
ড. এমএ আজিজ— জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক। একই বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার পর লন্ডনের ইউনিভার্সিটি অব কেন্ট থেকে সুন্দরবনের বাঘ নিয়ে পিএইচডি সম্পন্ন করেছেন। বন বিভাগ পরিচালিত সর্বশেষ বাঘ জরিপে মুখ্য গবেষক ছিলেন তিনি। হাতি সংরক্ষণ নিয়েও উল্লেখযোগ্য গবেষণা রয়েছে তার। বর্তমানে তিনি জাপানের দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথভাবে বাংলাদেশের মেছোবিড়াল সংরক্ষণ এবং পাহাড়ের গুহায় বাদুড় নিয়ে গবেষণা করছেন। তার হাত ধরেই নতুন চার প্রজাতির বাদুড়ের সঙ্গে পরিচিত হয়েছে বাংলাদেশ। আজ আন্তর্জাতিক বন্যপ্রাণী দিবস উপলক্ষে দেশের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ, চ্যালেঞ্জ ও তার ভবিষ্যৎসহ নানা দিক নিয়ে কথা বলেছেন কালবেলার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আবু আজাদ।
কালবেলা : বাংলাদেশে বন্যপ্রাণী দিবস পালন কতটা যুক্তিযুক্ত?
ড. এমএ আজিজ : দিবসগুলো পালন করা হয় কতগুলো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য সামনে রেখে। মূল উদ্দেশ্য সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সামনে ওই বিশেষ দিবসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য তুলে ধরা এবং সে অনুযায়ী নীতি তৈরি ও ব্যবস্থা নিতে উৎসাহিত করা। এটা কোনো নীতি বা লক্ষ্য বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হিসেবে কাজ করে। পাশাপাশি গণমাধ্যমের মাধ্যমে এসব সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছায়। তবে এটা ঠিক যে, কি দিবস পালন করা হচ্ছে, কেন করা হচ্ছে, তার উদ্দেশ্য কী- সেসব আগে থেকে ঠিক করে নিতে হবে। লক্ষ্য নির্দিষ্ট না করে ঢাকায় একটি সভা-সেমিনার করলে, দিবস পালন করলে, কয়েকজন মানুষ বক্তব্য দিলে আসলে খুব বেশি লাভবান হওয়ার সুযোগ নেই।
বন্যপ্রাণী আমাদের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। প্রতিটি জীবের সঙ্গে তার পরিবেশের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে, রয়েছে তার পরিবেশগত গুরুত্ব। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় জীবের প্রজাতিগুলোকে সংরক্ষণ করতে হবে। নয়তো নিশ্চিতভাবেই সেটি বিলুপ্ত হয়ে যাবে। আমাদের অসচেতনতা বা অবহেলার কারণে ইতোমধ্যে পৃথিবী থেকে হাজারো প্রজাতির প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বিলুপ্ত এসব প্রজাতি আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। কে বলতে পারে, প্রকৃতিতে টিকে থাকা প্রাণীগুলোই হয়তো আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য জীবনরক্ষাকারী ওষুধের উৎস হতে পারে।
কালবেলা : আপনি বলছেন বন্যপ্রাণী আমাদের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। কিন্তু এর প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বেশ নেতিবাচক। বন্যপ্রাণীর প্রতি এই নেতিবাচক দৃষ্টি ভঙ্গির কী কারণ থাকতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
