
পতিত ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার লুটপাটের অন্যতম দোসর দেশের আর্থিক খাতের শীর্ষ লুটেরা চট্টগ্রাম ভিত্তিক এস আলম গ্রুপের মালিক পলাতক সাইফুল আলম মাসুদের সকল অপকর্ম জায়েজ করে তাকে সুরক্ষার চেষ্টা চলছে। লুটের টাকায় দেশে-বিদেশে তার অবৈধ সম্পত্তি সেই সাথে তার শিল্প-কারখানা রক্ষা করে তাকে মামলার জাল থেকে বের করে আনার নানামুখি তৎপরতাও শুরু হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে জুলাই বিপ্লবে গণহত্যাসহ বিগত সাড়ে পনের বছর দেশে আওয়ামী জাহেলিয়াতের অন্যতম এই অর্থ জোগানদাতা ও দেশের শীর্ষ পুঁজি পাচারকারীকে রক্ষায় তার মাথার ছাতা হিসেবে দাঁড়িয়েছেন কেন্দ্রীয় বিএনপির এক নেতা। মূলত এস আলম পুনর্বাসনের এই মিশনে তিনি সরাসরি জড়িয়ে পড়েছেন। আর সরকারের বিশেষ একটি মহল থেকেও এই মাফিয়া পুনর্বাসনে মিলছে নানা সুযোগ-সুবিধা।
এস আলম গ্রুপ সংশ্লিষ্টদের সাথে আলাপে জানা গেছে, বিএনপির ওই কেন্দ্রীয় নেতা আড়ালে থেকে বিতর্কিত এই গ্রুপের শিল্প-কারখানাসহ সার্বিক বিষয় দেখভাল করছেন, দিচ্ছেন নানা পরামর্শ। তার সাথে পলাতক মাসুদ ও তার পরিবারের সদস্যদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ আছে। সেই আর চট্টগ্রামের কল-কারখানাসহ সহায় সম্পত্তি তদারক করছেন মাসুদের এক নিকট আত্মীয়। যিনি একটি ব্যবসায়িক গ্রুপের মালিক। বিগত ৫ আগস্টের পর এস আলমের শিল্প কারখানা পরিচালনায় কিছুটা অনিশ্চিয়তা দেখা দিলেও সেই অবস্থা এখন আর নেই। গ্রুপের কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারের বিশেষ মহলের পক্ষ থেকে এসব কারখানা সচল রাখতে যাবতীয় সহযোগীতা মিলছে। ইতোমধ্যে চট্টগ্রামে নয়টি কারখানার সাতটিই পুরোদমে সচল হয়েছে। বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে তার বিভিন্ন ভূ-সম্পত্তি এবং স্থাপনাও নিরাপদ রয়েছে।
গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত শেখ হাসিনার মতো পবিবারের সদস্যদের নিয়ে বিদেশে পালিয়ে যাওয়ায় পর সাইফুল আলম মাসুদের ব্যাংকসহ আর্থিক খাতের সাগর চুরি সেই সাথে বিদেশে পুঁজি পাচারের নানা ঘটনা উদঘাটন করা হচ্ছে। লুটপাটের শিকার বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান নামে-বেনামে এবং জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়া হাজার হাজার কোটি টাকা ফেরৎ পেতে আইনের আশ্রয় নিচ্ছে। চট্টগ্রামে মাসুদ, তার স্ত্রী ও পুত্রদের নামে বিভিন্ন ব্যাংকের পক্ষ থেকে অসংখ্য মামলা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর, দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদকসহ বিভিন্ন সংস্থা তার লুটপাট ও অর্থ পাচারের নানা তথ্য উদঘাটন করে চলেছে। এ পর্যন্ত ইসলামী ব্যাংকসহ আট ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে বিতর্কিত ব্যবসায়ী সাইফুল আলম মাসুদ তার নামে-বেনামে প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দুই লাখ ২৮ হাজার কোটি টাকা বের করে নিয়েছেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে। এ ছাড়া আরো ডজনখানেক ব্যাংক থেকে তার ঋণ নেয়ার প্রমাণ মিলেছে। সব মিলিয়ে দেশের ব্যাংকিং খাত থেকে এস আলমের বের করে নেয়া অর্থের পরিমাণ পৌনে চার লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে সংশ্লিষ্টদের ধারণ।
