
অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনায় সিলেট-ভোলাগঞ্জ আঞ্চলিক মহাসড়ক যেন মৃত্যুকূপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ সড়কে নেই সড়কবাতি। হাইওয়ে পুলিশের কোনো কার্যক্রমও নেই। অবৈধ পার্কিংয়ে সড়ক সরু হওয়া, নিষিদ্ধ যানবাহন চলাচল, লাইসেন্সবিহীন চালকের বেপরোয়া গতি ইত্যাদি কারণে প্রায়ই ঘটছে ছোট-বড় দুর্ঘটনা। এতে অনেকে প্রাণ হারাচ্ছে, পঙ্গু হচ্ছে কেউ কেউ।
মানুষ রাস্তায় আন্দোলন করেও এসব অনিয়মের কোনো প্রতিকার পাচ্ছে না। সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো থেকে নেওয়া হচ্ছে না কোনো ব্যবস্থা। সিলেট-ভোলাগঞ্জ মহাসড়ক দিয়েই যেতে হয় পর্যটনকেন্দ্র সাদা পাথরে। তাই এ সড়ক ব্যবহার করে বিপুলসংখ্যক পর্যটক। এরই মধ্যে দুর্ঘটনায় অনেক পর্যটক প্রাণ হারিয়েছে।
নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) জানিয়েছে, সিলেট জেলায় ২০২৪ সালে ১৫৫টি সড়ক দুর্ঘটনায় ১৫৭ জন নিহত হয়েছে। তাদের মধ্যে জেলার সিলেট-ভোলাগঞ্জ সড়কে সর্বোচ্চ ২২টি দুর্ঘটনায় ২৩ জন নিহত হয়েছে। চলতি মাসের প্রথমার্ধে এই সড়কে দুর্ঘটনায় জন প্রাণ হারিয়েছে। ৯ ফেব্রুয়ারি রাতে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রাকের পেছনে ধাক্কা দিয়ে মোটরসাইকেল আরোহী এক পল্লিচিকিৎসক নিহত হন। ১২ ফেব্রুয়ারি ট্রাকের ধাক্কায় পর্যটক এক শিশু প্রাণ হারায়, ১৬ ফেব্রুয়ারি দুই ট্রাকের সংঘর্ষ এক ট্রাকচালকের মৃত্যু হয় এবং ১৭ ফেব্রুয়ারি ট্রাকের ধাক্কায় সিএনজিচালিত অটোরিকশার আরোহী ২ বছরের এক শিশু নিহত হয়।
সরেজমিনে দেখা যায়, সড়কের বিভিন্ন জায়গায় রয়েছে ট্রাক, টমটম ও সিএনজিচালিত অটোরিকশার অবৈধ স্ট্যান্ড। ফলে সড়কটি সরু হয়ে গেছে। আর এই সড়কের বেশির ভাগ জায়গায় অবৈধভাবে গাড়ি পার্ক করা হয়। সড়কের ধোপাগুল, থানা বাজার, টুকের বাজার এবং পাড়োয়া এলাকায় অবৈধ গাড়ি পার্কিংয়ের কারণে রাস্তা দিয়ে মাত্র একটি গাড়ি চলাচল করতে পারে।
মহাসড়কে টমটম-ইজিবাইক চলার কথা না থাকলেও চলছে বেপরোয়াভাবে। কোম্পানীগঞ্জের থানাবাজার থেকে ভোলাগঞ্জ পর্যন্ত রয়েছে এই টমটম-ইজিবাইকের দৌরাত্ম্য। এসব যানবাহন ডান-বাম না দেখে মুহূর্তে সড়কে উঠে পড়ছে; আবার হঠাৎ গাড়ি ঘুরিয়ে ফেলছে। এসব বাহনের বেশির ভাগ চালক শিশু-কিশোর। যাদের নেই কোনো প্রশিক্ষণ কিংবা ড্রাইভিং লাইসেন্স। অনেক গাড়িরও নিবন্ধন নেই।
এত গুরুত্বপূর্ণ একটি মহাসড়কের কোথাও নেই স্পিড ব্রেকার। তাই চালকেরা নিজেদের ইচ্ছেমতো বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালাচ্ছে। এ ছাড়া মহাসড়কের কোথাও কোনো সড়কবাতি নেই। ফলে রাত নামলে সড়ক অন্ধকারে ডুবে যায়।
তা ছাড়া হাইওয়ে পুলিশের কোনো কার্যক্রম নেই এই সড়কে। কার্যক্রম শুরুর দাবি জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। আর সড়কের যত্রতত্র রাখা গাড়ি সরাতে থানা-পুলিশকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