ড. এমএ আজিজ : প্রাগৈতিহাসিককালে মানুষ বন্যপ্রাণী শিকার করে খেয়েছে। তখন বন্যপ্রাণীকে বিপজ্জনক মনে করা হতো। তাই বন্যপ্রাণীকে খাদ্যের উৎসের পাশাপাশি সেগুলোকে শত্রুজ্ঞানও করা হতো। সে জন্য প্রাণীদের আক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষার জন্য নানা কৌশল অবলম্বনেরও দরকার হতো। কিন্তু আজকের দিনে সেসবের আর প্রয়োজন নেই। কিন্তু প্রগৈতিহাসিক দিনের রেশ মানুষের মনে এখনো রয়ে গেছে। এছাড়া নেতিবাচক মনোভাবে সামাজিক শিক্ষারও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে। যেমন এখনও বাচ্চাদের ঘুম পাড়ানোর সময়, কান্না থামানোর সময় হয়তো শিয়ালের ভয় দেখানো হয়। এ ধরনের কর্মকাণ্ড অজান্তেই শিশুদের মনে বন্যপ্রাণীর প্রতি নেতিবাচক ধারণা তৈরি করে। এ ধরনের ধারণা জেনারেশন থেকে জেনারেশনে সঞ্চারিত হয়েছে, হচ্ছে।
পাশাপাশি বন, পরিবেশ ও বন্যপ্রাণী নিয়ে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় বড় গলদ রয়ে গেছে। যারা আমাদের স্কুল-কলেজ পর্যায়ে পাঠ্যবই লিখে থাকেন সেখানে পরিবেশ-বন্যপ্রাণী নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা নেই, যা ছোটবেলা থেকে মানুষকে এসব বিষয়ে স্পর্শকাতর করে তোলে। আমি মনে করি, যারা কারিকুলাম ঠিক করেন, যারা লেখেন তাদের সামাজিক গবেষণা, তাদের নৈতিকতা, মূল্যবোধ, আমাদের পরিবেশ, বিজ্ঞানচিন্তা ইত্যাদিকেও গুরুত্ব দিতে হবে। আমি বলতে চাইছি, সামাজিক শিক্ষা একদিনে বদলাবে না। কিন্তু আনুষ্ঠানিক শিক্ষার শুরুতেই যদি পরিবেশ-বন্যপ্রাণীর গুরুত্ব তুলে ধরা যায়, ভালোবাসা তৈরি করা যায় তবে পরিস্থিতি বদলাবেই।
কালবেলা : বন্যপ্রাণী রক্ষায় আমাদের সরকারের কী কী দুর্বলতা আছে বলে আপনি মনে করেন? কোন দিকগুলোকে আশু গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন?
ড. এমএ আজিজ : আনুষ্ঠানিক শিক্ষায় এ বিষয়গুলোকে যুক্ত করতে না পারা আমাদের বড় ব্যর্থতা। সে জন্য গোড়া থেকে শুরু করতে হবে। পাশাপাশি একটি বিষয় আমি খেয়াল করেছি, আমাদের দেশে উন্নয়ন বলতে কেবলই অবকাঠামোর উন্নয়ন বোঝানো হয়। এখানে পরিবেশের বিষয়গুলোকে প্রায় উপেক্ষাই করা হয়। বছরের পর বছর ধরে চলে আসা এই প্রবণতা আত্মঘাতী ছাড়া আর কিছুই নয়। উন্নয়ন এখন শুধু অবকাঠামোগত বিষয় নয়, বরং অর্থনীতি, পরিবেশ, স্বাস্থ্য, সামাজিক শিক্ষা ইত্যাদি সব কিছুর বিজ্ঞানভিত্তিক ও টেকসই দিক। সেটি নিয়ে আমাদের নীতিনির্ধারকরা ঠিক সতর্ক নন বলে মনে হয়।
উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার রেললাইনের কথা। এটি তিনটি সংরক্ষিত বনভূমির ভেতর দিয়ে গেছে, যা বন, বন্যপ্রাণী তথা পরিবেশের জন্য বড় ক্ষতি ডেকে এনেছে। এ ধরনের ঘটনা সাধারণত ঘটে যখন অবকাঠামো প্রকল্পের দায়িত্ব একজন ননটেকনিক্যাল ব্যক্তির ওপর দেওয়া হয়। এ ধরনের প্রকল্পে সংশ্লিষ্ট সব বিষয়ে টেকনিক্যাল ব্যক্তিদের সম্পৃক্ত করলে পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারত। এছাড়া প্রকল্প নির্ধারণ ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে পরিবেশ বিষয়ক বিশেষজ্ঞ রাখাও ভীষণ জরুরি। সরকারের প্রতিটি দপ্তরের উচ্চপর্যায়ে ননটেকনিক্যাল লোক থাকতেই পারে। কিন্তু দায়িত্বও পাওয়া উচিত সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের।
কালবেলা : বন ও বন্যপ্রাণী রক্ষায় সাধারণ মানুষ কি ধরনের ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করেন?
