
প্রতি বছর ৮ মার্চ বিশ্ব নারী দিবস আসে। আমরা সমাজে নারীর অবস্থান নিয়ে আলাপ-আলোচনা করে থাকি। কেউ কেউ লিখি, কেউ কথা বলি, কিন্তু এই সমাজে তাদের বঞ্ছনার ইতিবৃত্ত বিশ্লেষণ করে সমূলে বিনাশ করার মতো কিছু কি আমরা করি? আমাদের স্বপ্ন , আমাদের আলোচনা — এর প্রয়োগিক বাস্তবতার মধ্যে যোজন যোজন ফারাক। নারী শিক্ষার পথ প্রদর্শক বেগম রোকেয়া সুলতানার স্বপ্নে তিনি নারীর জন্য একটি মুক্ত পৃথিবী স্বপ্নে দেখেছিলেন । বিজ্ঞানের এই পূর্ণতার যুগে তার সেই স্বপ্নের পৃথিবীতে সুলতানাদের বিচরণের কথা ছিল, কিন্তু শতরকমের নিষ্ঠুর বাস্তবতা সুলতানাদের এই মুক্ত জীবনের স্বপ্ন ভেঙে দেয় , এখনও সুলতানারা নীরবে কাঁদে চোখের সামনে নিজেদের স্বপ্নের অপমৃত্যু দেখে ।
সমাজ, সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে নারীরা মহল থেকে বেরিয়েছে। শিক্ষার সূর্যালোক অনেকের অন্তঃপুর আলোকিত করছে তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু উচ্চশিক্ষা বা উচ্চ মাধ্যমিকের পর থেকে শিক্ষায় নারীরা এখনো বাংলাদেশে অনেক পিছিয়ে। কিন্তু একটা বলয় পর্যন্ত গিয়ে অধিকাংশ নারী সামনের দিকে আর এগোতে পারছেন না। আছে নানান প্রতিবন্ধকতা। কন্যাশিশুকে বাড়ির পাশের প্রাইমারি স্কুলে কিংবা হাইস্কুলে ভর্তি করাতে বা পড়াতে অভিভাবকরা যতটা আগ্রহী থাকেন, এর পরের ধাপে কন্যাশিশুর পেছনে তারা আর বিনিয়োগ করতে চান না। এর পেছনে রয়েছে সমাজে প্রচলিত স্টেরিওটাইপ থেকে শুরু করে আরও নানান কারণ। আর তাই শিক্ষার পরবর্তী ধাপগুলো পেরোতে আমাদের দেশে অধিকাংশ নারীই এখনো হিমশিম খাচ্ছেন বা সে পর্যন্ত পৌঁছাতে পারছেন না। স্কুলের গণ্ডি পেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে ধীরে ধীরে মেয়েদের শিক্ষায় অংশগ্রহণ কমতে থেকে এবং সরকারি পরিসংখ্যান বলছে— স্নাতকোত্তর পর্যায়ে এসে সেটি ৩০ শতাংশের ঘরে এসে পৌঁছায়। এর পেছনের কারণের লিস্ট বেশ দীর্ঘই বলা যায়। দরিদ্র, অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে দেওয়া, পরিবারের রক্ষণশীল অনুশাসন, সামাজিক নিরাপত্তার অভাব, নারীদের বিরুদ্ধে সমাজের প্রচলিত ট্যাবু— এসবই যদি প্রাইম ধরে আলোচনা করি, তাহলেও এই লেখা পাতার পর পাতা ছাডিয়ে যাবে।
বেশিরভাগ অভিভাবক সংসারের স্বচ্ছলতার অভাবে উঁচুস্তরে যাওয়ার পর মেয়ের পড়াশোনা বন্ধ করে দেন। তা ছাড়া বেশিরভাগ রক্ষণশীল অভিভাবক সরাসরি নারীদের উচ্চ শিক্ষার বিরোধী, অনেক সময় তারা ধর্মীয় শিক্ষাকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। । আবার অনেক বাবা -মা মেয়েদের বেশি দূর আর না পড়িয়ে উপযুক্ত বয়স মনে করে ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সে বিয়ে দিতে আগ্রহী থাকেন । অনেকেই বিয়ের পর উচ্চশিক্ষা চালিয়ে যেতে চাইলেও নারীর মা হওয়া, সংসারের সবার প্রতি দায়িত্ব পালন ইত্যাদি করতে গিয়ে কোনোটাই ঠিকমতো না হলে পড়াশোনাটাই বাদ দিয়ে দেন। দরিদ্র আর অল্প