Image description

শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসন প্রলম্বিত করার পেছনে যে কয়জন পুলিশ কর্মকর্তা নেপথ্যে ভূমিকা পালন করে তার মধ্যে একজন সাবেক অতিরিক্ত ডিআইজি আব্দুল কাহার আকন্দ। শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত জিঘাংসা বাস্তবায়নের প্রধানতম হাতিয়ার ছিলেন এই আব্দুল কাহার আকন্দ। কিন্তু ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের একাধিক মামলার আসামি হয়েও ধরাছোঁয়ার বাইরে বিতর্কিত এই পুলিশ কর্মকর্তা। মামলা তদন্তের নামে সিআইডিতে বসে বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার করে বছরের পর বছর কারাগারে রাখার কাজে ব্যস্ত ছিলেন গত ১৭ বছর। তবে পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, ৫ আগস্টের পর কিছু অসাধু পুলিশ কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে এরই মধ্যে বিদেশে পালিয়ে গেছেন এই আব্দুল কাহার আকন্দ। আব্দুল কাহার আকন্দ অসংখ্য মানুষের বুকে, হৃদয়ে রক্তক্ষরণের কারণ। নিরীহ অসংখ্য মানুষকে তিনি ফাঁসিয়ে গেছেন। তাকে ইন্টারপোলের মাধ্যমে ফিরিয়ে এনে বিচার করার দাবি করেছেন ভুক্তভোগিরা।

গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ ও ভারতের স্বার্থ রক্ষায় পুলিশ কর্মকর্তা আব্দুল কাহার আকন্দ ছিলেন নিয়োজিত ও নিবেদিত। তিনি কাজ করতেন সিআইডিতে। ১৯৯৬ সালে ২১ বছর পর যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে, তখন তাদের মূল এজেন্ডা ছিল শেখ মুজিব হত্যার বিচার করা। এই বিচারের জন্য তদন্ত করার দায়িত্ব পান এই আকন্দ। মুজিববাদ নিয়ে এখন যত আলোচনা চলছে, তা প্রতিষ্ঠায় এই মামলায় ও বিচারের ভূমিকা ছিল সর্বোচ্চ। আর এই মামলার মূল কারিগর ছিলেন আব্দুল কাহার আকন্দ। তিনি খায়রুজ্জামান, কে এম ওবায়দুর রহমান, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, সৈয়দ ফারুক রহমান ও তাহের উদ্দিন ঠাকুরকে আটক করেন। ২০০১ সালে চারদলীয় জোট ক্ষমতায় আসলে আব্দুল কাহার আকন্দকে বরখাস্ত করা হয়। তিনি ছিলেন শেখ হাসিনার সবচেয়ে কাছের লোক হওয়ায় ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচনের পর হাসিনা যখন ফের ক্ষমতায় আসেন, তখন দায়িত্ব নিয়েই ২০০৯ সালের ২৮ জানুয়ারি তাকে সিআইডিতে নিয়োগ দেন। আব্দুল কাহার আকন্দর চাকুরির বয়স অনেক আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। তাই জয়েন করার একদিন পর ২৯ জানুয়ারি তিনি অবসরে যান। ২০১১ সালের ৩ জুলাই আসামির তালিকায় আরো ৩০ জনকে যোগ করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেন কাহার আকন্দ। সম্পূরক অভিযোগপত্রে চারদলীয় জোট সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী ও বিএনপি-জামায়াত নেতাদের নাম ঢুকিয়ে দেন কাহার আকন্দ।

অনুসন্ধান এবং কাহার আকন্দের ঘনিষ্ঠ সূত্র বলছে, কাহার আকন্দের ফর্মুলা ছিল তদন্তে শেখ হাসিনার আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটানো। শেখ হাসিনার মিশন বাস্তবায়ন করাই ছিল তার কাজ। এর মাধ্যমে তিনি শেখ হাসিনার আনুকূল্য পাওয়ার পাশাপাশি ব্যক্তিগতভাবে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে একাধিক ফ্লাট-প্লট ও বাড়ি করা ছাড়াও কানাডাতেও তিনি একাধিক বাড়ি করেছেন। এছাড়া গড়েছেন বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।