ড. এমএ আজিজ : প্রথমত, স্থানীয় মানুষজনের সচেতনতা এবং অংশগ্রহণ ছাড়া বন ও বন্যপ্রাণী রক্ষা করা সম্ভব নয়। বন্যপ্রাণী রক্ষার সরকারি ব্যবস্থাপনায় তাদের অংশীদার থাকতে হবে। একই সঙ্গে এই অংশীদারিত্বের ফলে যে বেনিফিট তৈরি হবে তা তাদের সঙ্গে শেয়ার করে নিতে হবে। সরকার এবং বন বিভাগ সহ-বন ব্যবস্থাপনার উদ্যোগে অনেকগুলো কাজ করে থাকে। সুন্দরবনেও সরকারের এ ধরনের সহ-বন ব্যবস্থাপনা রয়েছে।
আমরা জানি দেশে সামাজিক বনায়নের একটা সফলতা রয়েছে। সরকার প্রতিবছর বনায়নের জন্য অর্থায়ন করে থাকে। সরকারি জায়গাতেই এসব গাছ লাগানো হয়, কিন্তু এই কাজ স্থানীয় মানুষদের দিয়ে করানো হয় এবং রক্ষণাবেক্ষণ কাজও করেন ওই জায়গার দখলে থাকা ব্যক্তি। অর্থাৎ বনের যেসব জায়গা বেদখল হয়ে গেছে সেসব জায়গায় সরকার বনায়নের উদ্যোগ নেয় কিন্তু তাতে স্থানীয় মানুষও উপকৃত হয়। নিয়মটা এরকম যে, জায়গাটি যার দখলে থাকবে তিনি গাছগুলোর পরিচর্যা করবেন এবং ৪০ বছর পর সেগুলো বিক্রি করে ৬০% অর্থ তিনি পাবেন এবং বাকি ৪০% অর্থ সরকার পাবে। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সরকারের অনেক বেদখল জায়গা পুরোপুরি না হলেও কিয়দাংশে সরকারের মালিকানা নিশ্চিত হয়েছে। জনগণ বুঝতে পারছে যে, এটা আসলে আমাদের জায়গা নয় বরং সরকারের জায়গা। কিন্তু জনগণ এই জায়গা ভোগ দখল করতে পারছে এবং সুবিধা পাচ্ছে। একই সঙ্গে এতে সরকারের উপর চাপ কমেছে। ফলে সারা দেশব্যাপী এটা সরকারের একটি সফল প্রজেক্ট হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।

আমি মনে করি, এই ব্যবস্থাপনাটির পরিধি আরও বাড়াতে হবে। আমাদের যে সব বনাঞ্চল টিকে আছে, এসব অঞ্চলের আশপাশে যেসব মানুষজন বসবাস করেন তাদের নিয়ে এই ব্যবস্থাপনাটা আরও এগিয়ে নিতে হবে। অনেক জায়গায় ইতোমধ্যে আমরা এর সুফল দেখতে পেয়েছি। যেমন- বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ লাউয়াছড়া ন্যাশনাল পার্ক এক সময় উজাড় হতে বসেছিল। সরকারের উদ্যোগের কারণে এটা কিছুটা থেমেছে। তবে এর মধ্যে অনেক দুর্বলতা রয়েছে। সেই দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে সরকারের উদ্যোগগুলো আরও প্রাণবন্ত এবং অংশগ্রহণমূলক করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, বন্দুক দেখিয়ে বন ও বন্যপ্রাণী রক্ষার দিন শেষ হয়ে গেছে। এখন মাঠপর্যায়ে জনগণের সরাসরি সম্পৃক্ততা ছাড়া কোনো অবস্থাতেই বনাঞ্চল ও বন্যপ্রাণী রক্ষা করা সম্ভব না। সেভাবেই সরকারকে তার পলিসি ঠিক করতে হবে।
কালবেলা : ঢাকার মধ্যে বেশ কয়েকটি সংরক্ষিত বন উদ্যান রয়েছে। আমরা জানি দেশীয় প্রজাতির গাছ স্থানীয় বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে সাহায্য করে। কিন্তু আমরা দেখছি, এসব সংরক্ষিত বনে সৌন্দর্যবর্ধনকারী বিদেশি গাছ এনে লাগানো হচ্ছে। এই বিষয়টাকে কিভাবে দেখেন?
এমএ আজিজ : আরবান ওয়াইল্ড লাইফ নামে একটি বিষয় রয়েছে। আরবান সেটিংয়ে অনেক বন্যপ্রাণী থাকে। বন্যপ্রাণী বলতে সাধারণত আমরা বড় বড় প্রাণীগুলোকে জানি। কিন্তু বহু ধরনের কীটপতঙ্গ রয়েছে যেগুলোও ওয়াইল্ড লাইফের অংশ। এই আরবান সেটিং ঠিক রাখতে হলে বনাঞ্চলগুলোতে যথাসম্ভব প্রাকৃতিক পরিবেশ বজায় রাখা জরুরি। আমাদের মধ্যে একটি প্রবণতা রয়েছে যে, কিভাবে এই সংরক্ষিত বনগুলোর সৌন্দর্যবর্ধন করা যায়। এ জন্য আমরা এসব বনে অনেক বিদেশি গাছ লাগাচ্ছি। কিন্তু আমাদের খেয়াল রাখতে হবে বনগুলোতে যেন ডাইভারসিটি বজায় থাকে। অর্থাৎ বড় গাছ থাকবে, ছোট গাছ থাকবে, ঝোপঝাড়-লতাগুল্মও থাকবে। একই সঙ্গে হাঁটাচলা করার মতো কিছু পথ থাকবে এবং কিছু ওপেন এরিয়া থাকবে। এতে যেমন মানুষ চলাচল করতে পারবে, মানুষ বন বা পার্কের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবে তেমনি সব ধরনের বন্যপ্রাণীর আবাসনের পরিবেশ নিশ্চিত হবে।
একটি বন যতটা ডাইভার্সিফায়েড হবে ততই নানা ধরনের বন্যপ্রাণীকে সাপোর্ট করতে পারবে। পাহাড়ের বনের ডাইভারসিটি এবং সুন্দরবনের ডাইভারসিটি সমান নয়। পাহাড়ে অনেক বেশি প্রজাতির বন্যপ্রাণী বিচরণ করে। সুন্দরবনে যেহেতু সবই ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ ফলে শুধু ওই লবণাক্ত পরিবেশ সহ্য করতে পারে এমন প্রাণীরাই সেখানে বেড়ে উঠতে পারে। আর পাহাড়ের ক্ষেত্রে, পাহাড়ের উঁচু জায়গায় একরকম এবং ঢালুতে একরকম এবং নিচের চড়াতে ভিন্ন রকমের প্রাণীরা বাস করতে পারে। অর্থাৎ গাছের যেমন বৈচিত্র্য রয়েছে, তেমনি পরিবেশভেদে বন্য প্রাণীরও বৈচিত্র্য একই রকম। তাই সংরক্ষিত বনাঞ্চলগুলোতেও আমাদের ডাইভারসিটি রাখতে হবে। এমন পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে যাতে সব ধরনের পশু-পাখি ও প্রাণীদের জন্য সেটা সহিষ্ণু হয়।
কালবেলা : আমরা দেখেছি বেশ কিছু বন্যপ্রাণী ইতোমধ্যেই আমাদের দেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। যেমন- নীলগাই, মিঠা পানির কুমির, ঘড়িয়াল, গণ্ডার, ময়ুর- এসব প্রাণীকে কোনোভাবে আবার আমাদের প্রকৃতিতে ফিরিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করেন কি?
