Image description
সাভার ও ধামরাই

সাভার ও ধামরাইয়ে অপরিকল্পিত ভবন, শিল্পকারখানা ও বাজার গড়ে ওঠার ফলে অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি দিন দিন বাড়ছে। ফায়ার সার্ভিসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালে এ দুটি উপজেলায় ৩১৬টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ৬ জন নিহত, ১৯ জন আহত হয়েছেন এবং আর্থিক ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৩.৬ কোটি টাকার। এসব অগ্নিকাণ্ডের বেশিরভাগই ঘটেছে বৈদ্যুতিক গোলযোগ, গ্যাস লিকেজ, বিড়ি-সিগারেটের আগুন, রান্নার চুলা ও অসতর্কতার কারণে।

সাভার ও ধামরাইয়ের ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা বলছেন, বহুতল আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রাখার নিয়ম থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। অনেক ভবনে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নেই, ফলে অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি আরও বেড়ে গেছে। বিপণিবিতান ও মার্কেটগুলোয় অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রের অভাব রয়েছে, আবার থাকলেও এগুলোর সঠিক ব্যবহার জানেন না দোকান মালিক ও কর্মচারীরা।

অগ্নিনির্বাপণ সরঞ্জামের অভাব ও অসচেতনতা: সরেজমিন দেখা যায়, সাভার বাসস্ট্যান্ড ও আশপাশের এলাকাগুলোয় বেশকিছু বহুতল ভবন ও বিপণিবিতান গড়ে উঠেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভবনগুলোর মধ্যে নিরাপদ দূরত্ব রাখা হয়নি। বিপণিবিতান ও মার্কেটগুলোর অধিকাংশ দোকানে অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র নেই, আবার যেগুলো আছে, সেগুলোর ব্যবহার জানেন না দোকান মালিক ও কর্মচারীরা।

সাভারের অন্ধ মার্কেটের এক কর্মচারী বলেন, ‘আমাদের মার্কেটে বেশিরভাগ দোকানে ফায়ার এক্সটিংগুইশার নেই। দু-একটি দোকানে থাকলেও কেউ সেগুলো ব্যবহার করতে জানে না। আমরা ভয় নিয়ে কাজ করি, কিন্তু কেউ নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্ব দেয় না।’

সাভারের রাজ্জাক প্লাজার এক দোকান মালিক সজিব হোসেন বাবু বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা করছি, অগ্নিকাণ্ডের বড় কোনো ঘটনা ঘটেনি। তবে আমার দোকানে ফায়ার এক্সটিংগুইশার আছে, কিন্তু কীভাবে ব্যবহার করতে হয়, জানি না। আমাদের উচিত অগ্নিনির্বাপণ প্রশিক্ষণ নেওয়া, যাতে দুর্ঘটনার সময় দ্রুত ব্যবস্থা নিতে পারি।’

রাজ্জাক প্লাজার আরেক দোকান মালিক কামরুল হাসান রুবেল বলেন, ‘আমার তিনটি দোকান রয়েছে, সবখানেই অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র আছে, কিন্তু এগুলো ব্যবহার করা শিখিনি। গরমের সময় আগুন লাগার ঘটনা বেশি ঘটে। তাই আমি চাই সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অগ্নিনির্বাপণে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করুক। যদি এসব যন্ত্রের দাম কমানো হয়, তাহলে আরও মানুষ এগুলো কিনতে পারবে।’

গ্যাস লিকেজ থেকে ভয়াবহ দুর্ঘটনা: সম্প্রতি গ্যাসের লিকেজ থেকে সাভারের আশুলিয়ায় এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ১১ জন দগ্ধ হন, মারা যান ৩ জন। আশুলিয়ার গোমাইল এলাকায় ভাই সুমন রহমানের বাসায় বেড়াতে গিয়েছিল তার পরিবার। বিকেলে রান্নাবান্না চলছিল, সন্ধ্যার আগে জানালা বন্ধ করে দেওয়া হয়। রাত সাড়ে ৯টার দিকে রান্নাঘরের চুলা জ্বালাতে গেলে বিকট শব্দ হয়, মুহূর্তেই পুরো ঘরে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। এতে পরিবারের ১১ জন দগ্ধ হন, পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সুমন, তার স্ত্রী শারমিন ও বোন শিউলি মারা যান।

