Image description
 

শিল্প খাতে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব নিয়ে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি গণশুনানি আয়োজন করে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)।

 

শিল্প খাতে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব নিয়ে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি গণশুনানি আয়োজন করে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। গণশুনানিতে প্রতি ঘনফুট গ্যাসের দাম ৩০ টাকা থেকে একলাফে ৭৫ টাকা ৭২ পয়সা নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়। শুরু থেকেই এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করে আসছেন ব্যবসায়ীরা। সর্বশেষ গত রোববার গ্যাসের মূল্যহার পুনর্নির্ধারণের জন্য বিইআরসিতে চিঠি দিয়েছে মেঘনা গ্রুপ, সিটি গ্রুপ, উত্তরা মোটর করপোরেশন এবং দেশের শীর্ষস্থানীয় ১১টি ব্যবসায়ী সংগঠন।

গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবে আপত্তি তুলে শিল্পোদ্যোক্তারা বলছেন, গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে নতুন বিনিয়োগ আসবে না। একই সঙ্গে ব্যাহত হবে রফতানি ও কর্মসংস্থান। এরই মধ্যে শিল্প খাতে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস নিশ্চিত করতে না পারায় বৈদেশিক বিনিয়োগসহ শিল্পের উৎপাদন প্রবৃদ্ধি উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। এর মধ্যে শুধু আমদানীকৃত এলএনজির ওপর ভিত্তি করে শিল্প ও ক্যাপটিভ শ্রেণীর দাম বাড়ানো হলে শিল্প খাতকে বাঁচানোই চ্যালেঞ্জ হয়ে পড়বে। বেসরকারি খাতকে বাঁচাতে শিল্প খাতে মিশ্রিত (ব্লেন্ডেড) প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম নির্ধারণ করা উচিত ২৪ টাকা ৩৯ পয়সা।

বিইআরসির গত ২৬ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত শুনানির শুরুতে পেট্রোবাংলা ও ছয়টি গ্যাস বিতরণ কোম্পানির পক্ষ থেকে আলাদাভাবে প্রায় অভিন্ন প্রস্তাব তুলে ধরা হয়। শুনানিতে গ্যাস কোম্পানিগুলোর প্রস্তাব মূল্যায়ন করে একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করে বিইআরসি গঠিত কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি। আলাদা করে মূল্যবৃদ্ধির কোনো সুপারিশ না করলেও পেট্রোবাংলার রাজস্ব চাহিদা হিসাবের ভিত্তিতে কমিটির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, ‌প্রতি ইউনিট এলএনজি কিনতে পেট্রোবাংলার খরচ হবে ৭৯ টাকা ৩৪ পয়সা।

 

এরপর শিল্পের জন্য প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম প্রস্তাব করা হয় ৭৫ টাকা ৭২ পয়সা। এ প্রস্তাবে শুনানিতে হট্টোগোল সৃষ্টি হলে ব্যবসায়ীদের গণশুনানি-পরবর্তী মতামতের সুযোগ দেয় বিইআরসি।

 

পেট্রোবাংলা ও ছয়টি গ্যাস বিতরণ কোম্পানির প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, নতুন সংযোগের ক্ষেত্রে পুরো গ্যাস বিল হবে নতুন দামে। পুরনো গ্রাহকের ক্ষেত্রে অনুমোদিত লোডের বাড়তি ব্যবহৃত গ্যাসের বিল হবে বাড়তি দামে। যেসব শিল্প-কারখানা নতুন সংযোগের প্রতিশ্রুতি পেয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে অনুমোদিত লোডের ৫০ শতাংশ পর্যন্ত আগের দাম হবে। এর বাইরে বাকিটুকুর জন্য নতুন দাম কার্যকর করতে হবে।

এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করে ব্যবসায়ীরা চিঠিতে বলছেন, ‘গ্যাস আইন, ২০১০-এর প্রwস্তাবে সুস্পষ্টভাবে বেসরকারি খাত ও ব্যক্তিদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে প্রতিযোগিতামূলক বাজার সৃষ্টির কথা উল্লেখ রয়েছে। তবে নতুন প্রস্তাব অনুযায়ী গ্যাসের নতুন সংযোগ গ্রহণকারী ব্যক্তিরা কোনোভাবেই আগে সংযোগপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবেন না। তাই প্রস্তাবটি মূল্য নির্ধারণের মূলনীতির পরিপন্থী।’

গ্যাসের মূল্যহার পুনর্নির্ধারণের জন্য বিইআরসির চেয়ারম্যান বরাবর লিখিত প্রস্তাবে স্বাক্ষরকারী ব্যবসায়ীরা হলেন যথাক্রমে বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ, এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন, তৈরি পোশাক শিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর প্রশাসক মো. আনোয়ার হোসেন, বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বিটিএমএর সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল, মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) সভাপতি কামরান টি রহমান, ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি তাসকীন আহমেদ, নিট পোশাক শিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম, চামড়া পণ্য ও জুতা প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির (এলএফএমইএবি) সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর, সিরামিক শিল্পের মালিকদের সংগঠন বিসিএমইএর সভাপতি মইনুল ইসলাম স্বপন, প্লাস্টিক শিল্পের মালিকদের সমিতি বিপিজিএমইএর সভাপতি শামীম আহমেদ, তৈরি পোশাক শিল্পের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও মোড়কপণ্য সরবরাহকারী কারখানা মালিকদের সংগঠন বিজিএপিএমইএর সভাপতি মো. শাহরিয়ার, মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান ও এমডি মোস্তফা কামাল, সিটি গ্রুপের এমডি মো. হাসান ও উত্তরা মোটর করপোরেশন লিমিটেডের চেয়ারম্যান মতিউর রহমান।

