
দেশকে অস্থিতিশীল করতে পরিকল্পিতভাবে ‘মব’ তৈরি করে অরাজকতা সৃষ্টির চেষ্টা চালানো হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছুটা নমনীয়তার সুযোগ নিয়ে আওয়ামী লীগের দোসরদের প্ররোচনায় একটি গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে কাজটি করছে বলে ধারণা করছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা। এমনকি কয়েকটি গোয়েন্দা রিপোর্টেও উঠে এসেছে এমন তথ্য। পুলিশ থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, চোর-ডাকাত-ছিনতাইকারী এমনকি সাধারণ মানুষও ‘মব জাস্টিসের’ শিকার হচ্ছেন। বাদ যাচ্ছেন না বিদেশী নাগরিকরাও।
মানবাধিকার সংগঠনগুলোর রিপোর্টেও বলা হচ্ছে ৫ আগস্টের পর দেশে মব ভায়োলেন্সের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ধরনের অপরাধ বেড়ে যাওয়ায় একের পর এক বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হচ্ছে দুষ্কৃতকারী ছাড়াও নিরপরাধ মানুষ। এর আগে এমন ঘটনা ঘটলেও তার সংখ্যা ছিল তুলনামূলক কম। কিন্তু ৫ আগস্টের পর প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও এ ধরনের ঘটনা ঘটছে, যা উদ্বেগের কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। হঠাৎ কে কখন মবের শিকার হবেন সেই আতঙ্ক কাজ করছে সাধারণ মানুষের মধ্যে।
গোয়েন্দা রিপোর্টে বলা হচ্ছে, ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মী, পেশাদার অপরাধী ও সুযোগসন্ধানী মহল পরিকল্পিতভাবে ‘মব’ সৃষ্টি করে হামলা, ডাকাতি, লুটপাট, হত্যাকাণ্ডসহ গুরুতর অপরাধের মাধ্যমে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা করছে। তারা বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের নাম ব্যবহার করে আওয়ামী লীগ বিরোধী স্লোগান দিয়ে পরিকল্পিতভাবে এসব মব সৃষ্টি করছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তা ও সরকারের সদিচ্ছার অভাবে সুযোগ-সন্ধানী মহল পরিকল্পিতভাবে এ ধরনের মব সৃষ্টির সুযোগ পাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ৫ আগস্টের পর গণবদলিতে পুলিশ আরো অস্বস্তিতে ভুগছে। তারা কাজে আগ্রহী হচ্ছে না। পুলিশের কাজের বিষয়টা এবং তাদের বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্ত পরিষ্কার করে তাদেরকে কাজের আস্থায় আনতে সহায়তা করতে হবে। কেননা দুর্বল আইনের শাসন ও কোনো পদক্ষেপ নিতে অনীহার কারণেই সঙ্ঘবদ্ধ পিটুনির প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়ে থাকে।
কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠন ও পুলিশ সুত্রে জানা গেছে, চলতি বছর দেশে মব জাস্টিসের নামে বেশ কিছু সঙ্ঘবদ্ধ পিটুনি বা গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে। দলবদ্ধ পিটুনিতে মৃত্যুর সংখ্যা পূর্ববর্তী বছরগুলোর তুলনায় বেড়েছে। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারিতে সঙ্ঘবদ্ধ পিটুনিতে নিহতের সংখ্যা ছিল ১৬ জন। যার মধ্যে শুধু রাজধানী ঢাকায় সর্বোচ্চ সাতজন। আসকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে সারা দেশে মারা যায় ১৪৬ জন, ২০২৩ সালে ৫১ জন, ২০২২ সালে ৩৬ জন, ২০২১ সালে ২৮ জন এবং ২০২০ সালে মারা যায় ৩৫ জন। অন্য দিকে মানবাধিকার সংগঠন ‘মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন’র তথ্য অনুযায়ী, গত জানুয়ারি মাসে সারা দেশে দলবদ্ধ পিটুনিতে নিহত হয় ২১ জন। ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে মব জাস্টিসের নামে হত্যার ঘটনায় যতদূর জানা গেছে তাতে মৃত্যু হয়েছে সাতজনের। তবে মার্চের প্রথম চার দিনে মব জাস্টিসের নামে মারা যান দুইজন।
