Image description

Asif Shibgat Bhuiyan (আসিফ শিবগত ভূঁইয়া)

রমজান মাসে দুজন শায়েখের নলেজ প্রোগ্রামে প্রতিদিন ক্লাস করছি। মিসরের স্কলার শায়েখ আহমাদ শরীফ এবং ইসতাম্বুলে অবস্থানরত সিরিয়ান স্কলার শায়েখ ইয়াহিয়া আল-গাউসানী।
 
শায়েখ আহমাদ শরীফ হানাফি মাযহাবের আলেম। কেবল দুদিন আগেই কথা বললেন নারীদের সফর করার ক্ষেত্রে মাহরাম নিয়ে যাওয়ার প্রসঙ্গে। তার মতে নারীদের যদি সফর করতে হয় - অর্থাৎ নিজ বাসভূম ছেড়ে দূরে ভ্রমণ করতে হয় তাহলে সাথে মাহরাম থাকার যে বাধ্যবাধকতা হাদীসে এবং আলেমদের কথায় এসেছে তা সম্পূর্ণ নারীর ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য। উপরন্তু তিনি বলেন যে বর্তমান সময়ে ল্যান্ডে বা সী-তে ট্র্যাভেল করার ক্ষেত্রে তার মত হোলো যে একজন মহিলার অবশ্যই একজন মাহরাম পুরুষকে সাথে রাখতে হবে তবে এয়ারে অর্থাৎ প্লেনে তিনি মাহরাম থাকার আবশ্যকতা দেখেন না। কেননা আকাশে ক্র্যাফটের ভেতরে অথবা বাইরে থেকে সেধরণের কোনো আশঙ্কা নেই যা থেকে নিরাপদ রাখার জন্য একজন মাহরাম পুরুষের দরকার ছিলো।
 
খেয়াল করুন যে মাহরাম পুরুষের প্রয়োজনটা সফরের ক্ষেত্রে এবং সেই সফরও যদি প্লেনে হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে ফিকহের উসূল এবং সফরের যে বর্তমান অভিজ্ঞতা তা থেকে শায়েখ বলছেন যে মাহরাম পুরুষের প্রয়োজন নেই। যেখানে শায়েখের মত অনুযায়ী প্লেনে একজন মহিলা মাহরাম ছাড়া ট্র্যাভেল করতে পারছেন সেখানে আমাদের দেশে ওয়াজ মাহফিলে বলা হচ্ছে 'মাহরাম ছাড়া ঘর থেকে বের হলে' ধর্ষিতা নারীর দায় তার নিজের। এই কথার ভেতরের জ্ঞানের ঘাটতি এবং ব্যক্তিগত সংবেদবশীলতার অভাবের যে যৌথ বিকার তার ব্যাপারে কোথা থেকে কথা শুরু করা উচিৎ সেটাই বোঝা মুশকিল।
 
অপর শায়েখ ইয়াহিয়া আল-গাউসানী একটি বই পড়ে শোনালেন চারদিন ধরে - বইটির নাম 'আখলাকুল উলামা' - আলেমদের আখলাক বা ম্যানারস, লিখেছেন চতুর্থ হিজরি শতকের আলেম ইমাম আবু বাক্‌র আল-আজুররি। অনবদ্য এই বই থেকে সাহাবীদের সময়ের একটি ঘটনা উল্লেখ করি যা থেকে সবাই বুঝবেন যে কেন ইসলামি জ্ঞান চর্চা এবং অন্যকে সেটি দেয়ার কাজটি একটি গভীর পর্যায়ের কাজ এবং যার তার উচিৎ নয় ওয়াজমাহফিলের মঞ্চে বসে শস্তা জনপ্রিয়তার সুবাদে অল্প জ্ঞান পুঁজি করে এবং নিজের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা না বুঝে কথা বলতে যাওয়া।
 
ইমাম মুজাহিদ বলছেন:
"একদিন আমরা মসজিদে সাহাবী ইবন 'আব্বাসের (রা.) হালাকা বা পাঠে অংশ নিচ্ছিলাম। সেই মজলিসে আরও ছিলেন তাউস, সা'ঈদ ইবন জুবায়ের এবং 'ইকরিমা (এরা সবাই সাহাবীদের পরবর্তী প্রজন্ম তাবি'ঈদের সময়কার মুসলিম স্কলার এবং ইবন 'আব্বাসের ছাত্র)।
 
এক পর্যায়ে ইবন 'আব্বাস (রা.) উঠে নামাজ পড়ছিলেন। এমন সময় এক লোক এসে জিজ্ঞেস করলো, "মুফতি কেউ কি আছে?" (অর্থাৎ তার একটি প্রশ্নের উত্তর জানা দরকার)।
 