একই দিন আশুলিয়ার দুর্গাপুর চালাবাজার এলাকায় গ্যাসের সিলিন্ডার লিকেজ থেকে ঘরে জমে থাকা গ্যাস বিস্ফোরণে একই পরিবারের ৩ জন দগ্ধ হন।

এ ছাড়া সাভারের হেমায়েতপুরে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে ৭ জন দগ্ধ হন, একজন নারী মারা যান। আহতদের মধ্যে ৬ জন এখনো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

ফায়ার সার্ভিসের সতর্কবার্তা: সাভার ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স স্টেশনের সিনিয়র অফিসার নুরুল ইসলাম বলেন, ‘অগ্নিকাণ্ডের প্রধান কারণ মানুষের অসাবধানতা। আমরা প্রতিনিয়ত দেখি, বাড়িঘর ও স্থাপনাগুলো সঠিক নিয়ম মেনে তৈরি করা হচ্ছে না। রাস্তার অভাবে অনেক সময় আমরা সময়মতো ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে পারি না, ফলে ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে যায়।’

ফায়ার সার্ভিস ঢাকা জোনের উপসহকারী পরিচালক মো. আলাউদ্দিন বলেন, ‘সচেতনতা বাড়ানো ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত না করলে অগ্নিকাণ্ডের সংখ্যা কমবে না। অনেকেই অনুমোদিত ডিলারের কাছ থেকে গ্যাস সিলিন্ডার কেনেন না, ফলে পুরোনো বা মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘সাধারণত গ্যাস সিলিন্ডার বা লিকেজ হলে গ্যাস উপরের দিকে যায় না, নিচে জমে থাকে। যদি কেউ তখন আগুন জ্বালায় বা চুলা ধরায়, মুহূর্তেই বিস্ফোরণ ঘটে। এ কারণে দুর্ঘটনা বাড়ছে।’

অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে করণীয়: ফায়ার সার্ভিসের পরামর্শ অনুযায়ী, অগ্নিনির্বাপণ সরঞ্জাম সহজলভ্য করতে হবে এবং প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করতে হবে। গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহারের সময় নিয়ম মেনে চলতে হবে এবং মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার পরীক্ষা করতে হবে। বৈদ্যুতিক তার ও সংযোগগুলোর নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। অগ্নিনির্বাপণের জন্য ফায়ার সার্ভিসের জরুরি নম্বর সংরক্ষণ করতে হবে। যথাযথ পরিকল্পনা অনুযায়ী ভবন ও মার্কেট তৈরি করতে হবে, যাতে ফায়ার সার্ভিস দ্রুত উদ্ধার কাজ চালাতে পারে।

ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা মো. আলাউদ্দিন বলেন, ‘আমাদের কাছে পর্যাপ্ত জনবল ও সরঞ্জাম রয়েছে, কিন্তু মানুষের অসচেতনতা বড় বাধা। দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমাতে জনগণকেই সচেতন হতে হবে।’

সচেতনতা ও সতর্কতাই পারে অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি কমাতে: সাধারণ মানুষের অসচেতনতা ও অবহেলা অগ্নিকাণ্ডের সংখ্যা বাড়িয়ে তুলছে। প্রতিদিনই নতুন নতুন দুর্ঘটনার খবর আসে, যেখানে সাধারণ জনগণ একটু সচেতন হলে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো সম্ভব। ফায়ার সার্ভিসের দাবি, সচেতনতা বাড়ানো হলে দুর্ঘটনার হার কমবে এবং ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও কমে আসবে।

ফায়ার সার্ভিস, স্থানীয় প্রশাসন ও জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় কেবল সাভার ও ধামরাইয়ের মতো এলাকা থেকে অগ্নিকাণ্ডের ভয়াবহতা কমানো সম্ভব। সংশ্লিষ্টদের এখনই উদ্যোগী হতে হবে, যাতে অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনায় আর কোনো প্রাণহানি না ঘটে।