজভাণ্ডারী, সৈয়দ মোহাম্মদ হাসান মাইজভাণ্ডারী, সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারীসহ আরও কয়েকজনের মাজার আছে এ দরবারে।

দরবার সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, পুরো রমজান মাস জুড়ে মাইজভাণ্ডার দরবার শরিফের প্রত্যেকটি মঞ্জিলে উন্মুক্ত ইফতার ও সেহেরির আয়োজন করা হয়। এর মধ্যে সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারীর মঞ্জিলে সেহেরি ও ইফতারে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা বিভিন্ন দিনে বিশেষ করে শুক্রবার দুই-তিন হাজারে গিয়ে পৌঁছে।

জিয়াউল হক মাইজভান্ডারী রওজা শরিফের খাদেম মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রতি বছরের মতো এবারও সকল মেহমানের জন্য রোজায় মাসব্যাপী ইফতারের আয়োজন করা হয়েছে। মাইজভাণ্ডারের সকল মঞ্জিলে এ আয়োজন করা হয়েছে। মাইজভাণ্ডারের এটা একটা ঐতিহ্য। প্রতিবছর এ আয়োজন সবার জন্য উন্মুক্ত থাকে। পাশাপাশি যারা দরবারে এত্তেকাফ নেন, তাদের খাওয়া-দাওয়াও দরবারের পক্ষ থেকে করা হয়, যা এবারও করা হয়েছে।’

হাতে হাতে ইফতার চলে যাচ্ছে রোজাদারসহ ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার কাছে। ছবি: সারাবাংলা

হাতে হাতে ইফতার চলে যাচ্ছে রোজাদারসহ ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার কাছে। ছবি: সারাবাংলা

‘শুধু ফটিকছড়ির দরবারে নয়, চট্টগ্রাম শহরের জমিয়াতুল ফালাহ মসজিদেও মাইজভাণ্ডার দরবারের পক্ষ থেকে মাসব্যাপী ইফতারের আয়োজন করা হয়েছে। ইসলামের যে ঐতিহ্য, ইসলামের যে খেদমত, আল্লাহ-রাসূলের সুন্নত, সেটা বাস্তবায়ন করার জন্য দরবারের পক্ষ থেকে প্রতিবছর এ আয়োজন করা হয়ে থাকে। এ ঐতিহ্য আগামীতেও যুগ যুগ ধরে বজায় থাকবে,’ – বলেন মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ।

সম্প্রতি দরবারের ইফতার আয়োজনে গিয়ে দেখা গেছে, দুপুরের পর থেকেই বিভিন্ন মঞ্জিলে লোক সমাগম শুরু হতে থাকে। শতাধিক স্বেচ্ছাসেবীর মধ্যে কেউ তাদের সুশৃঙ্খলভাবে বসানোর কাজ করেন, কেউ প্লেট-গ্লাস দিচ্ছেন, কেউ খাবার এনে দিচ্ছেন। এত মানুষ কাতারবন্দি হয়ে বসে আছেন, সেখানে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলার বিন্দুমাত্র নেই। ইফতারে বিভিন্ন পদের খাবার দেয়া হয়। এর মধ্যে ছোলা, পেঁয়াজু, বেগুনি, মরিচ, আলুর চপ, শরবত, ফিরনির পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের ফলমূলও থাকে।

একসঙ্গে ইফতার করার মধ্যে সওয়াব হাসিল হয়, তাই এরকম আয়োজনও থাকে। ছবি: সারাবাংলা

একসঙ্গে ইফতার করার মধ্যে সওয়াব হাসিল হয়, তাই এরকম আয়োজনও থাকে। ছবি: সারাবাংলা

স্বেচ্ছাসেবী মোহাম্মদ আরিফ উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘অনেক বিত্তবান ব্যক্তি টাকা-পয়সা থাকার পরেও গরিব, দুঃখী, অসহায় মানুষের জন্য রোজার মাসে সামান্য ইফতারের আয়োজনটুকু করেন না। অনেক দরিদ্র মানুষ আছেন, আর্থিক সক্ষমতা যাদের কম, যাদের নিজেরা আয়োজন করে ইফতারের সামর্থ্য নেই, তারা এই দরবারে এসে উন্মুক্তভাবে ইফতার করতে পারেন। এখানে জাতি-ধর্মের কোনো ভেদাভেদ নেই, সবাই এখানে উন্মুক্ত ইফতারে অংশ নিতে পারেন।’

ফটিকছড়ির মাইজভাণ্ডার গ্রামের বাসিন্দা আমিনুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘আপনি হিন্দু নাকি মুসলিম, এটা কোনো বিবেচনার বিষয় নয়, আপনি উপস্থিত থাকলেই ইফতার পাবেন। যুগ, যুগ ধরে এটাই এখানকার নিয়ম। এটাই মাইজভাণ্ডারের ঐতিহ্য। রমজান মাসে আপনি যদি কাউকে ইফতার কিংবা সেহেরি খাওয়াতে পারেন, তাহলে আল্লাহর তরফ থেকে আপনি সওয়াব পাবেন।’

ইফতারের আগে আল্লাহর দরবারে মোনাজাতে অংশ নেন সবাই। ছবি: সারাবাংলা

ইফতারের আগে আল্লাহর দরবারে মোনাজাতে অংশ নেন সবাই। ছবি: সারাবাংলা

সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারী রওজা শরীফের ভক্ত মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন চট্টগ্রাম নগরী থেকে সেখানে গিয়ে প্রায়ই ইফতার করেন। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘প্রতিবছর হাজার, হাজার মানুষ এখানে এসে ইফতার করেন। সবার জন্য এখানে উন্মুক্ত, যেকোনো মানুষের জন্য। অন্য দরবারের ভক্ত এলেও ইফতার করতে পারবেন। এটা আমাদের বাবাজানের আদেশ, শুধু মুরিদ নয়, সর্বস্তরের মানুষ যারাই আসবেন, সবাই যেন ইফতার পান। সেহেরির সময়ও যারা উপস্থিত থাকেন, তাদের জন্য খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করা হয়।’

১৯৮৫ সাল থেকে প্রতিবছর রমজানের শুক্রবার জুমার নামাজ শেষে মাইজভাণ্ডার দরবারে চলে যান রাউজান উপজেলার বাসিন্দা ইখতিয়ার আলম। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘১৯৮৫ সাল থেকে আমি প্রতিবছর রমজানে প্রতি শুক্রবার এখানে এসে ইফতার করি। কোনোবছর রমজানের কোনো শুক্রবার আমি পারতপক্ষে মিস করিনি। আর প্রতিবছর সাতাশ রোজায় অবশ্যই আমি বাবার দরবারে ইফতার করি। এখানে প্রতিবছর এখানে গণহারে উন্মুক্তভাবে ইফতার করানো হয়। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, যত মানুষই হোক, কখনো একজনের জন্যও খাবার কম হয় না। যত জনই আসুক না কেন, সবাই ইফতার পান। এটা বাবাজানের দয়া।’

সারাবাংলা