Image description
দখল-চাঁদাবাজিতে ক্ষোভ, আইনশৃঙ্খলা নিয়ে ভয়

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর মানুষের মধ্যে বড় ধরনের আশা জেগেছিল। দখল-চাঁদাবাজি আর হবে না। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হবে। কিন্তু সরকারের দায়িত্ব নেয়ার ছয় মাসেও মানুষের সেই আশা খুব একটা পূরণ হয়নি। বরং নতুন করে দখল-চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ কোনো কোনো এলাকার মানুষ। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই বেড়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা দৃশ্যমান নয়। সরজমিন ঢাকার পাশের চারটি জেলা ঘুরে এমন চিত্রই মিলেছে। গত দুইদিন এসব জেলার নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে মিলেছে তাদের উদ্বেগের তথ্য। মানুষ মনে করছে, সরকারের জন্য শুরুতে পরিস্থিতি সামাল দেয়া কঠিন ছিল। কিন্তু ছয় মাস পর সবকিছু তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকার কথা। কিন্তু অবস্থা খুব একটা বদলায়নি। নতুন করে অপরাধীরা মাঠে নেমেছে। তাদের ভয় দেখানোর জন্য বা আইনের আওতায় আনার জন্য সরকারের উদ্যোগ কার্যকর হচ্ছে না। ঘোষণা দিয়ে অপারেশন ডেভিল হান্ট নিয়েও সন্দিহান অনেকে।

গাজীপুরে পুলিশের সংকট, সুযোগ নিচ্ছে অপরাধীরা: গাজীপুর বাংলাদেশের অন্যতম শিল্পসমৃদ্ধ অঞ্চল, যেখানে অসংখ্য পোশাক কারখানা ও অন্যান্য শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে এই অঞ্চলে শিল্প কারখানা ঘিরে শ্রমিক অসন্তোষ, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির তথ্য মিলছে। চুরি, ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে। শিল্প কারখানায় কাজ করেন ৮০ শতাংশ নারী শ্রমিক। রাতের বেলা অফিস শেষ করে বাসায় ফিরতে তারা নিরাপদ বোধ করছেন না। গার্মেন্টস ছুটির পর নারীরা সবাই দলবেঁধে বাসায় যাচ্ছেন। অজানা এক আতঙ্কে দিন পার করতে হচ্ছে সবাইকে। পর্যাপ্ত পুলিশের সংকট রয়েছে।

কোনাবাড়ি এলাকার নারী শ্রমিক সায়রা খাতুন বলেন, প্রতিনিয়ত যেভাবে ছিনতাই আর চুরি হচ্ছে। তাতে গার্মেন্টসে গেলেও আমরা নিজেরা নিরাপদ না। নারীদের এমনিতেও রাতের বেলা চলাচল করা সমস্যা। তার উপরে আইনশৃঙ্খলার এমন অবনতি ঘটেছে চারিদিকে। আমরা এজন্য রাতের বেলা গার্মেন্টস ছুটি হলে সব নারীরা একসঙ্গে দলবেঁধে বাসায় যাই। 

আবিদা আক্তার নামে এক নারী বলেন, দেশের বাড়িতে কাজ নেই এজন্য গাজীপুরে এসেছি। গার্মেন্টসে কাজ করে জীবন চালাই। আমরা নারীরা এখন বেশি আতঙ্কে। কোনাবাড়ির এ রাস্তায় টহল পুলিশ চোখে পড়ার মতো না। মাঝেমধ্যে সেনাবাহিনীর দু’একটা গাড়ি এসে ঘুরে যায়। বখাটে আর নেশাখোরের উৎপাতও বেড়েছে।

স্থানীয় ব্যবসায়ী আবুল কালাম বলেন, বাজারে দোকান করি। কিন্তু দ্রুত বাসায় যাওয়ার চেষ্টা করি রাতে। রাতের বেলা গাজীপুর কেমন যেন হয়ে গেছে। এখন আর আগের মতো নেই। পুলিশের তৎপরতাও কম। 

রমজান নামে স্থানীয় এক যুবক জানান, আমি ছোটবেলা থেকেই বাবা-মায়ের সঙ্গে এখানে বড় হয়েছি। সবাই আমরা কাজ করে খাই। কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত বেড়েছে। বেড়েছে চুরি, ছিনতাই।

সরজমিন রাতে বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, কোনাবাড়ি ও চৌরাস্তার মতো ব্যস্ত জায়গায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা চোখে পড়ার মতো না। ঘটনা ঘটার পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে আসছে। চৌরাস্তার বেশির ভাগ জায়গায় ফুটপাথ এখন ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ীদের দখলে। সেখান থেকে চাঁদা আদায় করেন স্থানীয় নেতাকর্মীরা। গাজীপুরে ঝুট ব্যবসাকে কেন্দ্র করে একের পর এক সংঘর্ষ ঘটেছে সম্প্রতি। স্থানীয়দের অভিযোগ, সড়কের বিভিন্ন স্থানে ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্য দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে টঙ্গী স্টেশন রোড, উড়াল সেতু, নতুন বাজার, রেলস্টেশন, টঙ্গী বাজার ও উড়াল সেতু আব্দুল্লাহপুরসহ বিভিন্ন স্থানে ছিনতাইয়ের ঘটনা প্রায়শই ঘটছে। এ ছাড়া কোনাবাড়ি ফ্লাইওভারসহ টঙ্গী এলাকায় ছিনতাইয়ের ঘটনা বেড়ে চলেছে, যা সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার জন্য হুমকি।

ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের আবদুল্লাহপুর থেকে চান্দনা চৌরাস্তা পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার সড়কে প্রতিদিনই ঘটছে ছিনতাইয়ের ঘটনা। কখনো রাতের অন্ধকারে পথ আটকে, কখনো থেমে থাকা বাসের জানালা দিয়ে ছিনিয়ে নেয়া হচ্ছে যাত্রী-পথচারীদের মূল্যবান জিনিসপত্র। কেউ বাধা দিলে ছুরিকাঘাতে গুরুতর আহত হওয়াসহ প্রাণ হারাতে হচ্ছে অনেককে। স্থানীয় প্রতিনিধি ও বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অনেকগুলো ছিনতাই স্পট বা ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা রয়েছে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো আবদুল্লাহপুর বেইলি সেতুর দক্ষিণপাড়, সান্দারপাড়া রাস্তার মাথা, হোন্ডা গলি, শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালের পেছনে, মিলগেট, ন্যাশনাল টিউবস রোডের মাথা, সফিউদ্দিন রোডের মাথা, হোসেন মার্কেটের কাঠপট্টি, গাজীপুরা বাঁশপট্টি, তারগাছ ও চান্দনা চৌরাস্তায় ময়মনসিংহ বাস কাউন্টার এলাকা, চৌরাস্তা, কোনাবাড়ি ফ্লাইওভার, হাউজিং এলাকা ও শ্রীপুর ফ্লাইওভারের পাশের জায়গাগুলো।

গাজীপুর মেট্রোপলিটন বাসন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওসি কায়সার আহমেদ মানবজমিনকে বলেন, কিছুটা বেড়েছিল চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনা। তবে এখন আগের থেকে অনেক কমেছে। ডেভিল হান্টের পাশাপাশি আমরাও বিশেষ অভিযান পরিচালনা করছি।

সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার ড. মো. নাজমুল করিম খান মানবজমিনকে বলেন, আমাদের আরও পুলিশ দরকার। আমাদের সামর্থ্য দিয়ে যা করা দরকার সব করছি। গাজীপুর মেট্রোপলিটন এলাকা ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকার থেকে ২৫ বর্গ কিলোমিটার বড়। ঢাকায় পুলিশ রয়েছে ৩৫ হাজার, গাজীপুরে আছে এক হাজার ১০০। এত কম পুলিশ দিয়ে ঢাকার থেকে এত বড় একটা জায়গা সামাল দেয়া আমাদের জন্য কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। গাজীপুরকে নিরাপদ করতে হলে আরও পুলিশ সদস্য দরকার। 

