Image description
 

২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারিতে বিডিআর বিদ্রোহ উপলক্ষে পিলখানায় ৩৩ ঘণ্টাব্যাপী পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞ, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ ও শ্লীলতাহানির ঘটনা ঘটেছে, এটি কি কোনো পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী হয়েছে, নাকি একটি নিছক তাৎক্ষণিক ঘটনা ছিল, তা বিশ্লেষণ করলে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, এটি একটি অত্যন্ত পরিকল্পিত ঘটনা ছিল।

তাই, প্রশ্ন উঠেছে, দেশের প্রধান গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কি এ বিষয়ে সরকারকে কোনো আগাম সতর্ক বার্তা দিয়েছিল? যদি দিয়ে থাকে, তবে তা প্রতিহত করার জন্য কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল? যদি না দিয়ে থাকে, তবে কেন দিতে পারেনি? এর দায়-দায়িত্বই বা কার ছিল?

ঘটনার শুরু থেকে বিভিন্ন বিষয়ে করণীয় সম্পর্কে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে গোয়েন্দা তথ্যের কোনো বিকল্প নেই। আলোচ্য ক্ষেত্রে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও বিডিআরের নিজস্ব গোয়েন্দা ইউনিটগুলোর ভূমিকা কী ছিল, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

১. সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে নীতিনির্ধারণী অথবা কৌশলগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে;

২. বিদ্রোহীদের সঙ্গে দফায় দফায় আলোচনায় বসার, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ তারিখে লিফলেট বিতরণ এবং দুদিন আগে তিনটি এসএমজি হারানোর ক্ষেত্রে;

৩. বিদ্রোহের পরপরই কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেছিল কি না, দুপুর থেকেই প্রতিবেশী দেশের মিডিয়া তিনজনের মৃত্যুর খবর জানলেও দেশি সংস্থা বা মিডিয়া না জানা;

৪. বেলা ২টা নাগাদ দুটি মৃতদেহ ড্রেন দিয়ে বেরিয়ে এলেও তা বিদ্রোহী/খুনিদের সঙ্গে আলোচনায় না আসা;

৫. ১৪ সদস্যের বিদ্রোহী/খুনিদের দলের নামীয় তালিকা ও পরিচিতি নথিভুক্তির না-করণ;

৬. তিন বাহিনীপ্রধানকে যমুনায় উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও আলোচনায় না রাখা;

৭. বিদ্রোহী/খুনি দল যমুনায় থাকাকালে হত্যাকৃতদের মৃতদেহ ও জিম্মি অন্যান্য অফিসার ও পরিবারকে কোথায় ও কী অবস্থায় রাখা হয়েছে, তা নিশ্চিত না করা ইত্যাদি;

৮. প্রকৃত ও যোগ্য আপস আলোচক নিয়োগ না করা এবং সামরিক কার্যক্রমের পরিবর্তে রাজনৈতিকভাবে সমস্যা সমাধানের সিদ্ধান্তের কারণ;

৯. সর্বোপরি, সরকারপ্রধানের সঙ্গে বিদ্রোহী দলের নেতাদের বৈঠকের আগে আলোচনায় সহায়ক তথ্য কি সরবরাহ করা হয়েছিল? হলে তার প্রতিফলন আলোচনায় ছিল না কেন?

উপরোল্লিখিত সব বিষয়ে সংগৃহীত তথ্য সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা সংস্থা কর্তৃক সরকারপ্রধানের কাছে অবশ্যই উপস্থাপনীয় ছিল। কিন্তু তা করা হয়নি বা এ ধরনের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ বিডিআর সপ্তাহ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীর প্যারেড গ্রহণ করবেন। এ উপলক্ষে পিলখানায় কোনো হামলা অথবা বিশৃঙ্খলার হুমকি ছিল কি না, এ বিষয়ে কোনো সংস্থা কোনো আগাম বার্তা সরবরাহের প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

ওপরে বর্ণিত প্রশ্নগুলো দেশের প্রধান তিনটি গোয়েন্দা সংস্থাÑ এনএসআই, এসবি ও ডিজিএফআইয়ের কাছে উপস্থাপন করেছিল।

জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা মহাপরিচালকের দপ্তর থেকে প্রধানমন্ত্রীর পিলখানা সফর উপলক্ষে একটি প্রতিবেদন ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০০৯-এ এসএসএফের কাছে পাঠানো হয়। এই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘বর্ণিত কর্মসূচিতে যোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে ভিআইপির ব্যক্তি নিরাপত্তায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ হুমকি-সংক্রান্ত কোনো তথ্য আপাতত নেই।’ প্রতিবেদনে পরিস্থিতি মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলা হয়, ‘... ভিআইপি কর্তৃক অনুষ্ঠানস্থলে অবস্থান ও গমনাগমন পথে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠনের নাশকতামূলক তৎপরতার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না বিধায় ভিআইপির নিরাপত্তাব্যবস্থায় সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা সমীচীন।’ এ ছাড়া এনএসআই ভিভিআইপির সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য কিছু রুটিন সুপারিশ করেছে। বিদ্রোহ চলাকালে এবং বিদ্রোহ-পরবর্তী সময়েও এ সংস্থার তেমন কোনো তৎপরতা পরিলক্ষিত হয়নি।

এসবি থেকে তদীয় অতিরিক্ত মহাপরিদর্শকের স্বাক্ষরে গত ৫ মার্চ ২০০৯ তারিখে একটি প্রতিবেদন পাঠানো হয়। তিনি নিজে শুনানিতে উপস্থিত হয়ে বক্তব্য দেন।

সরকারপ্রধানের পিলখানা আগমন উপলক্ষে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর ২২ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ তারিখে একটি প্রতিবেদন মহাপরিচালক, স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সের (এসএসএফ) কাছে পাঠায়। এই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, সন্ত্রাসী চক্রের সংঘবদ্ধ বা বিচ্ছিন্নভাবে আক্রমণের সুনির্দিষ্ট কোনো হুমকির সম্ভাবনা নেই।

২৫ ফেব্রুয়ারি বিডিআর বিদ্রোহ সম্পর্কে এসবি, এনএসআই ও ডিজিএফআইয়ের লিখিত এবং ব্যক্তিগত জিজ্ঞাসাবাদে প্রদত্ত বক্তব্য পর্যালোচনায় নিম্নোক্ত বিষয়গুলো পরিলক্ষিত হয়Ñ

ক. বিডিআরের নিজস্ব গোয়েন্দা ইউনিট তথা রাইফেল সিকিউরিটি ইউনিটে (আরএসইউ) কর্তব্যরত বিডিআর সদস্যরা (এফএস) নিজেরাই বিদ্রোহে জড়িত থাকায় বিদ্রোহ-সংক্রান্ত কোনো আগাম গোয়েন্দা তথ্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। একই সঙ্গে আরএসইউতে দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের এ বিষয়ে অসচেতনতা ও ব্যর্থতা গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহকে বাধাগ্রস্ত করেছে।

খ. কোনো সংস্থার কাছে ২৫ ফেব্রুয়ারির বিডিআর বিদ্রোহ সম্পর্কে কোনো সুনির্দিষ্ট আগাম তথ্য ছিল না, যা দিয়ে বিদ্রোহ প্রতিহত করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা বা কৌশল নেওয়া যেত।

গ. ২৩ ফেব্রুয়ারি তারিখে বিডিআর সদস্যদের দাবি-দাওয়া-সংবলিত প্রধানমন্ত্রীকে আহ্বান করা লিফলেটটি এনএসআইয়ের নজরে আসে এবং তাৎক্ষণিক তারা মৌখিকভাবে তা আরএসইউ সদস্য মেজর মাহমুদুল হাসানকে অবহিত করে। কিন্তু বিষয়টি এনএসআই সরকারকে জানায়নি। উল্লেখ্য, এই লিফলেটটি ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে প্রচার করা হয় এবং বিডিআর কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে অবহিত ছিল।

ঘ. লিফলেটটিতে সেনা কর্মকর্তাদের ‘কুকুরের মতো সরাবো’ মর্মে যে হুমকি দেওয়া হয়েছে, তা এনএসআই ও বিডিআর কর্তৃপক্ষ যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছে বলে প্রতীয়মান হয় না।

ঙ. এনএসআই, এসবি ও ডিজিএফআইয়ের পিলখানার ভেতরে কোনো গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক না থাকার দাবিতে তারা ঘটনার আগে বা চলাকালীন সময়ে সরকারকে প্রয়োজনীয় তথ্য দিতে ব্যর্থ হয়েছে বলে দাবি করে।

