
হঠাৎ করে সারা দেশেই বেড়েছে অস্ত্রের ঝনঝনানি। দেশি-বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে প্রায়ই অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে। জমি নিয়ে বিরোধে পিস্তলের ভয়, চলন্ত বাসে অস্ত্র ঠেকিয়ে ছিনতাই, নারীকে ধর্ষণ, তরুণীকে শ্লীলতাহানি, বিয়ের হুমকি, ডাকাতির সময় গুলি, চাঁদা না পেয়ে গুলি, খুন খারাবি, জমি দখল, আধিপত্য বিস্তারে অস্ত্রের ব্যবহার হচ্ছে হরহামেশা। আগ্নেয়াস্ত্রের মহড়ার খবর তো মাঝেমধ্যে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসছে। কিন্তু দেশে এত অস্ত্রের ছড়াছড়ি থাকা সত্ত্বেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দৃশ্যত কোনো পদক্ষেপই চোখে পড়ার মতো না। অভিযান চালিয়ে মাঝেমধ্যে কিছু অস্ত্র উদ্ধার করা হচ্ছে। যদিও যে পরিমাণ অস্ত্রের ছড়াছড়ি সে তুলনায় উদ্ধার খুবই কম। এমনকি থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্রও এখন পর্যন্ত পুরোপুরি উদ্ধার সম্ভব হয়নি। উদ্ধার না হওয়া আগ্নেয়াস্ত্র যে শঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে সেটি নীতি নির্ধারকদের বক্তব্য স্পষ্ট। শুধু লুট হওয়া পুলিশের অস্ত্র নয়। সাম্প্রতিক সময়ে দেশে অবৈধ অস্ত্রেরও আনাগোনা বেড়েছে।
থানা থেকে লুটের অস্ত্র উদ্ধারের বিষয়ে জানতে চাইলে কিছুদিন আগে পুলিশ মহাপরিদর্শক বাহারুল আলম মানবজমিনকে বলেছিলেন, এসব অস্ত্র তো অপরাধীদের কাছে চলেই গেছে। সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এসব অস্ত্র উদ্ধারে এখনো নতুন কোনো পদ্ধতি উদ্?ঘাটন করতে পারিনি যেটা দিয়ে অস্ত্র উদ্ধার করে ফেলতে পারবো। আমি মনে করি আমরা যদি মানুষের আস্থাটা আরেকটু অর্জন করতে পারি এবং তাদের কাছে যেতে পারি তবে তারাই আমাদের বলবে কোথায় কোথায় অস্ত্র আছে। এ ছাড়া মানুষের সহযোগিতা ছাড়া অস্ত্র উদ্ধার সম্ভব নয়। সর্বশেষ গত ১৮ই ফেব্রুয়ারি রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে জেলা প্রশাসক (ডিসি) সম্মেলনে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এবং সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ সংক্রান্ত অধিবেশন শেষে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) আব্দুল হাফিজ সাংবাদিকদের জানান, জেলা প্রশাসক হিসেবে আগামী দিনে কী কী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে সে বিষয়ে বলেছি। যেমন- আমি বলেছি প্রায় ১ হাজার ৪০০ অস্ত্র এখনো উদ্ধার হয়নি, যেগুলো ৫ই আগস্ট পরবর্তী সময়ে লুট হয়েছিল। আড়াই লাখ গুলি এখনো উদ্ধার হয়নি। সেগুলো তাদের জেলায় কোনো না কোনো জায়গায় আছে। সেগুলো সন্ত্রাসীদের হাতে পড়তে পারে এবং তারা ব্যবহার করতে পারে। আইজিপি ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারীর বক্তব্যে স্পষ্ট লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধারের ভবিষ্যৎ ও এ নিয়ে কতটুকু চ্যালেঞ্জ হতে পারে।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য মতে ৫ই আগস্টের পর দেশের বিভিন্ন থানা ও ফাঁড়ি থেকে মোট ৫ হাজার ৭৫০টি বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র লুট হয়েছিল। আর গোলাবারুদ ৬ লাখ ৫১ হাজার ৯৬৯ রাউন্ড। লুট হওয়া অস্ত্রের মধ্যে উদ্ধার হয়েছে ৪ হাজার ৩৬৬টি। এখনো উদ্ধার হয়নি ১ হাজার ৩৮৪টি। আর লুট হওয়া গোলাবারুদ থেকে উদ্ধার হয়েছে ৩ লাখ ৯১ হাজার ৪৩৮ রাউন্ড। এখনো উদ্ধার হয়নি ২ লাখ ৬০ হাজার ৫৩১ রাউন্ড। লুট হওয়া অস্ত্র-গোলাবারুদ ফেরত দিতে ওই সময় দেশবাসীর কাছে অনুরোধ জানায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। গত বছরের ৩রা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়। এরপর ৪ঠা সেপ্টেম্বর থেকে দেশ জুড়ে যৌথ বাহিনীর অভিযান শুরু হয়।
