
দেশে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বায়ুদূষণ। এর সঙ্গে বাড়ছে মানুষের রোগ বালাই। রাজধানী ঢাকার ২৫০ শয্যার (যক্ষ্মা) হাসপাতালের তথ্যই প্রমাণ করছে দূষণে কতটা নাজেহাল নগরবাসী। চলতি বছর জানুয়ারি মাসের ৩১ দিনে চিকিত্সা নিয়েছে ৮ হাজার ৬১৪ জন রোগী। জানুয়ারি মাসের তুলনায় ফেব্রুয়ারি মাসের ২৮ দিনে চিকিত্সা নেওয়া রোগীর সংখ্যা ছিল ৯ হাজার ৬৪০ জন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আর বায়ুদূষণ বাড়তে বাড়তে এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে যে—পৃথিবীর সবচেয়ে বায়ুদূষিত দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম ‘বাংলাদেশ’। মানুষের কার্যক্রমগুলো ধীরে ধীরে পৃথিবীকে উত্তপ্ত করে তুলছে, তার মধ্যে বায়ুদূষণের অবদান সবচেয়ে বেশি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বায়ুদূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তন একই মুদ্রার দুই পিঠ। বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ করা গেলেই জলবায়ু পরিবর্তনে ঝুঁকি অনেকাংশে কমে আসবে।
গত বছর-২০২৪ এর ডিসেম্বরে ঢাকা নগরীর দূষণ ছিল আগের ৯ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। ২০২৫-এর জানুয়ারিতেও একই অবস্থান ছিল। আর মাত্র শেষ হওয়া ফেব্রুয়ারি মাসের ২৮ দিনের দূষণ ছিল আগের আট বছরের উপরে। বায়ুদূষণের এমন পরিস্থিতির তথ্য তুলে ধরেছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)। জানা যায়, সাধারণত নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বায়ুদূষণ অনেক বেড়ে যায়। এবারের শুষ্ক মৌসুমে নভেম্বর থেকে টানা চার মাস রাজধানীর বায়ুদূষণ আগের আট বছরকে ছাড়িয়ে গেছে। বায়ুর মান শূন্য থেকে ৫০ থাকলে ‘ভালো’ বলা হয়। ৫১ থেকে ১০০ হলে ‘গ্রহণযোগ্য’। আর ১০১ থেকে ১৫০ ‘সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য ক্ষতিকর’, ১৫১ থেকে ২০০ হলে ‘অস্বাস্থ্যকর’, ২০১ থেকে ৩০০ ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’ এবং ৩০০-এর বেশি হলে তা হয় ‘দুর্যোগপূর্ণ’। ১৩৮টি দেশ ও অঞ্চলের প্রায় ৪০ হাজার নজরদারি স্টেশন থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে আইকিউএয়ার প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।
ক্যাপস ঢাকার মার্কিন দূতাবাস থেকে পাওয়া এয়ার নাওয়ের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে ঢাকার বায়ুমান পর্যবেক্ষণ করছে ২০১৭ সাল থেকে। সেই গবেষণা অনুযায়ী, ১০ দিন আগে শেষ হওয়া ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকার বায়ুর মান ছিল ২৬২। এটি ৯ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে এর মান ছিল ২৫৮। ২০২৩-এর ফেব্রুয়ারিতে এর মান ছিল ২২৫। তবে শুধু এবারের ফেব্রুয়ারি নয়। গত নভেম্বর থেকে জানুয়ারি—প্রতিটি মাস ছিল দূষণের দিক থেকে আগের আট থেকে ৯ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান ক্যাপসের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি টানা চার মাসে আমাদের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, দূষণে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। এমনটা আর কোনো বছরে হয়নি। দূষণ পরিস্থিতি যে কতটা ভয়াবহ, তা বোঝা যায়। কিন্তু এই দূষণ রোধে দুই সিটিসহ সরকারের দপ্তরগুলোর কার্যকর তত্পরতা দেখা যায় না। তিনি বলেন, কোনো সমস্যাই একদিনে সমাধান করা সম্ভব নয়; স্বল্প মেয়াদি, মধ্য মেয়াদি এবং দীর্ঘ মেয়াদি পদক্ষেপ গ্রহণের মধ্যমে উদ্ভুত সমস্যাগুলোর সমাধান করতে হবে বলে তিনি জানান।
(ক্যাপস) দেশের বিভিন্ন শহরের বায়ুদূষণ পরিস্থিতি নিয়ে সার্বক্ষণিক গবেষণা করে। ক্যাপসের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার এই প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বলেন, দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বায়ুদূষণে দ্বিতীয় শীর্ষ স্থান পেল, এটা আমাদের জন্য ভালো সংবাদ নয়। এ বছর দেখা যাচ্ছে গত বছরের চেয়ে তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। এ প্রতিবেদন ২০২৪ সালের পরিস্থিতি নিয়ে। কিন্তু আমরা দেখেছি, চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাস আগের ৯ বছরের চেয়ে বেশি দূষিত। চলতি বছরে বায়ুদূষণ আরো বেড়ে যাচ্ছে।
২০২২ সালে বাংলাদেশ বিশ্বের দূষিত বাতাসের দেশের তালিকায় পঞ্চম অবস্থানে ছিল এবং ভারতের অবস্থান ছিল অষ্টম। আর ২০২২ সালে বাংলাদেশের বাতাসে পিএম ২.৫-এর উপস্থিতি ছিল ৬৫ দশমিক ৮। নগর হিসেবে দূষণের দিক থেকে ঢাকার অবস্থান তৃতীয়। এ নগরের বায়ুতে পিএম ২.৫-এর উপস্থিতি ছিল ৭৮ মাইক্রোগ্রাম। ২০২৩ সালে এর পরিমাণ ছিল ৮০ দশমিক ২ মাইক্রোগ্রাম। আর এ তালিকায় শীর্ষে থাকা নয়াদিল্লির বাতাসে পিএম ২.৫-এর উপস্থিতি ৯১ দশমিক ৮। ২০২৩ সালে তা ছিল ৯২ দশমিক ৭ মাইক্রোগ্রাম। অর্থাত্ সর্বোচ্চ দূষিত এ নগরীরও বায়ুর মান কিছুটা হলেও উন্নত হয়েছে। ১৩৮টি দেশ ও অঞ্চলের প্রায় ৪০ হাজার নজরদারি স্টেশন থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ার প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে।
২৫০ শয্যাবিশিষ্ট যক্ষ্মা হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. আয়শা আক্তার ইত্তেফাককে বলেন, শ্বাসতন্ত্রের রোগের বিভিন্ন ক্যাটাগরি আছে। আমাদের দেশে অ্যাজমা ও সিওপিডি রোগীর সংখ্যা বেশি। অ্যাজমার ক্ষেত্রে রোগী শ্বাসকস্ট নিয়ে আসে। সিওপিডির ক্ষেত্রে কাশি হয়। শ্বাসকষ্ট অনেক পরে হয়। এ সময় শ্বাসকষ্টের রোগী বেশি পাওয়া যাচ্ছে। ঠান্ডা, কাশি, সর্দিজ্বর হতে পারে। সেটা বায়ুদূষণের কারণেও বাড়ে।