চ. নিজস্ব সোর্সের মাধ্যমে ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারিতে কোনো সংস্থাই ঝুঁকি নিয়ে হলেও পিলখানার ভেতরের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহের উদ্যোগ নেয়নি বলে দাবি করে।

ওপরে বর্ণিত অবস্থাগুলো জাতীয় দুর্যোগকালে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর অদক্ষতা, অপেশাদারিত্ব ও অমার্জনীয় ব্যর্থতার চিত্রই তুলে ধরে না, এই হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ততা সম্ভাবনাকেও নিশ্চিত করে। এ থেকে পরিত্রাণের জন্য সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কার্যক্রম ব্যাপকভিত্তিক তদন্তের আওতায় এনে দায়ীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও গ্রহণ। এ ছাড়া তাদের কার্যপদ্ধতি ঢেলে সাজানোর জন্য একটি কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স ফোর্স গড়ে তোলাসহ একটি সমন্বিত গোয়েন্দা কার্যক্রম গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয় ছিল।

এ ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে আনিসুজ্জামান তদন্ত কমিশনের খসড়া প্রতিবেদনে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের নিমিত্ত জরুরি ভিত্তিতে নিম্নলিখিত স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি (short and long term) সুপারিশগুলো প্রস্তাব করার উল্লেখ ছিল। চূড়ান্ত প্রতিবেদনে ওই সুপারিশগুলো কি স্থান পেয়েছিল?

কমিশন কর্তৃক গোয়েন্দা বাহিনী-সংক্রান্ত স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি সুপারিশগুলোর উল্লেখযোগ্য কিছুই বাস্তবায়িত না হওয়ার কারণ বোধগম্য নয়Ñ

১. বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনাকে ‘মিউটিনি’ (Mutiû) আখ্যায়িত করে প্রয়োজনীয় প্রজ্ঞাপন জারি-পূর্বক সেনাবাহিনীর আইনের আওতাধীন সবার বিরুদ্ধে (গোয়েন্দা বাহিনী ও প্রেষণে নিয়োজিতসহ) অনতিবিলম্বে ‘ফিল্ড জেনারেল কোর্ট মার্শাল’ (Field General Court Martial)-এর মাধ্যমে দ্রুত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ । আপিল বিভাগ কর্তৃক বিচারিক পদ্ধতি-সংক্রান্ত রায়ে এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি বেমালুম অগ্রাহ্য করা ইচ্ছাকৃত নয়তো?

২. এ ধরনের জাতীয় সংকট মোকাবিলার জন্য অবিলম্বে সর্বোচ্চ পর্যায়ে একটি ‘জাতীয় সংকট মোকাবিলা কমিটি (National Crisis Management Committee- NCMC)’ গঠন।

৩. বিডিআর বিদ্রোহের ষড়যন্ত্র যথাসময়ে উদ্‌ঘাটনে ব্যর্থতার জন্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এবং বিদ্রোহ দমনে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত প্রদানে ব্যর্থ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ;

৪. সব গোয়েন্দার দায়িত্ব ও কর্তব্য পুনর্বণ্টন এবং সর্বোচ্চ পর্যায়ে একটি ‘কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সমন্বয় কমিটি (National Intelligence Coordiantion Committee- NICC)’ গঠনের মাধ্যমে সব গোয়েন্দা তথ্য পর্যালোচনার ব্যবস্থা গ্রহণ।

তথাকথিত বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে সংঘটিত একটি সুপরিকল্পিত ও নিকৃষ্টতম হত্যাকাণ্ড। শুধু বিডিআর বা সেনাবাহিনীর মধ্যেই নয়, এর প্রভাবগুলো ছিল বহুমুখী ও সুদূরপ্রসারী, যা বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বকে করেছিল হুমকির সম্মুখীন। জাতি এমন কোনো ঘটনার পুনরাবৃত্তি আর কখনো দেখতে চায় না। ৩৬ জুলাই পরবর্তী বাংলাদেশ বিনির্মাণে আজ সরকার তথা প্রতিটি দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানকে নিজ নিজ ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট ও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে।