
প্রবেশপথ থেকে মসজিদের সর্বত্র মানুষ। শিশু থেকে অশীতিপর; ধনী-গরিব নানা শ্রেণিপেশার মানুষে ঠাসা। মুখোমুখি লম্বা তিন সারিতে বসে তারা অপেক্ষা করছেন। মসজিদের এক পাশে শামিয়ানা টানিয়ে সাজানো হচ্ছে প্লেট। তাতে স্বেচ্ছাসেবকরা বেড়ে দিচ্ছেন পেঁয়াজু, বেগুনি, ছোলা, মুড়ি, জিলাপিসহ নানা সামগ্রী। পাশেই বিশাল ড্রামে প্রস্তুত হচ্ছে রুহ আফজা, লেবু, চিনিসহ নানা উপকরণের শরবত।
হাত ঘুরে রোজাদারের সামনে চলে যাচ্ছে প্লেট ও শরবত। হাত তুলে মোনাজাত করছেন। মাগরিবের আজান দেওয়া মাত্র শরবত দিয়ে হৃদয় জুড়াচ্ছেন তিন হাজারের বেশি মুসল্লি। এর পর পছন্দের সামগ্রী খাচ্ছেন। এটি চট্টগ্রাম নগরের ৩৫৮ বছরের ঐতিহ্যবাহী আন্দরকিল্লা শাহি জামে মসজিদের রমজানের প্রতিদিনের চিত্র।
প্রতিদিন সকাল থেকে ১২ বাবুর্চির তত্ত্বাবধানে চলে ইফতারি তৈরির বিশাল কর্মযজ্ঞ। ৩০ থেকে ৪০ স্বেচ্ছাসেবক আয়োজন সম্পন্ন করেন। এ ইফতারি আয়োজনের অন্যতম কারিগর মসজিদের খতিব সাইয়্যেদ মুহাম্মদ আনোয়ার হোসাইন তাহের জাবেরী আল মাদানী। সৌদি আরবের মক্কা-মদিনায় সম্মিলিত ইফতারের রেওয়াজ দেখে ব্যক্তিগত উদ্যোগে তিনি ১৯৯৭ সালে সীমিত পরিসরে শুরু করেন। পরে মসজিদের মুসল্লি পরিষদের সহযোগিতায় ২০০৮ সাল থেকে নিয়মিত ইফতারির আয়োজন করছেন আনোয়ার হোসাইন।
কয়েক হাজার রোজাদারের জন্য প্রতিদিন বিশাল আকৃতির হাঁড়িতে সেদ্ধ করা হয় ৭০-৮০ কেজি ছোলা। ৩০-৪০ কেজি পেঁয়াজু ও বেগুনি করা হয়। থাকে ৪০-৫০ কেজি আলুর চপ। সকাল থেকে শুরু হয় ইফতারি তৈরির কর্মযজ্ঞ। আসরের ওয়াক্তে রোজাদাররা আসতে থাকেন মসজিদে। নামাজ আদায় করে বসে পড়েন সারিবদ্ধভাবে। বিকেল সাড়ে ৫টার পর মানুষের ঢল নামে।
মসজিদের খতিবের একান্ত সহকারী হাছান মুরাদ বলেন, ‘খতিবের তত্ত্বাবধানে প্রথম রোজা থেকে কয়েক হাজার মানুষের ইফতারের আয়োজন থাকে। রোজার সঙ্গে বাড়তে থাকে ইফতারিতে অংশগ্রহণ। আশা করছি, ১৫ রোজার পর থেকে প্রতিদিন চার হাজারের বেশি রোজাদারের সমাগম ঘটবে।’ স্বেচ্ছাসেবক মো. ইছহাক বলেন, ‘সুযোগ পেলেই এখানে ছুটে আসি। নিজে ইফতারি করার পাশাপাশি ইফতারি বিতরণে শরিক হওয়ার চেষ্টা করি। একসঙ্গে এত মানুষের সঙ্গে ইফতারি ভিন্ন অনুভূতি কাজ করে।’
বাবুর্চি আবুল হোসেন জানান, সকাল ৭টা থেকে ইফতারসামগ্রী তৈরির কাজ শুরু হয়, যা চলে বিকেল পর্যন্ত। একসঙ্গে এত মানুষকে ইফতারি করানোর আনন্দই অন্য রকম।
সরেজমিনে দেখা যায়, মাঝখানের একটি সারিতে পাশাপাশি বসা পাঁচজনের মধ্যে দু’জন ভিক্ষুক ও একজন রিকশাচালক। বাকি দু’জন চট্টগ্রামের ধনাঢ্য ব্যবসায়ী। এটিই আন্দরকিল্লা শাহী মসজিদের ইফতারের সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য। টেরিবাজারের ব্যবসায়ী রাশেদুল করিম বলেন, ‘বাড়ি ও প্রতিষ্ঠানে ইফতারের ভালো আয়োজন হয়। তবে কেন জানি এখানে অনেকের সঙ্গে ইফতারি করার মধ্যে আলাদা তৃপ্তি পাই। এক কাতারে ধনী-গরিবের ইফতার ইসলামের অনন্য সৌন্দর্য।’
ভিক্ষুক মো. করিম বলেন, ‘প্রথম রোজা থেকে এখানে ইফতারি করছি। আমার মতো অনেক ভিক্ষুক, দিনমজুর, খেটে খাওয়া মানুষের জন্য এখানকার ইফতার স্বস্তির ঠিকানা।’
আন্দরকিল্লা জামে মসজিদের সঙ্গে মোগলদের চট্টগ্রাম বিজয়ের ইতিহাস জড়িত। কেল্লাটি মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যুদের আস্তানা ছিল। ১৬৬৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ জানুয়ারি শায়েস্তা খাঁর ছেলে উমেদ খাঁ কেল্লা জয় করলে তা হয়ে ওঠে আজকের আন্দরকিল্লা। বিজয়ের স্মৃতি ধরে রাখতে সম্রাট আওরঙ্গজেবের নির্দেশে শায়েস্তা খাঁ ১৬৬৭ সালে মসজিদটি নির্মাণ করেন।