Image description
নেতৃৃত্বে আওয়ামী লীগ নেতারা

চট্টগ্রামের চেরাগী পাহাড় এলাকার কদম মোবারক মুসলিম এতিমখানা। দেশের অন্যতম বৃহৎ এই এতিমখানার সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৫০ কোটি টাকা। নানা ইতিহাসের সাক্ষী এই এতিমখানা থেকেও লুটপাট করেছে আওয়ামী লীগ নেতারা। এতিমখানার কোটি কোটি টাকার আয়ের হিসাব নেই। ভবন নির্মাণেও হয়েছে দুর্নীতি। 

সরজমিন জানা যায়, তিনটি বহুতল ভবন থাকার পরেও ২২০ জন এতিম শিশু থাকার মতো পর্যাপ্ত জায়গা নেই। একজনের সিটে দু’জন গাদাগাদি করে থাকতে হচ্ছে এখানে। বর্তমানে স্থান সংকুলান না হওয়ার দোহাই দিয়ে প্রথম শ্রেণি থেকে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত এতিম শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধ। অথচ তিন হাজার বর্গফুটের ছাত্রাবাসের ফ্লোর দখল করে পরিবার নিয়ে থাকছেন তত্ত্বাবধায়ক। দোকান, রেস্টুরেন্ট, ফ্লোর ভাড়া থেকে শুরু করে এতিমখানার সম্পদ হয়েছে হরিলুট। ১৫ বছর ধরে এসব লুটপাটের নেতৃত্ব দিয়েছে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা।

জানা যায়, এতিমখানার কাগজে-কলমে হর্তাকর্তা এখনো চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আজম নাছির উদ্দিন। জেলা প্রশাসক পদাধিকার বলে সভাপতি। তিন বছর পর পর নির্বাচনের নিয়ম হলেও ১৫ বছর ধরে কোনো নির্বাচন করতে দেয়নি আজম নাছির। সাধারণ সম্পাদকের কর্তৃত্ব ধরে রেখে মাদ্রাসার সম্পদের ওপর তার নেতৃত্বে চলেছে হরিলুট। তার সহযোগী হিসেবে সিনিয়র সহ-সভাপতি পদে আছেন ডিস্কো শওকত। সহ-সভাপতি আওয়ামী লীগ নেতা মো. হাবীব উল্লাহ এবং মা ও শিশু হাসপাতালের প্রেসিডেন্ট সৈয়দ মোহাম্মদ মোরশেদ। সহ-সাধারণ সম্পাদক ও তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে আছেন আবুল কাশেম। লায়ন সানাহউল্লাহ আছেন শিক্ষা সম্পাদক হিসেবে। তাছাড়া আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর নাজমুল হক ডিউক আছেন সদস্য হিসেবে। যদিও মোরশেদ ও সানাহউল্লাহ’র রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টটার বিষয়ে জানা যায়নি। 

আরও জানা যায়, এই কমিটির হাত ধরেই এতিমখানা ভবন নির্মাণ, ফ্লোর বিক্রি, দোকান, অফিস, রেস্টুরেন্ট ও বাসা ভাড়া আদায়, আর্থিক অনুদান, শিক্ষক-কর্মকর্তা-কমচারী নিয়োগ, সরকারি ক্যাপিটেশনসহ বিভিন্ন খাতে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি করেছে। এতিমখানার ৪০ বছর ধরে তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে আছেন আবুল কাশেম। ছাত্রাবাসের ৫ম তলায় তিন হাজার বর্গফুট জায়গায় নিজের সন্তানাদি, নাতিপুতি নিয়ে ফ্ল্যাট বানিয়ে থাকছেন তিনি। একসময় অভাবের সংসার থাকলেও এতিমখানার তত্ত্বাবধায়কের পদ তার কপাল খুলে দিয়েছে। চাকরির মেয়াদ শেষ হলেও কমিটির সদস্যদের এতিমখানার দোকান, অফিস বরাদ্দ দিয়ে টিকে আছেন এখনো এই পদে। রাউজানে নির্মাণ করেছেন বিলাসবহুল বাড়ি। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ তুলে পতদ্যাগের দাবিতে আন্দোলন করেছিল শিক্ষার্থীরা। 