উপজেলা প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার পাচ্ছে না এলাকাবাসী। এ বিষয়ে জানতে ফোন করা হলে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আজিজুন্নাহার তাঁর অফিসে গিয়ে বক্তব্য নিতে বলে ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। পরে আর ফোন ধরেননি।
১৬ ফেব্রুয়ারি উপজেলার গণঅধিকার পরিষদের পক্ষ থেকে সড়কে অবৈধ পার্কিং উচ্ছেদ এবং নিরাপদ সড়কের দাবিতে মানববন্ধন করা হয়েছে। এর আগেও বিভিন্ন সংগঠনের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন।
এই সড়ক দিয়ে চলাচল করা স্থানীয় বাসিন্দা কবির আহমদ বলেন, ‘আমরা বাড়ি থেকে বের হলে অনেকটা আশঙ্কা নিয়ে বের হই যে সড়কে কখন না জানি কী হয়। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এই সড়কে নজর দিলে দুর্ঘটনার হার কমিয়ে আনা সম্ভব।’
নিসচা জানায়, এই সড়কে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও মনিটরিংয়ের (তদারকি) অভাব, চালকদের মধ্যে প্রতিযোগিতা ও বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালানোর প্রবণতা, ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করে ওভারটেকিং, লাইসেন্সবিহীন চালক নিয়োগ, পথচারীদের মধ্যে সচেতনতার অভাব, সিট বেল্ট ব্যবহার না করা, বিরতি ছাড়া দীর্ঘ সময় ধরে গাড়ি চালানো, চালকের মাদকের আসক্তি, মোটরসাইকেল ও তিন চাকার গাড়ি বেড়ে যাওয়া, মোটরসাইকেলচালকদের মানসম্মত হেলমেট ব্যবহার না করা, রোড মার্কিং পর্যাপ্ত না থাকা, রাস্তার পাশে হাটবাজার ও দোকানপাট বসানো দুর্ঘটনার কারণ। এ সড়কে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে ট্রাক ও মোটরসাইকেলের মধ্যে। কোটি কোটি টাকা খরচ করে সড়ক করলেও কোনো লেন দেওয়া হয়নি। বিভিন্ন পাম্প থেকে গাড়ি সড়কে ওঠারও কোনো আলাদা লেন নেই। তাই এ রকম স্থানে বেশ কয়েকটি দুর্ঘটনা ঘটেছে। পার্কিং লেন আলাদা করতে হবে, আর এতে রিফ্লেক্টিং আলোর ব্যবস্থা করতে হবে।
সড়কের নিরাপত্তায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সিলেটের সাংবাদিক মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম জানান, এই সড়কের নানা অব্যবস্থাপনার সমাধান না করলে দুর্ঘটনা রোধ করা অসম্ভব। এসব ব্যাপারে চালক ও সাধারণ মানুষকে সচেতন করাসহ আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে।
হাইওয়ে পুলিশের সিলেট রিজিয়নের পুলিশ সুপার অতিরিক্ত ডিআইজি খায়রুল আলম বলেন, ‘বাংলাদেশে সড়ক ব্যবস্থাটাই ঠিক নয়। মহাসড়কে তিন চাকার গাড়ি যেখানে ওঠারই কথা নয়, সেখানে সব ধরনের গাড়ি চলছে। এখন অন্যান্য গাড়ি বা মানুষের চলাচলের জন্য আলাদা কোনো রাস্তাও নেই। যার কারণে সবাই মহাসড়ক ব্যবহার করছে; আর এতে করে নানা সময়ে ঘটছে দুর্ঘটনা। এ জন্য আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে। হাইওয়ে পুলিশের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। তবে আমাদের লোকবল কম থাকায় সব জায়গায় পাঠাতে পারি না।’