সরজমিন মানিকগঞ্জ
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর হাত বদল হয়ে এখনো চলছে চাঁদাবাজি, দখলদারিত্ব, অবৈধ মাটি বিক্রি ও দলীয় সালিশি। সরজমিন মানিকগঞ্জ জেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে এই চিত্র। জেলার সিংগাইর ও সাটুরিয়া উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম ও ইউনিয়নের বাসিন্দারা জানিয়েছেন, আগে আওয়ামী লীগের দখলদারিত্ব থাকলেও পটপরিবর্তনে এখন দখলদারিত্বের নেতৃত্ব দিচ্ছে বিএনপি’র নেতাকর্মীরা। উপজেলা থেকে ইউনিয়ন পর্যন্ত সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা ভাগ-বাটোয়ারা করে এলাকায় চাঁদাবাজি করছে। হাটবাজারগুলোতে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের মতোই এখনো ইজারা নেয়া, চাঁদা তোলা হচ্ছে। কোথাও কোথাও নিজেদের মধ্যেও কোন্দল বাড়ছে দখলদারিত্ব ঘিরে। 

সমপ্রতি সাটুরিয়া উপজেলা পরিষদ কার্যালয় থেকে ‘১৪৩২ বাংলা সনের’ হাটবাজার ইজারার দরপত্র আহ্বান করা হয়। সূত্র জানায়, উপজেলা পরিষদের ডাকা ওই ইজারার দরপত্রে ডাকের সুযোগ পাচ্ছেন না সাধারণ মানুষ। উপজেলার এসব হাট-বাজার ইজারা পাচ্ছেন বিএনপি’র নেতাকর্মী বা তাদের ছত্রছায়ায় থাকা লোকজন। সর্বশেষ গত ১৯শে ফেব্রুয়ারি ক্রয়ের প্রথম পর্যায়ের তারিখ ঘোষণা করা হয়েছিল। উপজেলার ইজারা দেয়ার জন্য ডাকা বাজারগুলো হলো- জান্না, হরগজ, বালিয়াটি, তিল্লী, পারতিল্লী, সাভার, কান্দাপাড়া পুকুর হাটি, চর তিল্লি, উমানন্দপুর, গোপালপুর, দরগ্রাম, সাটুরিয়া, ছনকা, ধানকোড়া ও পল্লী হাট। উপজেলার ইজারায় ডাকা ওই সব বাজারের মধ্যে সাটুরিয়া এবং বালিয়াটি বাজার নিলামে বিক্রি অবশিষ্ট রয়ে গেছে। সূত্র আরও জানায়, বিএনপি’র নেতাকর্মীরা এসব বাজারগুলোর ইজারা কাউকেই নিতে দেয়নি। স্থানীয় এক রেস্তরাঁ মালিক বলেন, আওয়ামী লীগের আমলেও মাটি বিক্রি বন্ধ ছিল। কেউ মাটি বিক্রি করলেও রাতে করতো। তবুও নানা বাধা আসতো। তখন আবার মাটি বিক্রি বন্ধ থাকতো। কিন্তু এখন এসবের ধার ধারে না নেতারা। এখন দিনের আলোতেই সরাসরি বিক্রি হচ্ছে মাটি। 

সবুজ নামের সিংগাইরের বাউদিপাড়ার একজন বলেন, আইনশৃঙ্খলার ব্যাপক অবনতি হয়েছে। মারামারি, চুরি-ডাকাতি বেড়ে গেছে। খবর দেখলেই মন খারাপ হয় এসবে। নিরাপত্তা কোথায় আমাদের?   