আমরা বললাম: "কী প্রশ্ন তোমার, বলো।" সে বললো: "আমি যখনই প্রস্রাব করি তখনই দমকে বের হওয়া তরলটি নির্গত হয়।" আমরা বললাম, "সেটার কথা বলছো যা থেকে বাচ্চা আসে?" সে বললো: "হ্যাঁ"। আমরা তাকে জানালাম যে তাকে গোসল করতে হবে এমন হলেই। সে উঠে ইন্না লিল্লাহি ... রাজি'উন পড়তে পড়তে বিদেয় নিচ্ছিল। (যেহেতু তার জন্য ব্যাপারটা খুবই কষ্টকর হয়ে যাবে প্রত্যেকবার প্রস্রাবের পর যদি গোসল করতে হয়।)
 
এইসময় ইবন আব্বাস তড়িঘড়ি করে নামাজ শেষ করলেন এবং 'ইকরিমাকে বললেন: "ঐ লোকটিকে জলদি আমার কাছে নিয়ে এসো!" তারপর আমাদের দিকে ফিরে বললেন: "তোমরা এই লোককে যে ফাতওয়া দিলে সেটা কি আল্লাহ্‌র কিতাব থেকে দিয়েছো?" আমরা বললাম "না।" "আল্লাহ্‌র রাসূলের (সা.) হাদীস থেকে?" "না।" "তাহলে নবীর সাহাবীদের কোনো মত থেকে?" "না।" "তাহলে কোথা থেকে দিলে?" আমরা বললাম: "আমাদের নিজেদের মত থেকে।"
 
তখন ইবন 'আব্বাস বললেন: "এ কারণেই আল্লাহ্‌র রাসূল (সা.) বলেছেন, "একজন ফকীহ (যিনি দ্বীনের সঠিক জ্ঞান ও বোধ রাখেন) একশজন সাধারণ ইবাদাতকারী মুসলিমের তুলনায় শয়তানের জন্য বেশি কষ্টকর।" অর্থাৎ সাধারণ ইবাদাতকারী প্র্যাকটিসিং কিন্তু গভীর জ্ঞান না রাখা মুসলিমের ওপর শয়তান যেভাবে চড়াও হতে পারে তাকে দিয়ে ভুল কথা বলিয়ে এবং ভুল প্র্যাকটিস করিয়ে ইসলামকে মানুষের জন্য কঠিন করে দেয়ার ব্যাপারে তেমনটা সত্যিকারের জ্ঞান থাকা মানুষের ক্ষেত্রে শয়তান পারে না।
 
অতঃপর সেই লোকটি এলো। ইবন 'আব্বাস তাকে জিজ্ঞেস করলেন, "যখন এই ব্যাপারটা তোমার সাথে ঘটে তখন কি তুমি তোমার অঙ্গে কোনো উত্তেজনা অনুভব করো?" সে বললো, "না।" তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন: "ঘটে যাওয়ার পর কি তোমার দেহে কোনো দুর্বলতা বা নিস্তেজ অনুভূতি আসে?" সে বললো, "না।" তখন ইবন 'আব্বাস বললেন: "এটি হচ্ছে শীতে জমে থাকা তরল যা প্রস্রাবের সাথে বের হচ্ছে, এজন্য ওজু করাই যথেষ্ট।"
 
সোশাল মিডিয়ার যুগে মানুষ অল্প জ্ঞান নিয়ে সেলেব্রিটিতে পরিণত হয় এবং আমরাই তাদের সেলেব্রেট করি, যেহেতু আমরাও সোশাল মিডিয়ার জীব। আমাদের মাথায় রাখা লাগবে যে ইসলাম কোনো শূণ্যের মধ্যে অপারেট করে না। যারা ইসলাম নিয়ে কথা বলেন তাদের যেমন নিজেদের জ্ঞানের ব্যাপারে দায়িত্ব নেয়া প্রয়োজন, একইসাথে সাধারণ মুসলিমদেরও দায়িত্ব হোলো কার কাছে জ্ঞান নেয়া উচিৎ সে ব্যাপারে ব্যক্তিগত এবং সামষ্টিক ভাবে ধারণা তৈরি করা। সবসময়ই আমি বলে এসেছি যে জ্ঞান অর্জনের ব্যাপারে আমরা সবাই যখন ফাঁকি দেব এবং গভীরতার অনুসন্ধান না করে স্থূল জ্ঞানকে সেলেব্রেট করতে থাকবো তখন ইসলামি জ্ঞানের যে বিভ্রান্তির সাগর এবং স্থূল বিতর্ককে আমরা উস্কে দেব তার কোনো কিনারা মিলবে না।