গত মঙ্গলবার রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ‘মব’ সৃষ্টি করে ইরানের দুই নাগরিকসহ তিনজনকে মারধরের ঘটনা ঘটে। পরে পুলিশ দুই বিদেশী নাগরিককে উদ্ধার করে হাসপাপাতালে নিয়ে যায়। আহত ইরানের দুই নাগরিক হলেন মোহাম্মদ আহমদ (৭৪) ও তার নাতি মো: মেহেদী (১৮)। তারা বাংলাদেশে ঘুরতে এসেছেন। আহত অন্যজনের খোঁজ পাওয়া যায়নি। তিনি দুই বিদেশী নাগরিককে তার গাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন। ঘটনার পর তিনি পালিয়ে যান।
পুলিশের তথ্য মতে, ওই দিন দুপুরে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় বিদেশী মুদ্রা বদলে বাংলাদেশী টাকা নিতে একটি প্রতিষ্ঠানে এসেছিলেন ইরানের দুই নাগরিক। ওই সময় সেখানে থাকা ব্যক্তিদের সাথে মুদ্রা বিনিময় নিয়ে তর্ক হয়। এর জেরে ইরানের দুই নাগরিককে ছিনতাইকারী বলে ‘মব’ সৃষ্টি করা হয়। পরে ৯৯৯ এ কল পেয়ে পুলিশ তাদের উদ্ধার করে।
চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় ‘ডাকাত সন্দেহে’ গণপিটুনিতে দুইজন নিহত হয়েছেন। গত সোমবার রাত ১০টার দিকে সাতকানিয়ার এওচিয়া ইউনিয়নের ছনখোলা পশ্চিমপাড়া এলাকায় এ ঘটনায় আরো চারজন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। নিহত দুইজন হলেন উপজেলার কাঞ্চনা ইউনিয়নের মধ্যমকাঞ্চনা এলাকার নেজাম উদ্দিন (৪৬) এবং একই ইউনিয়নের গুরগুরি এলাকার আবু ছালেক (৩৮)। নিহত দুইজন জামায়াতে ইসলামীর সদস্য ছিলেন বলে জানা গেছে। পুলিশ জানায়, ‘রাতে খবর পেয়ে আমরা ছনখোলা গ্রামে গিয়ে দুইজনের লাশ উদ্ধার করি। নিহত দুইজনই স্থানীয় গ্রামবাসীর হামলা-গণপিটুনিতে মারা গেছেন বলে প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হয়েছি।
অন্য দিকে চট্টগ্রাম নগরীতে ‘উচ্ছৃঙ্খল’ কিছু যুবকের মারধরের শিকার হয়েছেন পুলিশের একজন এসআই। যুবকরা তাকে ‘ভুয়া পুলিশ’ অভিহিত করে হেনস্থার পর তার কাছে থাকা ওয়াকিটকি, মোবাইল ও মানিব্যাগ নিয়ে যায়। এ ঘটনা আবার তারা মোবাইলে ভিডিও করে রাখে। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি রাতে নগরীর পতেঙ্গা থানার আউটার রিং রোডে সমুদ্র সৈকত এলাকায় এ ঘটনা ঘটেছে। পরে স্থানীয় জনতা দুইজনকে আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। গ্রেফতার দুইজন হলো, সাইমন (২৭) ও আলী ইমাদ (২২)। তাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া ওয়াকিটকি, মোবাইল ও মানিব্যাগ উদ্ধার করা হয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। পরে ঘটনার সাথে জড়িত ১২ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
জানা গেছে, ‘সৈকতে বসে কয়েকজন যুবক মাদক সেবন করছে বলে তথ্য আসে ট্রিপল নাইনে (৯৯৯)। সেখানে আউটার রিং রোডে চেকপোস্টে ডিউটি করছিলেন এসআই ইউসুফ। ট্রিপল নাইনের তথ্যে তিনি এগিয়ে গেলে দুই যুবক প্রথমে তাকে ভুয়া পুলিশ বলে চেঁচামেচি শুরু করে। এরপর তারা নিজেদের আরো লোকজন সেখানে নিয়ে আসেন। তারা এসআই ইউসুফকে ঘিরে মব ভায়োলেন্সের মতো ঘটনা ঘটায়। ইউনিফর্ম পরা একজন পুলিশ সদস্য হেনস্থার শিকার হচ্ছেন দেখে সমুদ্রসৈকত এলাকার লোকজন সেখানে যান। তারা হেনস্থাকারীদের দুইজনকে ধরে পিটুনি দেন। এ ঘটনায় পতেঙ্গা থানায় একটি মামলা হয়েছে। ঘটনায় জড়িত ১২ জনের সবাইকে আটক করেছে পুলিশ।
এ দিকে রাজধানীর গুলশানে মধ্যরাতে এক বাড়ির দরজা ভেঙ্গে ঢুকে পড়ে একদল ছাত্র-জনতা। তারা দাবি করেন, এটি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা মরহুম এইচ টি ইমামের ছেলে সাবেক এমপি তানভীর ইমামের বাড়ি। তাদের দাবি- বাড়িটিতে অবৈধ অস্ত্র ও ছাত্র-জনতাকে হত্যাকারীরা লুকিয়ে আছে এমন তথ্যের ভিত্তিতে তারা সেখানে তল্লাশি চালাতে ঢুকেছেন। গত মঙ্গলবার রাত ১২টার দিকে গুলশান ২-এর ৮১ নম্বর সড়কের এইট-আই নম্বর বাড়িতে এ অভিযান ও তল্লাশি চালানো হয়। রাত ১২টার দিকে মিছিল নিয়ে তানভীর ইমামের বাসায় প্রবেশের চেষ্টা করেন। এ সময় বাড়ির সিকিউরিটি গার্ড তাদের বাধা দিলে গেট টপকে তারা ভেতরে ঢোকেন।
বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক বলেন, এটি এইচ টি ইমামের বাড়ি নয়, এটা রহমান সাহেবের বাড়ি। রহমান সাহেবের মেয়ের সাথে তানভীর ইমামের বিয়ে হয়েছিল অনেক আগে। ২০০১ সালের দিকে তাদের বিচ্ছেদ হয়ে যায়। রহমান সাহেব ও তার স্ত্রী মারা গেছেন। তার মেয়ে এই বাড়িতে থাকেন। হয়তো তার মেয়েকে হেনস্তা করে লুটপাট করতে কেউ উসকানি দিয়ে এই ঘটনা ঘটিয়েছে। গুলশান থানা পুলিশ বলছে, বাসায় আওয়ামী লীগের দোসর লুকিয়ে আছে এবং টাকা ও অস্ত্র মজুদ আছে এমন অভিযোগ তুলে কিছু লোকজন বাসাটির দরজা ভেঙে ভেতরে ঢোকে। খবর পেয়ে আমরা যাওয়ার সাথে সাথে তারাও নেমে যায়, সেনাবাহিনীর টিমও আসে।
জানা গেছে, ৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগের তৈরি কিশোর গ্যাং দিয়ে পরিচালনা করা হচ্ছে মব। এর আগে ‘কিশোর গ্যাং’ এর কর্মকাণ্ড বলে ব্যাপক আলোচনায় ছিল। আওয়ামী লীগের কোনো না কোনো নেতার পালিত বাহিনী হিসেবে কাজ করত। থানা পুলিশ এসব কিশোর গ্যাং ধরেও রাখতে পারত না। ৫ আগস্ট ছাত্র জনতার সাথে সরকার পতনের আন্দোলনে আরো বহু মানুষ অংশ নেয়। সাধারণ ছাত্রজনতার ভিড়ে এসব কিশোর গ্যাংও একাকার হয়ে যায়।
উত্তরা ৬ নম্বর সেক্টরে এক দম্পত্তিকে সামান্য কথার কাটাকাটির জেড়ে কুপিয়ে আহত করে। পরে জানা গেছে এরা কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য এবং উত্তরার যুবলীগের এক নেতার অনুসারী। ৫ আগস্টের পর থেকে ডাকাত আতঙ্কে কাটে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন অঞ্চল। সেনাবাহিনী এসব ব্যাপকভাবে দমন করে। কিন্তু দেখা যায় যারা ডাকাতি করতে বিভিন্ন গ্রুপে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে তারা মূলত বিভিন্ন এলাকার অপরাধী চক্র। যারা বিগত সরকার দলের সমার্থক। সেটাই এখনো চলমান। কাজের ধরন পরিবর্তন হয়েছে, তবে সুযোগ পেলে এসব অপরাধীচক্র সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং সুযোগ খোঁজে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মানবাধিকার কর্মী ও গুম সংক্রান্ত কমিশনের সদস্য নুর খান লিটন বলেন, এটি দেশে চলমান অস্থিরতার বহিঃপ্রকাশ। দুর্বৃত্তরা মনে করছে এই সময়ে সঙ্ঘবদ্ধভাবে কোনো অরাজকতা ঘটিয়ে পার পাওয়া যাবে। তারই সুযোগ নিয়ে মব সৃষ্টি করছে। তিনি বলেন, দুর্ভাগ্যবশত এসবের পেছনে কিছু রাজনৈতিক দলের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যাচ্ছে, যা রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিতদের এখনই বন্ধ করতে হবে। শুধু বক্তৃতায় নয়, কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে। যাতে অপরাধীরা বুঝতে পারে যে অপরাধ করে পার পাওয়া যাবে না। তিনি আরো বলেন, এটা বন্ধ করা না গেলে আইনের শাসনে বাধা ও গণতন্ত্র পুনর্জাগরণ থমকে যাবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া) এনামুর রহমান সাগর বলেন, মব জাস্টিস কোনোমতেই সমর্থনযোগ্য নয়। আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। বিশৃঙ্খলাকারীদের কোনো ছাড় দেয়া হবে না। কেউ অপরাধ করলে আইন নিজের হাতে তুলে না নিয়ে পুলিশকে জানাতে হবে। পুলিশ এক্ষেত্রে অবশ্যই দ্রুততার সাথে রেসপন্স করবে। পাশাপাশি জনগণকেও এসব ক্ষেত্রে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।