Image description

বৃহস্পতিবার দুপুর। মিরপুর ২, ষাট ফিট রোড। সড়কের ডিভাইডারে হেলান দিয়ে বসে আছেন এক নারী। চিন্তিত, চোখে-মুখে বিরক্তি। কেন বসে আছেন? উত্তর দিলেন না। দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করায় বললেন, কাকে বলবো? বলে কী লাভ?

তবুও বলেন যদি। বললেন, ‘সকাল ৮টায় আসছি। এখন বাজে বেলা ১টা। ট্রাকের খবর নেই। শুনেছিলাম ন্যায্যমূল্যে মাল (পণ্য) দেবে।’ বলেই কেঁদে ফেললেন তিনি।

নাম শাহেদা বেগম। গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইল। রাজধানীতেই থাকেন। স্বামী বৃদ্ধ। ঢাকায় বিএডিসিতে দারোয়ানের চাকরি করতেন। ছাঁটাই হয়েছেন বেশ কদিন আগে। মেলেনি কানাকড়িও।

শাহেদা বেগম বললেন, ‘এখন ইনকাম নেই। বৃদ্ধ মানুষ কী করবে। ছেলে নেই। একটা মেয়ে, সাভারে থাকে। তারই টানাটানির সংসার। ঢাকার বাসাও ছেড়ে দিছি। মাসে ছয় হাজার টাকা ভাড়া। মেয়ের বাসায় গিয়ে থাকবো কয়েকদিন। তারপর আল্লাহ যা লিখে রাখছে কপালে। কিছু টাকা কমে বাজার-সদাই করার জন্য প্রায় আসি এখানে। আজ পর্যন্ত একদিনও নিতে পারি নাই। যেদিন ট্রাকের দেখা পাই সেদিন অনেক ভিড় হয়। ধাক্কাধাক্কি করে। ভালো ভালো অনেক মানুষ আসে। তাদের সঙ্গে পারি না শক্তিতে। কাড়াকাড়ি লেগে যায়। তাছাড়া শরমও লাগে। চোখমুখ ঢেকে আসি। কী করবো! দুইটা খাওয়াতো লাগে। বাঁচবো কী করে! এক সপ্তাহ আগে অটোরিকশা থেকে পড়ে গেছি। হাতটা ব্যথায় নাড়াতে পারি না। ডাক্তার দেখাইনি। বুকেও ব্যথা।’

শাহেদা কথা শেষ করে চোখ মুছে বললেন, ‘আমার বাটন মোবাইল। আপনাদের হাতে তো টাচফোন। একটু সার্চ দিয়েন দেখেন না আশপাশে কোথাও ট্রাক আছে কিনা!’

পাশ থেকে মোনোয়ারা নামের আরেক নারী বললেন, ‘চলো বুবু চলে যাই। আজও পাবো না। ভিক্ষা তো আর করতে পারি না। আগারগাঁও গেছিলাম সেদিন। ধাক্কা দিয়ে একজন ফেলে দিছে। অজ্ঞান হওয়ার মতো অবস্থা। হাসিনার (সাবেক পতিত সরকার) সময় কতবার চেষ্টা করছি। একটা কার্ড করতে পারিনাই। দেয়নাই।’


শাহেদা বা মনোয়ারাই নন শুধু। তাদের মতো অন্তত জনা বিশেক নারী বসে আছেন এই সড়কটার দুই ধারে। বেলা তখন ১টা। মাথার উপর উত্তপ্ত সূর্য। তাদেরই একজন রাবেয়া। বললেন, ‘আপনারা কি কেউ জানাইতে পারেন কখন ট্রাক আসবে? রাবেয়ার চার ছেলে-মেয়ের আলাদা সংসার।’ বললেন, ‘তারাই চলতে পারে না। তাগো কাছে যাই কী কইরা। স্বামী আর আমি। যেইখানে দেখি ট্রাকে বিক্রি করে সেখানেই লাইনে দাঁড়াই। কিন্তু নিতে তো পারি না। বেশিক্ষণ দাঁড়াইতেও পারি না। মাথা ঘুরে। লাইন শেষ হওয়ার আগেই চাল ডাল তেল ফুরায় যায়। কতক্ষণ যুদ্ধ করা যায় বাবা! আজ সকাল ৭-৮টায় আইছি। কেউ কইতে পারে না ট্রাক আইবো কি আয়বো না।’

এই প্রতিবেদকের সঙ্গে রাবেয়া যখন কথা বলছিলেন তখন আরো সাত-আটজন নারী দৌড়ে আসেন। একের পর এক প্রশ্ন। আপনাদের কাছে কী খবর আছে কখন আসবে ট্রাক? কোন জায়গায় দিচ্ছে (পণ্য)? বেলা দেড়টার দিকে তাদের কয়েকজন হতাশ হয়ে চলে যান খালি হাতে।

শাহেদা নামের সেই নারী ফের ফিরে এসে বললেন, ‘আপনারা আমার ছবি ছাইপেন না। আত্মীয়-স্বজনের সামনে সরমে পড়ে যাব। কিন্তু পেট যে চলে না। যা বললাম লেখেন। আমাদের কষ্ট একটু কমে যেন।’

ওদিকে রাবেয়া বিরক্তিমাখা কণ্ঠে বললেন, ‘আমার ছবি দ্যান। দেখুক মাইনষে। কী আর হইবো! পেটে ভাত নাই শরম কইরা লাভ কী!’ অতঃপর খালি হাতেই ফিরে গেলেন শাহেদা, রাবেয়ারা।