Image description

উপসচিব পদে পদোন্নতির কোটাসহ জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব নিয়ে প্রশাসনে বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে। জনগণের সেবাকে সহজ ও হয়রানিমুক্ত করতে যে কমিশন গঠিত হয়েছিল, তা নিয়েই এখন বিভিন্ন ক্যাডারের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা ছড়িয়ে পড়েছে। আন্তঃক্যাডার বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করেছে। ক্যাডার সংগঠনগুলো সরকারি চাকরির আচরণবিধির বাইরে গিয়ে নিজেদের স্বার্থ নিয়ে অফিসের বাইরেও প্রতিবাদমুখর হয়েছে।

সরকারি সতর্কবার্তা উপেক্ষা করে শোডাউন থেকে শুরু করে মানববন্ধন ও সমাবেশ, কর্মবিরতিসহ নানা কর্মকাণ্ড পালন করছেন কর্মচারীরা। কেউ মানছেন না সরকারি বিধি-বিধান। এমন পরিস্থিতিতে রহিতকৃত সরকারি কর্মচারী (বিশেষ বিধান) অধ্যাদেশ, ১৯৭৯ কার্যকর করার ব্যবস্থা নিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। চিঠি পাওয়ার পর প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

তবে বিষয়টিকে ভালোভাবে নিচ্ছেন না প্রশাসন বিশেষজ্ঞদের অনেকে। তাঁরা বলছেন, এটি কালো আইন এবং মৌলিক অধিকার, মানবতাবিরোধী ও সংবিধানবিরোধী। এটি ফের বহাল হোক তা কোনোভাবেই কাম্য নয়। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, দেশের বিদ্যমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সরকারি কর্মচারীদের মাঝে নানা মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব দেখা দিচ্ছে।

তাঁদের মধ্যে অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে এবং কেউ কেউ কর্মস্থলে অনুপস্থিত থেকে যথাযথ কর্তৃপক্ষের আইনসংগত আদেশ/নির্দেশ পালনে অনীহা প্রকাশ করছেন। এতে সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। যার ফলে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিসহ সরকারি কর্মকাণ্ড সম্পাদনে শৈথিল্য প্রদর্শিত হচ্ছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি কর্মচারীদের জবাবদিহি নিশ্চিতকরণ, আনুগত্য প্রতিষ্ঠা ও বিশৃঙ্খলা প্রতিহতকরণ এবং দ্রুত আইনগত কার্যক্রম গ্রহণের ব্যবস্থা হিসেবে রহিতকৃত সরকারি কর্মচারী (বিশেষ বিধান) অধ্যাদেশ, ১৯৭৯ পুনরায় কার্যকর করা অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে। এমতাবস্থায় রহিতকৃত সরকারি কর্মচারী (বিশেষ বিধান) অধ্যাদেশ, ১৯৭৯ কার্যকর করার ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।

জানা গেছে, ২০১৮ সালে সরকারি কর্মচারী আইন কার্যকর হলে সরকারি কর্মচারী (বিশেষ বিধান) অধ্যাদেশ, ১৯৭৯ রহিত হয়। রহিত অধ্যাদেশের অপরাধগুলোর মধ্যে রয়েছে, যেকোনো সরকারি কর্মচারী এমন কোনো কাজ করতে পারবেন না, যাতে অন্যান্য কর্মচারীর মধ্যে অসন্তোষের সৃষ্টি হয় বা শৃঙ্খলা ব্যাহত হয় বা কর্তব্য সম্পাদনের বিঘ্ন ঘটে। যদি কোনো কর্মচারী অন্যদের সঙ্গে সংঘবদ্ধভাবে বা নিজে ছুটি বা কোনো যুক্তিসংগত কারণ ছাড়া অনুপস্থিত থাকেন, সংশ্লিষ্ট কর্মচারীকে চাকরি থেকে বরখাস্ত, অব্যাহতি এবং পদ বা বেতন হ্রাসকরণ করা যাবে। যদি কোনো সরকারি কর্মচারী কাজ থেকে বিরত থাকেন বা কোনো কর্মচারীকে অনুপস্থিত থাকতে বা তাঁর দাপ্তরিক কাজ না করতে প্ররোচিত বা নিবৃত্ত করেন অথবা বাধা দেন, সে ক্ষেত্রেও একই ব্যবস্থা কার্যকর হবে।

অধ্যাদেশটির ৭ ধারায় বলা হয়েছে, এই অধ্যাদেশের যে কোনো বিধানের আওতায় গৃহীত কার্যক্রম ও আদেশ সম্পর্কে কোনো আদালতে প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না।