নিজের ইচ্ছেমতো শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দেয়ার অভিযোগ রয়েছে তত্ত্বাবধায়ক আবুল কাশেমের বিরুদ্ধে। এতিম ছাত্রদের আবাসন সংক্রান্ত পণ্য ও খাদ্যসামগ্রী কিনতেও নিয়োজিত তার লোকেরা। এসব কাজের নেতৃত্ব দেন পিয়ন আনোয়ার। এ দায়িত্ব তাকেও বানিয়ে দিয়েছে কোটিপতি। তত্ত্বাবধায়ক আবুল কাশেমের এমন দুর্নীতির বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কার্যালয়েও কয়েকবার অভিযোগ গেলেও আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক আ.জ.ম নাছির উদ্দিনের হস্তক্ষেপে দুদকের জাল থেকে বেরিয়ে যান তিনি। কয়েকজন আজীবন দাতা সদস্য ও প্রাক্তন শিক্ষার্থী জানান, নূন্যতম তদারকি ও জবাবদিহিতা নেই এই প্রতিষ্ঠানে। নামমূত্রে মূল্যে মার্কেটগুলোর দোকান, বাসা, অফিস কেনা-বেচা হচ্ছে। তিনটি বহুতল ভবন থাকার পরেও ২২০ জন এতিম শিশু থাকার মতো পর্যাপ্ত জায়গা নেই। 

সরজমিন দেখা যায়, সিডিএর অনুমোদন, নকশা প্রণয়নসহ কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই একটি ৬ তলা, আরেকটি ৭ তলা ও একটি ৮ তলা বহুতল ভবন তৈরি করেছে কর্তৃপক্ষ। ভবনগুলোতে ছাত্রাবাসের পাশাপাশি রয়েছে সাড়ে চার শতাধিক দোকান, অফিস, রেস্টুরেন্ট ও বাসা। এখান থেকে মাসিক ভাড়া বাবদ পাওয়া যায় প্রায় ১০ লাখ টাকা। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে সরকারিভাবে প্রতি মাসে ২ হাজার টাকা করে ক্যাপিটেশন গ্র্যান্ড পায় ১৩০ জন। এক বছরে যার পরিমাণ ৩১ লাখ ২০ হাজার টাকা। ক্যাপিটেশন, ভাড়া ও অন্যান্য অনুদান হিসেবে প্রায় দেড় কোটি টাকার বেশি বাৎসরিক আয় রয়েছে এতিমখানায়। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের বাৎসরিক যে আয়-ব্যয় বিবরণী প্রস্তুত করা হয় তার সঙ্গে বাস্তবের কোনো মিল নেই। নিজেদের ইচ্ছেমতো ভাউচার বানিয়ে ভুয়া অডিট করে এ হিসাব বিবরণী প্রস্তুত করা হয়।

এদিকে, বর্তমানে এতিম শিক্ষার্থীদের একমাত্র খেলাধুলার মাঠে নতুন করে তৈরি করা হচ্ছে আরও একটি ৮তলা বাণিজ্যিক ভবন। এ ভবন তৈরিতেও নেয়া হয়নি সিডিএর কোনো অনুমোদন। বর্গফুট হিসেবে ইতিমধ্যে নির্মাণাধীন এই ভবনের সব ফ্লোর বিক্রি করে দিয়েছে এতিমখানা কর্তৃপক্ষ। এ বিষয়ে এতিমখানার তত্ত্বাবধায়ক আবুল কাশেম বিরক্তির সুরে মানবজমিনকে বলেন, এই এতিমখানায় এত সমস্যা না? আর কোথাও সমস্যা নাই? আপনি এসে দেখে যান। একপর্যায়ে উত্তেজিত কণ্ঠে বলেন, আমি এখন কাপড় পরিষ্কার করছি। আপনি এসব আলাপ রাখেন। এ বলেই তিনি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। এতিমখানা পরিচালনা কমিটির সহ-সভাপতি সৈয়দ মোরশেদ আলম বলেন, নির্বাচন হয়নি এটি সত্য নয়। নির্বাচন হয়েছে। বর্তমানে কমিটিও আছে। চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এলএ) এতিমখানার সভাপতির দায়িত্বে রয়েছেন। এসব বিষয়ে জানতে ওনার সঙ্গে কথা বলুন। আপনি যেসব প্রশ্ন করছেন সেগুলো আসলে এখতিয়ারভুক্ত নয়। তবে ভবন নিয়ে যা শুনেছি সেখানে একটি পানির ট্যাংক হচ্ছে। ভবনের অনুমোদন দেয়নি সিডিএ।