চিঠিতে শুধু আমদানীকৃত এলএনজির ওপর ভিত্তি করে শিল্প ও ক্যাপটিভ শ্রেণীর নতুন সংযোগ ও বর্তমান সংযোগের লোড বৃদ্ধির ক্ষেত্রে গ্যাসের ট্যারিফ, মূল্য পুনর্নির্ধারণ বা বৃদ্ধির যেকোনো পদক্ষেপ গ্রহণ না করার জোর দাবি জানায়ে মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব খারিজ করার জন্য বিইআরসিকে অনুরোধ করেন ব্যবসায়ীরা।

এ বিষয়ে মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তফা কামাল বণিক বার্তাকে বলেন, ‘গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি হলে পণ্যের উৎপাদন থেকে শুরু করে পরিবহনসহ সব পর্যায়ে প্রভাব পড়বে। সরকার যেখানে মূল্যস্ফীতি কমাতে চাচ্ছে সেখানে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধিতে মূল্যস্ফীতি আরো বাড়বে, রফতানি খাত প্রতিযোগী সক্ষমতা হারাবে—সব মিলিয়ে একাধিক প্রভাব দেখা যাবে। একদিকে বলা হচ্ছে মূল্যস্ফীতি, দ্রব্যমূল্য কমাতে। আরেকদিকে ব্যাংক ইন্টারেস্ট বেশি, গ্যাসের মূল্য বেশি। এর সবগুলোর সঙ্গেই উৎপাদন জড়িত, যার প্রভাবে শিল্প প্রতিযোগী সক্ষমতা হারাবে। দ্রুত এবং বড় ধরনের প্রভাব পড়বে স্থানীয় শিল্পপণ্য উৎপাদনে। গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির উদ্যোগ শুধু আমদানীকৃত এলএনজির ওপর ভিত্তি করে, এটা কোনোভাবেই যৌক্তিক না।’

বিইআরসি চেয়ারম্যানের কাছে দেয়া ঠিঠিতে শিল্পোদ্যোক্তারা বলেন, গ্যাসের ট্যারিফ বৃদ্ধির এ প্রস্তাব শিল্প ও ব্যবসা ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সবাইকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দিয়েছে, যা শিল্প ও ব্যবসা এবং সার্বিকভাবে দেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হবে। একই সঙ্গে বিদ্যমান মূল্যহার (৩০ টাকা) কমিয়ে ইউনিটপ্রতি সর্বোচ্চ ২৪ টাকা ৩৯ টাকা নির্ধারণ করে শিল্প ও ব্যবসা খাতকে টিকিয়ে রাখা উচিত।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দাম পর্যালোচনার জন্য ভ্যাট, ডাবল ট্যাক্সসহ বেশকিছু মাপকাঠি আছে যেগুলো অবশ্যই বিবেচনায় নেয়া উচিত। যদি মিক্সিং হিসাব করেও পর্যালোচনা করা হয় তাহলেও দেখা যায় যে ২৪ টাকার ওপরে দাম আসে না। আমরা মনে করি, বিইআরসি যে শুনানি দিয়েছে এটাকে বন্ধ করা উচিত এবং গ্যাসের দামও কমিয়ে দেয়া উচিত।’

বাংলাদেশ সংবিধানের ২৭ ও ৩১ অনুচ্ছেদে আইনের দৃষ্টিতে সমতার সঙ্গেও উল্লিখিত প্রস্তাব অসংগতিপূর্ণ, বৈষম্যমূলক ও অসাংবিধানিক বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়। চিঠিতে উদ্যোক্তারা বলেন, ‘গ্যাস আইন, ২০১০’-এর ৭(২)(খ) ধারায় ‘একই শ্রেণীর গ্রাহকদের মধ্যে বৈষম্যহীনতার নীতি অনুসরণ’ করার কথা বলা হয়েছে। সে অনুযায়ী বিবেচনাধীন প্রস্তাবমতে, একই শ্রেণীর গ্রাহকের (শিল্প ও ক্যাপটিভ পাওয়ার) মধ্যে কেবল গ্যাস সংযোগ নেয়ার সময় অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন মূল্য (দ্বিগুণেরও বেশি) আরোপ করা ওই বিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

এছাড়া গ্যাস আইন, ২০১০-এর ৬(১) ধারা অনুযায়ীও গ্যাস সংযোগ গ্রহণের সময় বিবেচনায় সমজাতীয় কার্যক্রম পরিচালনাকারীদের মধ্য থেকে নতুন গ্রাহকশেণী সৃষ্টির কোনো সুযোগ নেই বলে দাবি করা হয় চিঠিতে।

চিঠি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি তাসকীন আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিসিআইয়ের উদ্যোগে আমরা সবাই মিলে একাধিক মিটিং করেছি। যার পরিপ্রেক্ষিতে বিসিআইয়ের নেতৃত্বে বিইআরসিতে অনুরোধ জানানো হয়েছে। আমরা এ পদক্ষেপকে সমর্থন করেছি।’