সাটুরিয়া উপজেলার হাজীগঞ্জের ভুট্টা চাষি ফালু বলেন, আমরা যারা গ্রামে থাকি, অভাব-অনটনে থাকি আমরা তো চাই জিনিসপত্রের দাম যাতে কম থাকে। আমরা যাতে খেতে পারি ঠিকমতো।  তেল, চালের দাম কমালে হয়। চাষাবাদ করে যে ইনকাম এটা দিয়ে তো বেশি দাম হলে চলাই কষ্টকর। তাই সরকারকে বলবো দাম যেন কম রাখে। আর এখনই নির্বাচন না দিয়ে সরকারকে যেন আরও সুযোগ দেয়া হয়। 

মাহফুজুর রহমান নামের এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী বলেন, মানিকগঞ্জ বিএনপি অধ্যুষিত এলাকা। এ এলাকায় বিএনপি’র প্রভাব অনেক বেশি। আওয়ামী লীগের আমলে যদি এখানে সুষ্ঠু নির্বাচন হতো, তাদের জেতার কোনো সুযোগই ছিল না। 

চাঁদাবাজি, অবৈধ বালু উত্তোলনের নতুন চক্র মুন্সীগঞ্জে: স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গজারিয়া উপজেলা যেন অবৈধ টাকার খনি। এখানে অবৈধভাবে নদী থেকে বালু উত্তোলন করা হয়, এ ছাড়া তেল চুরি, মেঘনা নদী দিয়ে যাওয়া বালুর বাল্কহেড থেকে যাওয়ার সময় চাঁদা নেয়া হচ্ছে অহরহ। এ সকল কাজে স্থানীয় রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা জড়িত। এ ছাড়া এ উপজেলায় কয়েকটি গার্মেন্টস, সিমেন্ট ফ্যাক্টরি রয়েছে। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা এসব গার্মেন্টসের ঝুট এবং কাঁচামাল সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করছেন। সরকার পরিবর্তনের পর এসব নিয়ন্ত্রণেও হাত বদল হয়েছে। 

বালুকান্দি ইউনিয়নে আড়ালিয়া গ্রাম ও ভাটের চর এলাকা দিয়ে চলাচলকারী বাল্কহেড থেকে চাঁদা নিয়ন্ত্রণ করেন চান বাদশাহ নামের একজন। বিভিন্ন কোম্পানির লাইটার জাহাজ থেকে তেল চুরি করে এবং কম দামে তেল নিয়ে স্থানীয় পেট্রোল পাম্পে বিক্রি করার অভিযোগ পাওয়া গেছে স্থানীয় কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে। নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনেও জড়িত তারা। ইমামপুর ইউনিয়নের কালিপুরা গ্রামে তারা অবৈধভাবে নদী থেকে বালু উত্তোলন করছেন। বালুয়াকান্দি ও বাউশিয়া ইউনিয়নের সিমেন্ট ফ্যাক্টরি নিয়ন্ত্রণ করেন এমন কয়েকজনের নাম বলেছেন স্থানীয়রা। 

স্থানীয় শিক্ষার্থী ইয়ামিন বলেন, বালুচর, ভাসাইল ও লতব্দী ইউনিয়নে মাটিকাটা চক্র প্রতিনিয়ত মাটি কেটেই যাচ্ছে। তারা ফসলির জমির মাটি স্থানীয় ইটভাটায় বিক্রি করে। এরা জোরপূর্বক জমির মালিক থেকে কম দামে জমি ক্রয় করে কেউ জমি বিক্রি না করলে তাদের নির্যাতন করে জমি বিক্রয় করতে বাধ্য করায়। এই চক্রটির মূলহোতা লতব্দী ইউনিয়নের রামকৃষন্দি এলাকার জহির। জহিরকে ঝন্টু নামে এক যুবদল নেতা প্রশ্রয় দিচ্ছেন। আমরা ছাত্র সমাজ বারবার প্রশাসনকে বললেও তারা এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না। মাঝে মাঝে তারা অভিযান পরিচালনা করে কিন্তু কোনো সুফল আসেনি। আমরা বিষয়টি নিয়ে উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খানের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠকে বসেছি। কিন্তু কোনো সুরাহা পাইনি। তিনি বলেন, পলাশপুরে ধলেশ্বর নদীর মুখ বন্ধ করে ঢাকা সিটি গ্রুপ নামে একটি প্রতিষ্ঠান রিসোর্ট বানাচ্ছে এতে নদী তার নাব্য হারাচ্ছে। এসকল কর্মকাণ্ডে পরিবেশ হুমকির মুখে পড়ছে। তিনি বলেন, আমরা এসব বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের বলেছি কিন্তু কোনো প্রতিকার পায়নি । 