এ ব্যাপারে প্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহিদ খান কালের কণ্ঠকে বলেন, রহিত অধ্যাদেশটি ছিল একটি কালো আইন। এ কারণে রহিত হয়েছিল। এটি ফের বহাল হলে তা হবে আত্মঘাতী। সরকারি চাকরি থেকে কাউকে বাধ্যতামূলকভাবে বের করে দেওয়া, বরখাস্ত করাসবই মৌলিক অধিকার পরিপন্থী। মানবাধিকার ও সংবিধান বিরোধী। ২৫ বছর পর চাকরি থেকে বরখাস্ত করার বিধানটি বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে মুয়ীদ কমিশনের প্রতিবেদনেও। সুতরাং এটি বহাল কোনোভাবেই কাম্য নয়।

এর আগে গত ১ জানুয়ারি সরকারি চাকরি আচরণবিধি লঙ্ঘন হয়এমন কর্মসূচি না দিতে কঠোরভাবে সতর্ক করে বিজ্ঞপ্তি জারি করেছিল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। বিদ্যমান সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা উল্লেখ করে বলা হয়, সম্প্রতি বিভিন্ন পদমর্যাদার কিছু সরকারি কর্মচারী বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে সমাবেশ, অবস্থান ধর্মঘট, মানববন্ধন, কলম বিরতিসহ বিবিধ কর্মসূচি পালন করছেন। এ কারণে সরকারি কর্মচারীদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। এ ছাড়া ইদানীং দেখা যাচ্ছে, সরকারের কোনো কোনো সিদ্ধান্ত, আদেশ বা সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন সম্পন্ন হওয়ার আগেই সে বিষয়ে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিরূপ মন্তব্যসহ বিবৃতি প্রকাশ করা হচ্ছে, যা সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালার পরিপন্থী।

বিজ্ঞপ্তিতে বিধিমালার এসংক্রান্ত কিছু অংশ উল্লেখ করা হয়েছিল। যেমন কোনো সরকারি কর্মচারী সরকারের অথবা কর্তৃপক্ষের কোনো সিদ্ধান্ত বা আদেশ পালনে জনসমক্ষে আপত্তি উত্থাপন করতে বা যেকোনো প্রকারে বাধা দিতে পারবেন না। অথবা অন্য কোনো ব্যক্তিকে তা করার জন্য উত্তেজিত বা প্ররোচিত করতে পারবেন না। বিধিমালার যেকোনো বিধান লঙ্ঘন অসদাচরণ হিসেবে গণ্য হবে। কোনো কর্মচারী বিধিমালার কোনো বিধান লঙ্ঘন করলে তিনি অসদাচরণের দায়ে শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থার আওতায় আসবেন।

এমন কড়া সতর্কবার্তার পরও প্রশাসনে শৃঙ্খলা ফেরেনি। গত ২ মার্চ বিভিন্ন ক্যাডারের ১২ কর্মকর্তার সাময়িক বরখাস্তের প্রতিবাদে এবং আন্ত ক্যাডার বৈষম্য নিরসনের দাবিতে সারা দেশে কর্মবিরতি পালন করে ২৫টি ক্যাডার কর্মকর্তাদের সংগঠন আন্ত ক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ। এদিন সকাল ১১টায় বিভিন্ন দপ্তরের সামনে কালো ব্যাজ পরে অবস্থান নেন কর্মকর্তারা।

তাদের দাবি, একই ধরনের কাজ প্রশাসন ক্যাডারের সদস্যরা করলেও তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বৈষম্যপূর্ণ রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়ে প্রশাসন ক্যাডার ২৫ ক্যাডারের কার্যক্রমকে ব্যাহত করতে এমন ব্যবস্থা নিয়েছে। এর আগে সংগঠনটি কর্মবিরতি, মানববন্দন ও সমাবেশ কর্মসূচিও পালন করেছে। একই ভাবে প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন (বিএএসএ) প্রশাসন ক্যাডারের বিভিন্ন ব্যাচের অন্তত এক হাজার সদস্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট ভবনে শোডাউন করে। এমনকি তারা সরকার কর্তৃক গঠিত জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. আবদুল মুয়ীদ চৌধুরীর পদত্যাগ চেয়ে ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটামও দিয়েছিলেন। এমন পরিস্থিতিতে প্রশাসনের শৃঙ্খলা ফেরাতে এবার রহিত করা সরকারি কর্মচারী (বিশেষ বিধান) অধ্যাদেশ, ১৯৭৯ কার্যকর করার উদ্যোগ নিল সরকার।

এ প্রসঙ্গে প্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক সচিব এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার কালের কণ্ঠকে বলেন, যদিও এটা কালো আইন, কিন্তু বর্তমান প্রশাসনের শৃঙ্খলা ফেরাতে এটির প্রয়োজন আছে বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি। সরকারি কর্মচারীদের মতের অমিল থাকতেই পারে। তাই বলে একে অপরের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করে অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করবেন? তবে সরকারকেই নিশ্চিত করতে হবে যেন আইনটির অপব্যবহার না হয়। বাস্তব পরিস্থিতি অনুযায়ী এই আইনের বিকল্প নেই।