জানা গেছে এসব অর্থের বেশির ভাগই বিদেশে পাচার করা হয়েছে। পাচারকৃত সম্পদের খোঁজে দেশ-বিদেশের একাধিক সংস্থা যে তথ্য বের করেছে তাতে এ পর্যন্ত ১২টি দেশে পাচারকৃত সম্পদের গন্তব্য সম্পর্কে খোঁজ মিলেছে। এসব সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার কাজ শুরু করা হয়েছে। এ জন্য দুদক, এনবিআর ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) সমন্বয়ে যৌথ কমিশন কাজ করছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এ লুটেরার কাছ থেকে লুটের টাকা উদ্ধারে তার সম্পত্তি জব্দ করার উদ্যোগও নিয়েছে। সর্বশেষ গত সোমবার দুদদের আবেদনের প্রেক্ষিতে মাসুদ ও তার পরিবারের নামে টাকা ৩৩২.১৬ একর জমি জব্দের আদেশ দিয়েছেন আদালত। ঢাকা ও চট্টগ্রামে ৯৭টি দলিলে এসব জমির উল্লেখ রয়েছে। এর আগে আরো কয়েক দফায় এস আলম ও তার পরিবারের জমি এবং শেয়ার অবরুদ্ধ করার আদেশ দেন।
এ অবস্থায় এস আলমকে সুরক্ষায় ওই বিএনপির নেতা তৎপতরা নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা চলছে। দলের ভেতরে বাইরে এই নিয়ে সমালোচনার শেষ নেই। সাধারণ মানুষের মাঝেও এ নিয়ে নানা নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সরকার পতনের পর লুটের অর্থ ফেরত আনতে সরকার নানা উদ্যোগ নেয়। এর অংশ হিসেবে এস আলমের সম্পত্তি জব্দ করা হয়। আর তখনই বিএনপির কয়েকজন নেতা তার কারখানা থেকে গাড়ি সরিয়ে নিতে ছুটে যান। ওই ঘটনায় চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি বিলুপ্ত করা হয়। বহিঃস্কার করা হয় জেলার তিন শীর্ষ নেতাকে।
মূলত ওই ঘটনার পর বিএনপির ওই কেন্দ্রীয় নেতা গোপনেই এস আলমকে পুনর্বাসনের মিশনের নামেন। তার তৎপরতা এখন আর গোপন নেই। এটা বিএনপির ভেতরে-বাইরে অনেকটা ওপেন সিক্রেট। কেউ কেউ বলছেন, এস আলমের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ওই নেতার মোটা অংকের বিনিয়োগ রয়েছে। আর এ কারণেই তিনি বিতর্কিত এ প্রতিষ্ঠানকে পুনর্বাসনে উঠেপড়ে লেগেছেন। বলা হচ্ছে এস আলমের বিরুদ্ধে সরকারের তরফে যেসব ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে নির্বাচনের পর তা আর বেশিদূর যেতে দেয়া হবে না। আর তখন মাসুদের সব অপকর্ম জায়েজ করে দেয়ার আশ^াসও দেয়া হচ্ছে।
এদিকে চট্টগ্রামে বন্ধ হয়ে যাওয়া এস আলমের নয়টি কারখানার মধ্যে সাতটির কার্যক্রম চলছে। জানা গেছে, এসব প্রতিষ্ঠান লাভজনক ও চালু দেখিয়ে বিভিন্ন ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়া হয়। বাস্তবে এসব প্রতিষ্ঠান অনেকটা রুগ্ন এবং চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। বিগত ২৪ ডিসেম্বর নয়টি কারখানা একযোগে বন্ধ ঘোষণা করা হয়। তখন অজুহাত দেয়া হয় বিভিন্ন ব্যাংকে হিসাব অবরুদ্ধ হওয়ায় কাঁচামাল আমদানি করা যাচ্ছে না। আর এ কারণে কারখানা বাধ্য হয়ে বন্ধ করা হচ্ছে। যদিও বন্ধের নোটিশ প্রত্যাহার করে ১ জানুয়ারি থেকে কারখানা চালু করা হয়। কোনমতে সাতটি কারখানা চালু হলেও দুটি এখনও বন্ধ।
এ বিষয়ে এস আলম গ্রুপের উপ-ব্যবস্থাপক আশীষ কুমার নাথ ইনকিলাবকে বলেন, চট্টগ্রামের নয়টি কারখানার মধ্যে দুটি বন্ধ। বাকি সাতটি চালু রয়েছে। এসব কারখানায় বেতনভাতা পরিশোধ করা হচ্ছে। কারখানা সচল রাখতে সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতর থেকে যাবতীয় সুযোগ সুবিধা মিলছে বলেও জানান তিনি।