
মিথ্যা তথ্যের‘ ওপর ভিত্তি করে মামলা হয়েছিল দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)। এরপর বিভাগীয় তদন্তে নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছেন। তারপরও বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়েছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মো. শহীদুল আফরোজকে। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সংস্থাটির একাধিক কর্মকর্তা ও কর্মচারী।
অভিযোগ ছিল কক্সবাজার বিমানবন্দরের জন্য জেনারেটর কেনা নিয়ে। বলা হয়েছে, জেনারেটর তো কেনা হয়নি, উল্টো ৬০ লাখ ৫০ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেছেন। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা উল্টো। জেনারেটরটি কেনা হয়েছে এবং সেটি এখন পর্যন্ত নিরবিচ্ছিন্নভাবে চলছে। কোনও ত্রুটিও হয়নি।
যে জেনারেটর না কেনার অভিযোগে তার নামে মামলা, পরে ওএসডি করা হয়েছে সেই জেনারেটরের ভিডিও বাংলা ট্রিবিউনের কাছে এসেছে। ওই ভিডিওতে জেনারেটরটি সম্পূর্ণ সচল এবং চালু দেখা গেছে। তাহলে তাকে এই শাস্তি পেতে হলো— জানতে চাইলে সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মো. শহীদুল আফরোজ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গত ৫ আগস্টের পর একটি শক্তিশালী ষড়যন্ত্র কাজ করছিল। সেটি মোকাবিলা করতে পারিনি।’
তিনি বলেন, ‘একদিকে দুদক থেকে মিথ্যা তথ্যে মামলা হলো, পরে বেবিচক থেকে তদন্ত হলো, সেখানে নির্দোষ প্রমাণিত হলাম। এরপরও আমাকে ওএসডি করা হলো। এখানে আমার সঙ্গে বড় ধরনের অন্যায় করা হয়েছে। আমি ন্যায়বিচার চাই।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০১৫ সালে ৬০ লাখ ৫০ হাজার টাকা খরচ করে কক্সবাজার বিমানবন্দরের বিদ্যুৎ ঘাটতি পূরণ করতে কেনা হয় যুক্তরাজ্যের এনইপি কোম্পানির শক্তিশালী জেনারেটর। বসানো হয় বিমানবন্দরের এক পাশে পাওয়ার হাউজে। দীর্ঘদিন ধরেই জেনারেটরটি সচল এবং সার্ভিস দিচ্ছে। কিন্তু বেবিচকের একটি চক্র জেনারেটরটি গায়েব করা হয়েছে বলে অভিযোগ তোলে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, জেনারেটরটি প্রকৃতপক্ষে গায়েব হয়নি। কক্সবাজার বিমানবন্দরে বসানো নির্দিষ্ট জায়গায় রয়েছে এবং এখনও নিয়মিত সার্ভিস দিচ্ছে। বাংলা ট্রিবিউনের কাছে আসা ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে সেই জেনারেটরটি সচল রয়েছে।
সার্ভিস দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন কক্সবাজার বিমানবন্দরের পরিচালক গোলাম মোর্তুজা হোসেন। তিনি বলেন, ‘ওই জেনারেটরটি এখনও সম্পূর্ণ সচল অবস্থায় রয়েছে। সেটি আমাদের সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছে।’
সূত্র বলছে, কক্সবাজার বিমানবন্দরে ৩০০ কেভিএ’র জেনারেটর কেনার নামে ৬০ লাখ ৫০ হাজার টাকা আত্মসাতের অভিযোগ এনে ২০১৯ সালে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডার্সের স্বত্ত্বাধিকারী মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন, বেবিচকের সাবেক সহকারী প্রকৌশলী (ই/এম) ভবেশ চন্দ্র সরকার (বর্তমানে অবসরে), উপ-সহকারী প্রকৌশলী শহীদুল ইসলাম মন্ডল, কক্সবাজার বিমানবন্দরের সাবেক ম্যানেজার মো. হাসান জহির (বর্তমানে সিনিয়র এরোড্রাম অফিসার এপ্রোন কন্ট্রোলার), বেবিচকের সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী মিহির চন্দ্র দে (চলতি মাসে নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে অবসর নিয়েছেন) এবং তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. শহীদুল আফরোজকে (রুটিন দায়িত্বে প্রধান প্রকৌশলী পদ থেকে অপসারণ করে ওএসডি) আসামি করে মামলা করে দুদক।