গজারিয়া উপজেলার সমিতি মার্কেট এলাকার বাসিন্দা আব্দুস সোবহান বলেন, সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা ছিল অনেক কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আমাদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। ভেবেছিলাম জমি দখল, চাঁদাবাজি, অবৈধ বালু উত্তোলন এগুলো বন্ধ হবে কিন্তু কিছুই হয়নি। এসব সমস্যা বেড়েছে আগে থেকে বহু গুণ। 

বাউশিয়া ইউনিয়নের আব্দুলাহপুর বাজারে চায়ের আড্ডায় কথা হয় মুকবুল মিয়ার সঙ্গে। মুকবুল বলেন, আগের চেয়ে ডাবল জমি দখল হচ্ছে প্রশাসন তো এগুলো প্রতিরোধ করছে না। কিসের জন্য  আন্দোলন করছে মানুষ এটা তো আন্দোলনের উদ্দেশ্য হলো না।

ভবের চরের স্থানীয় বাসিন্দা হযরত আলী ওষুধ কিনতে ফার্মেসিতে  এসেছিলেন। থানায় বিএনপি নেতারা সবসময় বসে থাকে, কেউ কোনো অভিযোগ নিয়ে গেলে তারা সব ডিল করে টাকার বিনিময়ে। থানায় নেতাদের কাজটা কি? চাঁদাবাজি, দখলবাজি যদি বন্ধ না হয় তাহলে সরকার পরিবর্তন হয়ে লাভটা হলো কি?  

ভবেরচর ইউনিয়নের বাসিন্দা রহমত আলী একটি চায়ের দোকানে বসে গল্প করছিলেন। তিনি বলেন, যারা আওয়ামী লীগের মিছিলে যেতো তারা এখন বিএনপিতে যোগ দিয়েছে। চাঁদাবাজি, প্রভাব বিস্তার চলছেই, বন্ধ নেই। অভিযোগ করে তিনি বলেন ভবের চর দিয়ে মিনিবাস যায়। আগে আওয়ামী লীগের নেতারা চাঁদা নিতো এখন বিএনপি’র নেতারা মিনিবাস প্রতি ২০০ টাকা করে চাঁদা নিচ্ছে। 

মুন্সীগঞ্জ পৌরসভার হাটলক্ষ্মীগঞ্জ এলাকার সোহাগ বলেন, সরকার যদি চাঁদাবাজি, জমি দখল, টেন্ডারবাজি নিয়ন্ত্রণ নিতে না পারে তাহলে আমরা চাই দুই মাসের মধ্যে নির্বাচন দিয়ে দিক। 

সরকারি হরগঙ্গা কলেজ তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী হাসিবুর। তার বাড়ি চরকেওয়ার ইউনিয়নে, তার এলাকার পরিস্থিতি কেমন তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, গ্রামে রাজনৈতিক চিত্রটা একটু ভিন্ন। সেখানে বংশভিত্তিক রাজনীতি চলে। আমাদের ইউনিয়নে দুইটি বংশের খুব প্রভাবশালী একটি হচ্ছে মৃধা বংশ অন্যটি মিঝি বংশ। মৃধারা আওয়ামী লীগের সময়ে রাজত্ব করতো পাশাপাশি মিঝি বংশের লোকদের সেফ করতো। সরকার পতনের পর এখন মিঝি বংশের লোকেরা রাজত্ব করছে। 

মুক্তারপুরের হাসানুর রহমান বলেন, আলুর কোল্ড স্টোরেজগুলো থেকে চাঁদা নেয়া হচ্ছে। এখানে সিন্ডিকেট কাজ করে। 

সিরাজদিখান উপজেলার ইছাপুর এলাকার বাসিন্দা মোরসালিন বলেন, বিগত ছয় মাসে আমরা সাধারণ জনগণ কিছুই পাইনি। আমরা স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার নিজ উপজেলার বাসিন্দা এই উপজেলায় থানা পুলিশ ঠিক মতো কাজ করে না। 