পুলিশ সদর দপ্তর জানিয়েছে, লুট হওয়া অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে, এসএমজি, এলএমজি, বিভিন্ন ধরনের রাইফেল, পিস্তল, শটগান, গ্যাসগান। এ ছাড়াও রয়েছে কাঁদানে গ্যাস লঞ্চার, কাঁদানে গ্যাসের শেল, কাঁদানে গ্যাসের স্প্রে, সাউন্ড গ্রেনেড, বিভিন্ন বোরের গুলি। গণভবনের দায়িত্বে থাকা এসএসএফ সদস্যদের বিশেষায়িত অস্ত্র ও বিভিন্ন সরঞ্জামাদি এখনো উদ্ধার হয়নি। শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পরপরই বিক্ষুব্ধ জনতা গণভবনে ঢুকে লুট করে। এসবের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের ট্যাক্টিক্যাল গিয়ার, অস্ত্র, গোলাবারুদ, সাজসরঞ্জাম, বেতার যোগাযোগ ও অপারেশনাল সরঞ্জামাদির মজুত ছিল। এ ছাড়া জাতীয় সংসদ ভবনেও এসএসএফের অস্ত্র গোলাবারুদ মজুত ছিল। ৫ই আগস্ট জনতা গণভবন ও জাতীয় সংসদ ভবনে প্রবেশ করার পর ওইসব অস্ত্র লুট হয়ে যায়। লুট হওয়া অস্ত্রের মধ্যে অত্যাধুনিক অ্যাসল্ট রাইফেল, স্নাইপার রাইফেল, ফ্ল্যাশব্যাং গ্রেনেড, অ্যান্টি-ড্রোন সিস্টেম, বেতার যোগাযোগের ডিভাইস ও বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদসহ ৩২টি ভারী অস্ত্র এখনো উদ্ধার হয়নি।
পুলিশ সূত্র মতে, দেশে লাইসেন্স থাকা বৈধ অস্ত্রের সংখ্যা ৫০ হাজার ৩১০টি। এরমধ্যে ব্যক্তির হাতে ৪৫ হাজার ২২৬টি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে পাঁচ হাজার ৮৪টি অস্ত্র আছে। ব্যক্তিগত অস্ত্রের মধ্যে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের কাছে আছে সাত হাজার ৫৪৯টি। অনেক বিতর্কিত রাজনীতিকের হাতে বৈধ অস্ত্রের পাশাপাশি অবৈধ অস্ত্রও রয়েছে।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, লুট হওয়া অস্ত্র ও অবৈধ অস্ত্র নিরাপত্তা হুমকি তৈরি করেছে। এসব অস্ত্র এখন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ কথায় কথায় এখন অস্ত্রের ব্যবহার হচ্ছে। ইতিমধ্যে গত কয়েক মাসে অস্ত্র ব্যবহার করে যতগুলো অপরাধ সংঘটিত হয়েছে অন্যান্য সময় পুরো বছরে এত অপরাধ হয় না। তাই উদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত নিরাপত্তা ঝুঁকি থেকে যাবে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) মুনীরুজ্জামান মানবজমিনকে বলেন, ওই সময় যেসব অস্ত্র লুট হয়েছে তার মধ্যে পুলিশের অস্ত্র ছাড়াও এসএসএফ’র কিছু বিশেষায়িত অস্ত্র ছিল সেগুলোও তারা এখনো খুঁজে পায়নি। কাজেই এগুলো আমাদের নিরাপত্তার জন্য বড় ঝুঁকি থাকবে। অস্ত্র উদ্ধারে যে অভিযান চালানো হয়েছিল সেটিতে পুরোপুরি অস্ত্র উদ্ধার করতে পারেনি। তাই আরও জোরদার অভিযান চালাতে হবে। গোয়েন্দা সংস্থার সাহায্য আরও নিতে হবে যাতে অস্ত্র উদ্ধারে যেসব তথ্য দরকার সেগুলো দিয়ে যেন তারা মাঠ পর্যায়ে গিয়ে অভিযান চালিয়ে উদ্ধার করার চেষ্টা করে। এ ছাড়া অস্ত্র উদ্ধারের জন্য নতুন কোনো পদ্ধতি বের করতে হবে। ক্রিয়েটিভ এবং ইনোভেটিভ আইডিয়া ব্যবহার করতে হবে। গোয়েন্দা সংস্থাকে ব্যবহার করতে হবে। তাহলে উদ্ধারের প্রচেষ্টা আরও জোরদার হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও অপরাধ বিশ্লেষক ড. তৌহিদুল হক বলেন, লুট হওয়া অস্ত্র যদি উদ্ধার করা না হয় তবে নিরাপত্তার ঝুঁকি থেকেই যায়।