এমএ আজিজ : বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া প্রাণী আবারও প্রকৃতিতে ফিরিয়ে আনা অনেক কঠিন কাজ। এর জন্য প্রথমেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, আমরা চাই কি না যে এটা প্রকৃতিতে টিকে থাকুক অথবা ফিরিয়ে আনা হোক। আমরা এটাকে বলি রিইন্টারডাকশান। এর অর্থ হলো- একটি প্রাণী এক সময় এই আবাসে ছিল এখন নেই, সেটাকে ফিরিয়ে আনা। এটা অনেক কঠিন কাজ কিন্তু অসম্ভব নয়। প্রথমে দেখতে হবে, যেসব কারণে এই প্রাণী বিলুপ্ত হয়েছে সে কারণগুলো বিলুপ্ত করতে হবে। যেমন, নীল গাই আমাদের সমতলের বনে ছিল, এরা ঘাসের জমিন পছন্দ করে, ময়ূর শাল বনে ছিল তারাও কিছু সমতল ভূমি পছন্দ করে। বনের সেরকম অবস্থা বা পরিবেশ আমরা ফিরিয়ে আনতে পারব কি না তার ওপর নির্ভর করে এই প্রাণীগুলোকে রিইনপ্রোডাকশন করা যাবে কি না। এই মুহূর্তে আমার মনে হয়, এ রকম পরিবেশ আমাদের বড় অঞ্চলগুলোতে এখন নেই।
মিঠাপানির কুমির এবং ঘড়িয়ালের মতো কিছু প্রাণী রয়েছে যেগুলো সহজে রিইনপ্রোডাকশন করা যায়। কিন্তু এগুলো মানুষের জন্য ক্ষতিকর হবে কিনা তাও আগে ভেবে দেখতে হবে। তবে মূল কথা হলো, এসব প্রাণী আবার ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা যেতে পারে তবে তার জন্য সেরকম ডেডিকেশন থাকতে হবে। একটা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা এবং অর্থায়ন হলে এ বিষয়ে এগিয়ে যাওয়া যায়। তার জন্য এখানে প্রয়োজন হবে সরকারি উদ্যোগের।
কালবেলা : হাতি, মেঘলা চিতা, উল্লুক, শকুন, বড় পাহাড়ি কচ্ছপসহ বেশ কিছু প্রাণী আমাদের দেশ থেকে বিলুপ্ত হওয়ার মুখে রয়েছে। এই বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীগুলোকে রক্ষা করতে হলে এই মুহূর্তে কি ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি বলে মনে করেন?
এমএ আজিজ : প্রথমত, এসব প্রাণীর বাসস্থান রক্ষায় আমাদের উদ্যোগ নিতে হবে। কারও ঘর না থাকলে, বসার বা শোয়ার জায়গা না থাকলে আমরা তাদের উদ্বাস্তু বলি। কোনো কারণে মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে গেলে সে তখন অন্য জায়গায় আশ্রয় খোঁজে। অর্থাৎ বাসস্থান না থাকলে মানুষের অস্তিত্ব যেমন হুমকির মুখে পড়ে তেমনি বন্যপ্রাণীর ক্ষেত্রেও একই রকম। তাদের জন্য মূল সংকট হলো বাসস্থান। যেসব প্রাণী বিলুপ্ত হয়েছে বা বিলুপ্ত হওয়ার পথে রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে হয়তো বাসস্থান সংকুচিত হয়েছে, না হয় বাসস্থানে তার খাবার বা প্রজননের সুবিধা বিঘ্নিত হচ্ছে।