একই ঘটনায় বেবিচক আলাদা তদন্ত কমিটি গঠন করে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করে। মামলা ও তদন্তে ঘটনার সত্যতা না পেয়ে তাদের বিভাগীয় মামলা নিষ্পত্তি করা হয়। বহাল রাখা হয় স্ব স্ব কর্মে। প্রকৌশলী শহীদুল আফরোজকেও দায়মুক্তি দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর পরবর্তিতে রুটিন দায়িত্বে প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
পরে একই অভিযোগে প্রকৌশলী শহীদুল আফরোজকে গত ২৫ নভেম্বর ওএসডি করে কর্তৃপক্ষ। তাকে দায় মুক্তি দিয়েও আবার কেন ওএসডি করা হলো? বেবিচকে ঊর্ধ্বতন পদে কর্মরত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক সূত্র জানায়, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং ষড়যন্ত্রমূলকভাবে প্রকৌশলী শহীদুল আফরোজকে ওএসডি করে রাখা হয়েছে। জেনারেটর কাণ্ড ঘটিয়ে দুদকের ‘ভূতুড়ে মামলায়’ তাকে জড়ানো হয়েছে। এ নিয়ে বেবিচকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে ক্ষোভ জন্মেছে।
এ প্রসঙ্গে বেবিচকের এক কর্মকর্তা জানান, বিনা কারণে শহীদুল আফরোজকে ওএসডি করা হয়েছে। প্রায় ১০ মাস তিনি বেবিচকের রুটিন মাফিক প্রধান প্রকৌশলী ছিলেন।
অভিযোগে বলা হয়েছে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে কক্সবাজার বিমানবন্দরের জন্য একটি ৩০০ কেভিএ জেনারেটর কিনতে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ ও বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের কয়েকজন কর্মকর্তা-ঠিকাদার যোগসাজশে জেনারেটরটি না কিনে ক্রয় দেখিয়ে ৬০ লাখ ৫০ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেন। এ অভিযোগ পেয়ে তদন্ত করে দুদক। দীর্ঘ তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পেয়ে দুদকের চট্টগ্রাম অঞ্চল-২ এর উপ-পরিচালক মাহবুবুল আলম বাদী হয়ে কক্সবাজার সদর মডেল থানায় একটি মামলা করেন। কক্সবাজার বিমানবন্দরের মেকানিক নুরুদ্দিন ভূইয়া এবং মনির হোসেনের বক্তব্যের ওপর ভিত্তি করে এ মামলা দায়ের করা হয়েছে বলে জানা যায়। তবে ওই সময় বেবিচক বিষয়টি নিয়ে আলাদাভাবে তদন্ত করে। বিভাগীয় মামলাও করা হয়। বিভাগীয় মামলা থেকে শহীদুল আফরোজসহ সবাই নির্দোষ প্রমাণিত হন।
বেবিচকের তদন্তেও বলা হয়েছে, জেনারেটর ক্রয় করা হয়েছে। সার্ভিসও দিচ্ছে ঠিকমতো। পরে শহীদুল আফরোজকে দায়মুক্তি দিয়ে বেবিচকের প্রধান প্রকৌশলীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। প্রায় ১০ মাস তিনি প্রধান প্রকৌশলীর দায়িত্ব পালন করেন।
বেবিচকের একটি সূত্র জানায়, গত ২৫ নভেম্বর হঠাৎ করে প্রকৌশলী শহীদুল আফরোজকে ওএসডি করে প্রধান প্রকৌশলীর দায়িত্ব দেওয়া হয় প্রকৌশলী হাবিবুর রহমানকে। ইতোমধ্যে হাবিবুর রহমানের বিরুদ্ধে চারটি মামলা হয়েছে দুদকে। দেশত্যাগেও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। তাকে প্রধান প্রকৌশলীর দায়িত্ব থেকে সরাতে উচ্চ আদালতে রিটও করা হয়েছে। আদালত থেকে চার সপ্তাহের মধ্যে জবাব দিতে বলা হয়েছে। ২২ মার্চ থেকে তার চাকরি শেষে অবসরে (এলপিআর) যাওয়ার কথা রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে কথা বলতে দুদকের চট্টগ্রাম অঞ্চল-২ এর উপ-পরিচালক মাহবুবুল আলমের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেবিচকের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মঞ্জুর কবীর ভুঁইয়াও কোনও মন্তব্য করেননি।