নারায়ণগঞ্জে আইনশৃঙ্খলা নিয়ে উদ্বেগ: শীতলক্ষ্যা নদীর পশ্চিম পাড়ে নারায়ণগঞ্জের সদর উপজেলার একটি থানা ফতুল্লা। ট্রলারে নদী পার হতে হতে কথা হয় বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্র তুহিনের সঙ্গে। বর্ষাকালে শীতলক্ষ্যা নদীর পানি একটু ভালো থাকলেও বছরের বাকি সময়গুলোতে ব্যবহাব অনুপযোগী হয়ে যায় বলে জানান তিনি। বলেন, নদী পথে নিরাপত্তা নিয়ে মানুষের উদ্বেগ বেড়েছে। কারণ আগের মতো এখন টহল দেখা যাচ্ছে না। 

উত্তর নরসিংপুরের আমীর হোসেন জানান, চাষাঢ়া নয়া বাজারে কাপড়ের ব্যবসার পাশাপাশি একটি গার্মেন্সে চাকরি করেন তিনি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতির কথা জানিয়ে তিনি বলেন, এখানে বেশি অপরাধ হয় রাতের বেলা। গার্মেন্টের কর্মীরা রাতে বের হলে ছিনতাইয়ের কবলে পড়তে হয়। এটা এখন নিয়মিত হচ্ছে। সরকারকে অপরাধ দমনে আরও কঠিন হওয়ার পরামর্শ তার।

নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ উপজেলার রূপসী এলাকা। বাসস্ট্যান্ড থেকে একটু দূরে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে, শেখ হাসিনার পতনে পর লুটপাট চালানো গাজী টায়ারের কারখানা। এ কারখানাটিতে গিয়ে দেখা গেল মো. এরশাদুল ইসলামকে। তিনি দীর্ঘ ১১ বছর এ কারখানায় নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছেন। তিনি বলেন, কারখানায় আগুন দিয়ে ও লুটপাট করে সব নিয়ে যাওয়ার কারণে দেশে টায়ারের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেক শ্রমিক বেকার হয়ে যাওয়ায় মানবেতর জীবনযাপন করছে। তিনি বলেন, এই অবস্থার চাইতে দ্রুত নির্বাচন হলে রাজনৈতিক দল দেশ চালাতে পারবে। 

তারাবো পৌরসভার কেরাম বোর্ড মোড়ের কাছে কথা হয় আব্দুল্লাহর সঙ্গে। স্টিলের পণ্য তৈরির কারখানার মালিক আব্দুল্লাহ কয়েক বছর আগে বাড়ি করেছেন এখানে। তিনি বলেন, আনন্দপল্লী এলাকায় তার একটি জমি জোর করে বিক্রিতে বাধ্য করেছে লেদার কারখানার মালিক। এ এলাকার সবাইকে বাধ্য করে জমি কিনে নিলেও ৫ই আগস্টের পর থেকে তিনি পলাতক রয়েছেন। নির্বাচনটা দ্রুত হলেই দেশের অবস্থা ভালো হবে বলে প্রত্যাশা তার। নির্বাচন হয়ে গেলে কোনো দল বা পক্ষ একক নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। তিনি বলেন, আমাদের এলাকায় চুরি ছিনতাই বেড়ে গেছে।

জেলার সোনারগাঁও উপজেলার সাদীপুর ইউনিয়নের গোয়ালবাড়ীর বেড়িবাঁধে কথা হয় আচার ব্যাবসায়ী মো. ইমরানের সঙ্গে। প্রতিদিনই চুরি, ছিনতাইয়ের সাক্ষী হচ্ছেন বলে জানান তিনি। বলেন, একটু মনোরম পরিবেশ হওয়ায় বিভিন্ন স্থান থেকে ঘুরতে আসে মানুষ। কিন্তু এখনকার পরিস্থিতি অত্যন্ত খারাপ। পুুলিশ কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারছে না। মানুষের ভয় কাটাতে হলে সেনাবাহিনীর টহল আরও জোরদার করার দাবি জানান তিনি।