যেমন আমরা শকুনের কথা বলতে পারি। শকুন অনেক উঁচু গাছে থাকতে পছন্দ করে। মিক্সিংয়ের জন্য তারা নিরিবিলি জায়গা পছন্দ করে। কিন্তু আমাদের দেশে এ ধরনের উঁচু গাছ প্রায় নিশ্চিহ্ন। বন্যপ্রাণীগুলোর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে আমাদের হাতিগুলো। অধিকাংশ হাতির বাসস্থান নষ্ট হয়েছে, এরা এখন উদ্বাস্তু। আমরা হাতির বন থেকে গাছ কেটে আনি, তাদের খাবারগুলো নিয়ে চলে আসি, তাহলে হাতি বাঁচবে কিভাবে! হাতি যখন জঙ্গলে খাবার পাচ্ছে না তখন স্বাভাবিকভাবেই তারা খাবারের খোঁজে লোকালয়ে বের হয়ে আসে। মানুষের বাড়িতে এসে হানা দেয়, ধান ক্ষেতে হানা দেয়। এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না। তাদের বাসস্থান ও জীবিকা বিপন্ন করার কারণেই তারা বাঁচার জন্য বন থেকে বেরিয়ে আসছে। আর আমরা কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে, সেই বেড়া বিদ্যুতায়িত করছি যার সংস্পর্শে হাতি মারা যাচ্ছে।
সুতরাং যে প্রাণীগুলো বিলুপ্তির মুখে রয়েছে আমরা যদি এদের আবাসস্থল টিকিয়ে রাখতে না পারি তাহলে এসব প্রাণী রক্ষা করা সম্ভব হবে না। তাই প্রথমে আমাদের এসব প্রাণীর বাসস্থান সংরক্ষণ করতে হবে এবং তাদের খাবারের উৎসগুলো টিকিয়ে রাখতে হবে।
কালবেলা : বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং বন্যপ্রাণী টিকিয়ে রাখতে সরকার এবং সাধারণ মানুষের উদ্দেশে আপনি কি পরামর্শ দেবেন?
এমএ আজিজ : একাবিংশ শতাব্দী মিডিয়ার যুগ। গণমাধ্যমসহ সামাজিক মাধ্যমের কল্যাণে মানুষ এখন অনেক বেশি কানেক্টেড। তাই আমি মনে করি, বনাঞ্চল এবং বন্যপ্রাণী টিকিয়ে রাখার গুরুত্ব ও এগুলো ধ্বংস যে আইনবিরোধী কাজ সেসব বিষয় বহুল প্রচার হওয়া উচিত। বন বিভাগের যেহেতু এ ধরনের আউটলেট নেই, তাই মিডিয়াগুলো এখানে বিরাট ভূমিকা পালন করতে পারে, জাতির পাশে দাঁড়াতে পারে। সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাতে হলে এই মাধ্যমগুলোকে কীভাবে আরও কার্যকরভাবে ব্যবহার করা যায়, এ জায়গাতে মিডিয়াগুলোর আরও আন্তরিক হওয়া প্রয়োজন। সংবাদমাধ্যমগুলোতে বেশি বেশি প্রকৃতি ও পরিবেশের নিউজ হওয়া উচিত। মিডিয়াগুলো যেভাবে মানুষের কাছে পৌঁছতে পারে এবং মানুষকে পরামর্শ দিতে পারে সেটা আর কেউ পারে না।
একইভাবে যারা সরকারে থাকেন এবং দেশ পরিচালনা করেন তাদেরও উচিত এ বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া। তারা যেন বুঝতে পারেন যে, এটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং এটা অবহেলা করা ঠিক নয়। আর সাধারণ মানুষকে আমি বলবো, আপনার চারপাশের প্রাণ-প্রকৃতি টিকিয়ে রাখতে আপনি আন্তরিক হন। একটি সুস্থ, সুন্দর ও নির্মল জীবনের জন্য এর কোনো বিকল্প নেই। আপনি যদি ভালো থাকতে চান তাহলে আপনার চারপাশের পরিবেশটা আপনাকেই ভালো রাখতে হবে। এ দেশের প্রতিটি মানুষ যদি নিজ নিজ জায়গা থেকে সচেতন হয় তাহলে সামগ্রিকভাবে একটি ইতিবাচক পরিবর্তন আমরা দেখতে পাব।