Image description
 

বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ গত ১৬ বছরে কয়েকগুণ বেড়েছে। শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার এই সময়ে আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে ৭৪ হাজার ৪০০ কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে ৩৯ হাজার ৩১০ কোটি টাকা পরিশোধ করা হলেও বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ও পরিশোধের চাপ দুটোই বেড়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশের মোট বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭৮ হাজার ১৮০ কোটি টাকা, যা ২০০৭-০৮ সালের তুলনায় ৩.৬৭ গুণ বেশি।

অর্থনীতিবিদদের মতে, এই ঋণের একটি বড় অংশ অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যয় হলেও অনেক প্রকল্প থেকে প্রত্যাশিত রাজস্ব আয় হয়নি। ফলে ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়ছে, যা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন- আগামী বছরগুলোতে এই ঋণের পরিমাণ আরও বাড়বে। কারণ সহজ শর্তের ঋণ কমছে এবং কঠিন শর্তের ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

ঋণ পরিশোধের ক্রমবর্ধমান চাপ

 

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ERD) তথ্য অনুযায়ী, গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে ব্যয় হয়েছে ৬ হাজার ৮০ কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় ২৭ শতাংশ বেশি। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এটি ছিল ৪ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ৩ হাজার ৬১০ কোটি টাকা।

 

বিশ্লেষকরা বলছেন, ঋণ পরিশোধের এই ক্রমবর্ধমান ব্যয় সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রমের জন্য বরাদ্দ কমিয়ে দিতে পারে। ফলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সামাজিক নিরাপত্তা খাতে সরকারি বিনিয়োগ হ্রাস পেতে পারে, যা দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতির জন্য নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (CPD) বিশিষ্ট ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেছেন, ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা ক্রমেই কমছে। রাজস্ব বৃদ্ধির তুলনায় ঋণের বোঝা দ্রুত বাড়ছে। এ প্রবণতা অব্যাহত থাকলে সরকারকে বাজেট ঘাটতি পূরণের জন্য নতুন ঋণ নিতে হবে, যা অর্থনীতির জন্য আরও চাপ সৃষ্টি করবে।

বড় প্রকল্পের বাস্তবতা ও চ্যালেঞ্জ

বাংলাদেশে গত এক যুগে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, বঙ্গবন্ধু টানেল ও রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ বেশ কিছু বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব প্রকল্প থেকে প্রত্যাশিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জিত হচ্ছে না, যার ফলে সরকারের ওপর ঋণ পরিশোধের বাড়তি চাপ তৈরি হচ্ছে।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (BIDS) সাবেক মহাপরিচালক ড. মোস্তাফা কে. মুজেরি বলেছেন, অনেক অবকাঠামো প্রকল্প লাভজনক হয়নি। ফলে এসব প্রকল্পের জন্য নেওয়া ঋণ পরিশোধ করতে সরকারকে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। যা অর্থনীতির দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।

বিশ্লেষকদের মতে, অনেক মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে সম্ভাব্যতা যাচাই ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ যথাযথভাবে করা হয়নি। ফলে প্রকল্পগুলোর আয়-ব্যয়ের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে এবং বৈদেশিক ঋণের চাপ বাড়ছে।

সুদের হার ও পরিশোধের মেয়াদ কমছে

বৈদেশিক ঋণের সুদের হার দ্রুত বাড়ছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে গড় সুদের হার ছিল ০.৯ শতাংশ, যা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২.৩ শতাংশে। অর্থাৎ, মাত্র কয়েক বছরে সুদের হার ২.৪৫ গুণ বেড়েছে।

একই সঙ্গে, ঋণের গড় পরিশোধের সময়সীমাও কমেছে। ২০১৬ সালে গড় পরিশোধের সময় ছিল ১২.৩ বছর, যা এখন কমে ৮.৫ বছরে নেমে এসেছে। ফলে সরকারকে কম সময়ের মধ্যে বেশি ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে, যা বাজেট ব্যবস্থাপনার ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করছে।