
আর মাত্র কয়েকদিন পরই শুরু হচ্ছে পবিত্র রমজান মাস। দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পর আসে আনন্দের দিন, ঈদুল ফিতর। এই উৎসব ঘিরে সবার মধ্যেই থাকে বাড়তি উচ্ছ্বাস। আর ঈদ মানেই নতুন পোশাক, সাজসজ্জা এবং আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সময় কাটানোর আনন্দ। ছোট থেকে বড়—সব বয়সের মানুষের জন্য নতুন পোশাক কেনা ঈদের অন্যতম আকর্ষণ। সেই আনন্দ দ্বিগুণ করতে ফ্যাশন হাউস ও পোশাক ব্র্যান্ডগুলোও ঈদকে ঘিরে নিয়ে এসেছে নতুন সব কালেকশন, আকর্ষণীয় ছাড় ও বিশেষ আয়োজন।
ঈদবাজারে আগাম প্রস্তুতি, কেনাকাটায় ব্যস্ত ক্রেতারা: ঈদ যত ঘনিয়ে আসছে, বাজারে ততই বাড়ছে ক্রেতাদের ভিড়। রাজধানীর বসুন্ধরা সিটি, এলিফ্যান্ট রোড, বনানী, উত্তরা, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, নিউমার্কেটসহ বিভিন্ন শপিংমল ঘুরে দেখা গেছে, ঈদের কেনাকাটা জমে উঠতে শুরু করেছে। অনেক ক্রেতাই আগেভাগে শপিং করছেন, কারণ রোজায় দিনের বেলায় কেনাকাটা করা বেশ কষ্টকর। এ ছাড়া ঈদের সময় বাজারে প্রচণ্ড ভিড় থাকে, যা এড়াতে ক্রেতারা এখন থেকেই পছন্দের পোশাক সংগ্রহ করছেন।
রাজধানীর জনপ্রিয় ফ্যাশন ব্র্যান্ড ইয়েলোতে ঈদের পোশাক কিনতে আসা মাসুম রহমান বলেন, ‘আমি সবসময় ঈদের কেনাকাটার জন্য ইয়েলো পছন্দ করি। তাদের কালেকশন মানসম্পন্ন, ডিজাইন ইউনিক এবং আরামদায়ক। তাই ঈদের পোশাক এখান থেকেই কেনার চেষ্টা করি।’
বসুন্ধরা সিটি কমপ্লেক্সের বিভিন্ন শোরুমে দেখা গেছে, ছেলেরা শার্ট, টিশার্ট, পাঞ্জাবি, পায়জামা কিনছেন, আর মেয়েরা থ্রিপিস, শাড়ি, কুর্তি, টপসসহ নানা স্টাইলিশ পোশাক পছন্দ করছেন। ক্রেতাদের আগ্রহ দেখে বিক্রেতারাও বেশ উচ্ছ্বসিত। জুঁই চৌধুরী নামে এক ক্রেতা বলেন, ‘আমি সাধারণত কোরবানির ঈদে তেমন কেনাকাটা করি না, কিন্তু ঈদুল ফিতরে নতুন পোশাক কেনার একটা অন্যরকম আনন্দ আছে। এবার যেহেতু গরম বেশি, তাই পরিবারের সদস্যদের জন্য হালকা, আরামদায়ক কাপড় কিনছি।’
ঈদ উপলক্ষে বিশেষ ছাড় ও অফার: ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো এবার ঈদ উপলক্ষে ৩০ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত মূল্য ছাড় ঘোষণা করেছে। বিভিন্ন শোরুমে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে নির্দিষ্ট পণ্যে ছাড় দেওয়া হচ্ছে। এলিফ্যান্ট রোডের এলিট লাইফস্টাইল ব্র্যান্ডের স্বত্বাধিকারী এস এম ওবায়দুল্লাহ বলেন, ‘আমরা এবার ঈদের জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছি। বাচ্চাদের পোশাক থেকে শুরু করে সব বয়সীদের জন্য নতুন কালেকশন এনেছি। তবে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ব্যবসা কতটা সফল হবে, তা নিয়ে কিছুটা শঙ্কা রয়েছে।’