সম্প্রতি সরকারের উচ্চ পর্যায়ে পাঠানো একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগের ১৯৯৬-এর জামানায় খিলগাঁওয়ের তালতলার কাহার আকন্দ একটি বহুতল ভবন করেন। আওয়ামী লীগের বিগত ১৫ বছরের শাসনামলে তিনি রাজধানীর বসুন্ধরাসহ বেশকয়েকটি জায়গায় একাধিক ফ্লাট-প্লট ও বাড়ি করেন। এক সময় তিনি তালতলা’র বাসায় থাকলেও সর্বশেষ তিনি বসুন্ধরা এলাকার ফ্লাটে থাকতেন। দেশ ও দেশের বাইরে মিলিয়ে অন্তত হাজার কোটি টাকার মালিক বনেছেন কাহার আকন্দ। এছাড়া তার ভাই স্থানীয় সহশ্রাম ধূলদিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবুল কাশেম আকন্দের নামেও বিপুল পরিমাণ সহায়-সম্পদ করেছেন। আব্দুল কাহার আকন্দ অসংখ্য মানুষের বুকে, হৃদয়ে রক্তক্ষরণের কারণ। নিরীহ অসংখ্য মানুষকে তিনি ফাঁসিয়ে গেছেন। শেখ মুজিব হত্যা মামলার পর দ্বিতীয় যে স্পর্শকাতর মামলায় তাকে তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় তা ছিল মনজুর হত্যা মামলা। এই মামলার মধ্যদিয়েও আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করেছে আর তাতে সহায়তা করেছেন আব্দুল কাহার আকন্দ। এরপর হাসিনার এজেন্ডা তিনি বাস্তবায়ন করেছিলেন একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার মাধ্যমে। আকন্দ ২০০৪ সালের ঢাকা গ্রেনেড হামলার তদন্ত কর্মকর্তাও ছিলেন আব্দুল কাহার আকন্দ। তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর ২০০৯ সালের ৪ অক্টোবর সাক্ষ্য দেন যে তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকারের শিক্ষা উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর বাড়ি থেকে গ্রেনেড সরবরাহ করা হয়েছিল। মুফতি আব্দুল হান্নানকে দিয়ে জোরপূর্বক সাক্ষ্য নেয়ার কৃতিত্ব ছিল তার। এই মামলায় সম্পূরক চার্জশিট দেয়ার নামে নিরীহ মানুষকে তিনি ফাঁসিয়ে যান। সম্প্রতি এই মামলায় অভিযুক্তদের অনেকেই বেকসুর খালাস পেয়েছেন। কিন্তু তাদেরকে যিনি ফাঁসিয়ে গেলেন সেই আব্দুল কাহার আকন্দকে শাস্তি দেয়ার কোনো নির্দেশনা দিয়েছেন বলে জানা যায়নি।

আব্দুল কাহার আকন্দকে এরপর যে মামলার মধ্যদিয়ে ফ্যাসিবাদ ও ভারতীয় হেইজমনি বাস্তবায়ন করা হয় তা ছিল বিডিআর বিদ্রোহ তদন্ত মামলা। আব্দুল কাহার আকন্দ বিডিআর বিদ্রোহের তদন্তের জন্য অপরাধ তদন্ত বিভাগের ২৫০ জনের একটি দলের নেতৃত্ব দেন। তিনি গণহারে বিডিআর সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ চাপিয়ে দেন। কিন্তু ভারত ও আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি এড়িয়ে যান। তার এই অসদাচরণ এতটাই স্পষ্ট ছিল যে, খোদ আওয়ামী লীগ আমলেই ২০১৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকার একটি আদালত আকন্দের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেয়। কারণ আদালত তাদের পর্যবেক্ষণে প্রমাণ পেয়েছিল যে, আব্দুল কাহার আকন্দ পুলিশ হলেও কার্যত একজন আওয়ামী রাজনীতিবিদ এবং বিদ্রোহের মামলার অভিযুক্ত তোরাব আলীর পক্ষে তিনি পক্ষপাতদুষ্ট ছিলেন। শুধু তাই নয়, মানবাধিকার সংস্থাগুলোর দ্বারা অভিযোগ করা হয়েছিল যে বিডিআর বিদ্রোহের মামলায় সৈন্যদের অপরাধ তদন্ত করার নামে তিনি বিডিআর সদস্যদের হেফাজতে নিয়ে তাদের ওপর অমানবিক নির্যাতন চালিয়েছিল। পুলিশ বিভাগের ইতিহাস একমাত্র ‘আব্দুল কাহার আকন্দ’ যিনি অবসরের পরেও ১০ বছর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়ে চাকরি করে গেছেন, যা সর্বশেষ ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে শেষ হলে তিনি চূড়ান্ত অবসরে যান। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের খুবই আস্থা-ভাজন ও বিশ্বস্ত হওয়ায় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের মনোনীত চমকপ্রদ প্রার্থী ছিলেন আব্দুল কাহার আকন্দ। তার হাতে নৌকার টিকেট তুলে দিয়ে কিশোরগঞ্জ-২(কটিয়াদি-পাকুন্দিয়া) আসনে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল আওয়ামী। যদিও নির্বাচনে জিততে পারেননি তিনি।