বয়সে বিয়ের প্রধান কারণ হলেও নারীর উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পথে আরেকটি অন্তরায় হলো সামাজিক নিরাপত্তার অভাব কিংবা আরও খোলাখুলি বললে নারীরই বিরুদ্ধে যৌন সহিংসতা বা যৌন নিপীড়ন । কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা-যাওয়ার পথে যথাযথ সামাজিক সুরক্ষা বা নিরাপত্তা না থাকার কারণে অনেক অভিভাবক নারী শিক্ষার্থীকে উচ্চশিক্ষা নিতে কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে দিতে আগ্রহী প্রকাশ করেন না। গণপরিবহনে নারীর নিরাপত্তার অভাব, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পর্যাপ্ত আবাসন সুবিধার অভাবে অনেক নারী শিক্ষার্থী আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ থেকে বিরত থাকে বা ভর্তি হলেও পড়াশোনা চালিয়ে নিয়ে যেতে পারে না— ঝরে পড়ে । বিদ্যাপীঠে নারীর পর্যাপ্ত নিরাপত্তা , যৌন নিপীড়ন সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করা গেলে আমার বিশ্বাস অভিভাবকদের আস্থা অর্জন করা সহজ হবে এবং তারা তাদের মেয়েকে উচ্চ শিক্ষার্থে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পাঠাতে খুব বেশি দ্বিধাগ্রস্ত হবেন না ।
উচ্চশিক্ষায় নারীর পিছিয়ে থাকার আরেকটি কারণ না বললেই নয়— নারীর নিজের ব্যক্তিগত অনীহা বা লড়াই করার স্বদিচ্ছার অভাব । অনেক প্রতিকুলতা পেরিয়ে লড়াই করে অনেক নারী কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা চালিয়ে নিয়ে গেলেও অনেকেই নিজের ইচ্ছার সঙ্গে পেরে উঠেন না। এই ক্ষেত্রে বলা যায়- ভগিনিরা জাগিতে চাহেন না। নারীরা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সাগ্রহে অংশগ্রহণ করলে দেশের তথা পরিবারের আর্থিক অবস্থান বদলে যায় বলা বাহুল্য। এভাবে জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি অংশ উচ্চশিক্ষা থেকে ঝরে পড়া একটি জাতির জন্য কিন্তু সুফল বয়ে আনে না।
যে অল্পসংখ্যক নারী শেষ পর্যন্ত উচ্চশিক্ষায় টিকে যান, তাদের জন্য রয়েছে চাকরির ক্ষেত্রে নানান প্রতিবন্ধকতা। দেশে নারীবান্ধব চাকরির রয়েছে খুবই নগন্য পরিমাণে। নারীরা সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মাতৃত্বকালীন ছুটি ভোগ করেন বলে অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের নিয়োগ পর্যন্ত দিতে চায় না। চাকরির প্রমোশনের ক্ষেত্রে চলে নানান ধরনের বৈষম্য । চাকরি ক্ষেত্রে প্রতিকূল পরিবেশ নারীকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে তেমন তাড়িত করে না । উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পর কর্মজীবনের নানান জটিলতা, পারিবারিক পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়ানো , সন্তান লালনপালন, সবার পরিচর্যা অর্থাৎ পড়াশোনা করলে ঘরে-বাইরে দুদিকই সামলাতে হয় এই চ্যালেঞ্জ নিতে হয় বলে অনেক নারী শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা ও পরে চাকরিতে উদ্বুদ্ধ হন না। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এই চরম উৎকর্ষের যুগে যেখানে প্রত্যেক মানুষের মেধার সর্বোচ্চ মূল্যায়ন করা হয়, সেখানে পুরুষ সঙ্গীদের একটু সহযোগিতার হাত নারীদের পারে আকাশছোঁয়ার সাফল্য এনে দিতে। কিন্তু কয়টা পরিবারেই পুরুষেরা নারীদের সহযোগী হয়ে পাশে থাকছেন? বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পুরুষেরা নারীর বাইরে কাজ করার ব্যাপারে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করছেন। নারীকে বাইরে কাজ করার চেয়ে ঘরে থেকে সন্তানদের লালনপালন, পড়াশোনার দেখভাল করা, পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্যদের যত্ন-আত্তি করার কাজে বেশি মনযোগী হতে বলছেন। এমন অনেক বিবাহিত নারী শিক্ষার্থী আমরা পাই, যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে পরিবারের কাজের চাপে নিয়মিত ক্লাস করতে পারে না, পরীক্ষায় বসতে পারে না। অনেকেই পড়াশোনা চালাতে না পেরে ঝরে পড়ে । অনেকে অনিয়মিত হিসেবে নাম লিখায়। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা পরিবারের সব কিছু ম্যানেজ করে আসলে ক্লাস, পরীক্ষায় বসতে পারছে না। কেউ কেউ অল্প বয়সে মা হয়ে যায়। ফলে বাসায় সন্তানকে রেখে ক্লাস করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না ।
এভাবে দেখা যায় সমূহসম্ভাবনা থাকার পরও অনেক নারী শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা চালিয়ে যেতে পারে না । যারা এই ধাপ উন্নীত হন, তারা উচ্চতর ডিগ্রি নিতে দেশ-বিদেশে পাড়ি জমাতে পারেন খুবই নগণ্য সংখ্যায় একই কারণে । সামি-সন্তান দেশে রেখে বাইরে গিয়ে উচ্চতর পড়াশোনা করার কথা ভাবতেই পারেন না অনেক নারী । অথচ তাদের মাঝে নিহিত সমূহসম্ভাবনা। তারা চাইলে পরিবার, দেশ ও জাতিকে বিভিন্নভাবেই সমৃদ্ধ করতে পারেন। যুগ যুগ ধরে নারীকে পরিবার, সমাজ , সম্পর্কগুলো যে শৃঙ্খল পরিয়ে রেখেছে তা তাকে মুক্ত পাখি হয়ে নিজের সম্ভাবনার আকাশে কখনই উড়তে দেবে না। বেগম রোকেয়ার মতো এখানে আমিও একটা কথাই বলতে চাই— ভগিনিদের জাগতে হবে নিজ উদ্যোগেই। এই সামাজিক সংস্কারেরে কারাগার যা নারীকে মহলেই আটকে রেখেছে তা একমাত্র সে নিজেই ভেঙে আসতে পারে । আত্মরক্ষার কৌশল রপ্ত করে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে নিজেকে কর্মক্ষেত্রে প্রমাণ করেই নারী সমাজে, রাষ্ট্রে নিজের অবস্থান পোক্ত করতে পারে । আমি বিশ্বাস করি, নারী শিক্ষা মানেই নারী মুক্তি নয়, কর্মক্ষেত্রে নারীর নিজেকে প্রমাণ করা আবশ্যক। কাজ করে অর্থ উপার্জন করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে নারীকে । পরিবারের প্রতিটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ায় নারীর অগ্রণী ভূমিকা থাকা জরুরি । শিক্ষা ও আর্থিক সংগতি – এই দুইয়ে মিলে নারীমুক্তি।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।