ফ্যাশন হাউসগুলোর বিশেষ আয়োজন ও নতুন ট্রেন্ড: প্রতিটি ফ্যাশন ব্র্যান্ডই ঈদ ও পহেলা বৈশাখ কেন্দ্র করে উৎসবমুখর নকশার পোশাক বাজারে এনেছে। এবারের পোশাকের মূল আকর্ষণ সুতি, সিল্ক, হাফসিল্ক, জর্জেট, লিনেন, মসলিন, শিফন, বলাকা ও সিকোয়েন্সের মতো আরামদায়ক ও ফ্যাশনেবল ফেব্রিক।
নারীদের জন্য এবারের ঈদ কালেকশনে থাকছে—শাড়ি (সুতি, সিল্ক, জর্জেট, মসলিন), থ্রিপিস (লন, সালোওয়ার-কামিজ, কুর্তি), ফ্যাশন টপস ও ওয়েস্টার্ন ড্রেস, আনারকলি থ্রিপিস, শ্রাগ, স্কার্ফ, শারারা, কাফতান।
পুরুষদের জন্য থাকছে—এক্সক্লুসিভ পাঞ্জাবি (লিনেন, কটন, সিল্ক), চিনো প্যান্ট, ডেনিম জিন্স, ফরমাল শার্ট, ক্যাজুয়াল শার্ট, টিশার্ট, পোলো শার্ট, কার্গো প্যান্ট, কটি, পায়জামা।
ফ্যাশন ব্র্যান্ড ইয়েলোর উপমহাব্যবস্থাপক সুমিত তরফদার বলেন, ‘ঈদ আমাদের জন্য শুধু একটি সিজন নয়, এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় উৎসব। তাই ক্রেতাদের জন্য নতুন ডিজাইন ও ট্রেন্ড নিয়ে আসাই আমাদের মূল লক্ষ্য।’
ফ্যাশন ব্র্যান্ড টুয়েলভ ক্লোদিংয়ের পরিচালক ও সিওও মতিউর রহমান জানান, ‘শীতকালীন কালেকশন ভালো হওয়ায় এবার ঈদের জন্য আরও বৈচিত্র্যময় কালেকশন তৈরি করেছি। ট্রেন্ড ও মানের সমন্বয়ে ক্রেতাদের সেরা ফ্যাশন অভিজ্ঞতা দিতে প্রস্তুত আমরা।’
বিশ্ব রঙয়ের প্রতিষ্ঠাতা বিপ্লব সাহা বলেন, ‘বিশ্ব রঙের ৩০ বছরপূর্তি উপলক্ষে আমরা ঐতিহ্যবাহী শিল্পকর্ম ও স্থাপত্য নিয়ে কাজ করেছি। এবার পানাম নগরের বিল্ডিংয়ের নকশা নিয়ে বিশেষ ডিজাইন তৈরি করেছি।’
কেরানীগঞ্জে ঈদের ব্যস্ততা, পোশাক তৈরিতে শ্রমিকদের দিন-রাত পরিশ্রম: ঈদ কেন্দ্র করে কেরানীগঞ্জের পোশাক কারখানাগুলো এখন ব্যস্ত সময় পার করছে। হাজার হাজার শ্রমিক জিন্স প্যান্ট, শার্ট, পাঞ্জাবি ও শিশুদের বাহারি পোশাক তৈরিতে ব্যস্ত। একটি কারখানার শ্রমিক মেহেদী হাসান বলেন, ‘ঈদ এলেই আমাদের কাজের চাপ বেড়ে যায়। আমরা টানা কাজ করি যাতে সময়মতো পোশাক সরবরাহ করা যায়।’
কারখানার মালিক ফারুক হাসান বলেন, ‘শীতকালীন ব্যবসা ভালো হওয়ায় ঈদ মৌসুমের প্রস্তুতিও ভালোভাবে নিতে পেরেছি। আমরা আশাবাদী ঈদে বেচাকেনা ভালো হবে।’
নতুন ট্রেন্ড ও ফ্যাশনের দিকে নজর: এবারের ঈদ ফ্যাশনে আরামদায়ক পোশাকের দিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ছেলেদের শার্টে হাওয়াই ও ফ্লোরাল প্রিন্ট, চিনো প্যান্টের কাট, আরামদায়ক লিনেন ও সুতি পাঞ্জাবি বেশি চাহিদায় রয়েছে। মেয়েদের পোশাকের মধ্যে কুর্তি, ওয়েস্টার্ন টপস, আনারকলি থ্রিপিস, শ্রাগ ও কাফতান জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।
ফ্যাশন হাউসগুলো আশাবাদী, সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের পরও ঈদের কেনাকাটা জমে উঠবে। কারণ, বাংলাদেশের মানুষ উৎসবপ্রিয় এবং নতুন পোশাক ছাড়া ঈদের আনন্দ যেন অপূর্ণ থাকে।