
জমিজমা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মালিকানার ভাগাভাগি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিপক্ষের সঙ্গে বিরোধ চলছিল অনলাইন গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খান মো. আক্তারুজ্জামানের। সেই বিরোধের জেরেই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ভাষানটেক থানার এক হত্যা মামলার আসামি করা হয় আক্তারুজ্জামানকে। মামলার এজাহারে তাকে আওয়ামী লীগ নেতা দাবি করে আওয়ামী লীগের ভুয়া পদ-পদবি থাকার কথা উল্লেখ করা হয়।
পরে সেই হত্যা মামলার বাদী ঢাকার সিএমএম (চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট) আদালতে হলফ-নামার মাধ্যমে জানিয়েছেন, এলাকার কতিপয় ব্যক্তির যোগসাজশে তার অজ্ঞাতসারে ভুলবশত আক্তারুজ্জামানের নাম মামলায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। মামলা থেকে আক্তারুজ্জামানের নাম প্রত্যাহারেরও আবেদন করেন তিনি। এ আবেদনটি গৃহীতও হয়। এরপরও অদৃশ্য হাতের ইশারায় গত ১৩ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বাবর রোডের অফিস থেকে আক্তারুজ্জামানকে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পরে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠোনো হয় তাকে।
স্বজনদের অভিযোগ, গ্রেপ্তারের পর একে একে তার ব্যবসা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দখলে নিচ্ছে প্রতিপক্ষ গ্রুপ। অথচ ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে র্যাবের হাতে গুম হয়েছিলেন ব্যবসায়ী আক্তারুজ্জামান। গুমের হোতা র্যাবের গোয়েন্দা শাখার তৎকালীন প্রভাবশালী কর্মকর্তা জিয়াউল আহসান ২২ কোটি টাকার বিনিময়ে মুক্তি দেন আক্তারুজ্জামানকে। এ ঘটনায় গুমসংক্রান্ত কমিশন অব ইনকোয়ারিতে অভিযোগও (অভিযোগ নম্বর ১৭০০, তাং-০৬/০১/২০২৫) দিয়েছেন তিনি, যার তদন্ত চলমান আছে। এরপরও ভুয়া মামলায় আক্তারুজ্জামানের গ্রেপ্তারে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তারা। অহেতুক কাউকে হয়রানি করা হবে না, অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে বাববার এমন আশ্বাসের পরও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ভুয়া মামলায় ব্যবসায়ী আক্তারুজ্জামানের গ্রেপ্তার নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে।
জানা গেছে, ডিএমপির ভাসানটেক থানার এক মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন আক্তারুজ্জামান। গত বছরের ৫ আগস্ট সন্ধ্যায় রাজধানীর মিরপুরের ১৪ নম্বর সড়কের মোড়ে ফিলিং স্টেশনের সামনে আনন্দ মিছিলে গুলিতে নিহত হন পোশাক শ্রমিক মো. ফজলু (৩১)। এ ঘটনায় ফজলুর ভাই মো. সবুজ বাদী হয়ে ডিএমপির ভাসানটেক থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলার এজাহারনামীয় ১৬৫ আসামির মধ্যে ২২ নম্বর আসামি করা হয় খান মো. আক্তারুজ্জামানকে। মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, আক্তারুজ্জামান ঢাকা মহানগর উত্তর আ.লীগের সহসভাপতি। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওই কমিটির ১১ জন সহসভাপতিসহ ২৫ সদস্যের মধ্যে কোথাও আক্তারুজ্জামানের নাম নেই।
মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে বাদী মো. সবুজ বলেন, আমার ভাইয়ের হত্যার সঙ্গে খান মো. আক্তারুজ্জামানের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। তার নাম কীভাবে মামলায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে তাও আমার জানা নেই। আমি আদালতে হলফ-নামার মাধ্যমে আক্তারুজ্জামানের নাম মামলা থেকে বাদ দেওয়ার আবেদন করেছি।
আক্তারুজ্জামানের ব্যক্তিগত সহকারী জাহিদুল ইসলাম রাজু জানান, ব্যবসায়ীক প্রতিপক্ষের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে আক্তারুজ্জামান গ্রেপ্তার হয়েছেন। গ্রেপ্তারের পর থেকেই রাজধানীর ইসিবি চত্বরে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দখলের চেষ্টা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে একটি দোকানের তালা ভেঙে দখল নিয়েছে প্রতিপক্ষরা। আক্তারুজ্জামান গ্রেপ্তারের পর থেকেই বিরোধী পক্ষ বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে মিথ্যা তথ্য দিয়ে সামাজিকভাবে হেয় করছে।
জাহিদুল ইসলাম আরও বলেন, স্যার বিএনপি পরিবারের সন্তান। বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে গুমের শিকার হন। গুম সংক্রান্ত কমিশনে স্যারের করা আবেদনটি বিবেচনায় নিতে সুপারিশ করেছেন মাগুরা জেলা বিএনপির সদস্য সচিব মো. মনোয়ার হোসেন খান। অথচ এখন স্যারকে (আক্তারুজ্জামান) বিরোধী পক্ষ আওয়ামী লীগ বানানোর চেষ্টা করছে।
আক্তারুজ্জামানের বাড়ি মাগুরা জেলার শ্রীপুর উপজেলায়। তার বাবা খান মোহাম্মদ আইয়ুব আলী মাগুরা জেলা বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। বিএনপি পরিবারের সন্তান হওয়ায় বিগত সময়ে নানা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তিনি। ২০১৭ সালে ডিএমপির ক্যান্টনমেন্ট থানায় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের করা মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে জেলও খেটেছেন। এ ছাড়া ২০১৫ সালে র্যাবের হাতে গুম হন তিনি।
গুমসংক্রান্ত কমিশনে করা অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, ‘লে. কর্নেল আজাদ (২০১৭ সালে মারা যান) ২০১৫ সালের ১৮ ডিসেম্বর ধানমন্ডি ২৭ নম্বর থেকে আক্তারুজ্জামানকে চোখ বেঁধে তৎকালীন র্যাবের গোয়েন্দা শাখার প্রধান জিয়াউল আহসানের নেতৃত্বে একটি কালো গাড়িতে অপহরণ করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যান। পরে তিনি জানতে পারেন র্যাব হেডকোয়ার্টার্সের বহুল আলোচিত ‘আয়নাঘর‘ ছিল স্থানটি। সেখানে ৩ দিন বন্দি ছিলেন। সেখানে থাকাবস্থায় ক্রসফায়ারে হত্যার ভয় দেখিয়ে ৩০ (ত্রিশ) কোটি টাকা ও জমি দাবি করেন র্যাবের সংশ্লিষ্ট পদস্থ কর্মকর্তা। এরপর র্যাবের নজরদারিতে থেকে কয়েক দফায় নগদ ২২ কোটি টাকা দিয়ে জীবন বাঁচান। তার ও তার স্ত্রীর নামে থাকা জমি বিক্রি করে টাকাগুলো দিয়েছিলেন তিনি।
পরে বিভিন্ন সময়ে ভয় দেখিয়ে তার বেশ কিছু জমিও রেজিস্ট্রি করে দিতে বাধ্য করে। সে সময় আক্তারুজ্জামানের উপর অমানবিক নির্যাতন চলে। শরীরে ইলেকট্রিক শক দেওয়া হয়। যার ক্ষত এখনো বয়ে বেড়াচ্ছেন। র্যাব কর্মকর্তাকে টাকা দেওয়ার অডিও রেকর্ড, সিসিটিভি ফুটেজের কিছু তথ্য-প্রমাণ অভিযোগের সঙ্গে যুক্ত করে দিয়েছেন ব্যবসায়ী আক্তারুজ্জামান।