
চট্টগ্রাম অঞ্চলের বন সংরক্ষক (সিএফ) মোল্যা রেজাউল করিম এক মূর্তিমান আতঙ্কের নাম। তার বিরুদ্ধে পাওয়া গেছে নানা ধরনের দুর্নীতির দলিল। অভিযোগ রয়েছে, ২০১৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে বন অধিদফতর মোল্যা রেজাউল করিমের দুর্নীতি চিহ্নিত করে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে একের পর এক চিঠি দিলেও কোনও ব্যবস্থা নেয়নি পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ে। ২০১৯ সালে দুদকে করা অভিযোগের সুরাহা করেনি দুদক কর্তৃপক্ষ। যদিও তিনি বলেছেন, তার বিরুদ্ধে আনীত সব অভিযোগই ভিত্তিহীন।
জানা গেছে, সেই সময় সরকার সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে ভালো সম্পর্কের কারণে মোল্যা রেজাউলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। গত বছরের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরে তিনি এখন বিএনপির অনুসারী সেজেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর সুবিধাবাদী মোল্যা নিজেকে সংস্কারপন্থি দাবি করে বন অধিদফতরে আন্দোলনের হুমকি দেন। এই সুযোগে বাগিয়ে নেন চট্টগ্রাম অঞ্চলের বন সংরক্ষকের পদটিও। ২০০৩ সালে বন বিভাগে নিয়োগ পাওয়া মোল্যা রেজাউল করিম শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সেপ্টেম্বরে চট্টগ্রাম অঞ্চলের সিএফ পদে পদায়ন পান।
মোল্যা রেজাউল করিমের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের চিঠি
জানা গেছে, মোল্যা রেজাউল করিমের দুর্নীতির খবর দীর্ঘদিন ধরে বন অধিদফতরে আলোচনার খোরাক যোগাচ্ছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি বন বিভাগকে দুর্নীতির ডেরায় পরিণত করেছেন। গত সরকারের আমলে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো আর অধস্তনদের চোখ রাঙানো ছিল তার নিয়মিত কাজ। সরকারি চাকরিতে যোগদানের পর থেকেই অধস্তনদের কোণঠাসা করতে স্টিম রোলার চালকের আসনে তিনি। গত সরকারের বন উপমন্ত্রী হাবিবুন নাহারকে মা ডেকে গড়ে তুলেছেন অর্থ-সম্পদের পাহাড়। বিশ্বস্ত অধস্তনদের নিয়ে গড়ে তুলেছেন বিশাল সম্রাজ্যে। চট্টগ্রাম অঞ্চলের বন সংরক্ষক (সিএফ) মোল্যা রেজাউল করিম শুধু চট্টগ্রাম নয়, খোদ বন অধিদফতরের জন্যই এক আতঙ্ক।
প্রতিবেদকের হাতে আসা নথি বলছে, বিগত ২০১৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত তৎকালীন বন অধিদফতরের প্রধান বন সংরক্ষক (সিসিএফ) মো. ইউনুছ আলী মোল্যা রেজাউল করিমের দুর্নীতি চিহ্নিত করে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে একের পর এক চিঠি দেন পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ে। তবে আওয়ামী লীগ সরকারের দোসর হওয়ায় মোল্যা রেজাউলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। উল্টো তাকে ফেনী জেলা বিভাগীয় বন কর্মকর্তা পদ থেকে পাল্পউড বাগান বিভাগ বন্দরবানে বিভাগীয় বন কর্মকর্তা পদে প্রাইজ পোস্টিং দেয় পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়।
মোল্যা রেজাউল করিমের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের চিঠি
২০১৬ সালের ২৬ এপ্রিল তৎকালীন প্রধান বন সংরক্ষক মো. ইউনুছ আলী পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো চিঠিতে উল্লেখ করেন, 'মোল্যা রেজাউল ফেনীর বিভাগীয় বন কর্মকর্তা থাকা অবস্থায় ২০১০-২০১১ ও ২০১১-২০১২ আর্থিক সালে বাগান উত্তোলনে ২ কোটি ৩১ লাখ ২৯ হাজার ৬৮০ টাকা ব্যয় করেন। তবে বাগানটি ব্যর্থ হওয়ায় সরকারি বরাদ্দের ওই পরিমাণ টাকা অর্থিক ক্ষতি হয়।’ মোল্যা রেজাউল করিমের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৩ ও ৭ মে ২০১৫ সালে দুইবার চিঠি দেওয়া করা হলেও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কোনও ব্যবস্থা নেয়নি বলেও প্রধান বন সংরক্ষকের চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।
নথি পর্যালোচনা করে আরও জানা যায়, মোল্যা রেজাউল করিম ঢাকার মিরপুর জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানের পরিচালকের দায়িত্ব পালনকালে ২০১৭-২০১৮ ও ২০১৮-২০১৯ আর্থিক সালে সিভিল অডিট অধিদফতর অডিটকালে ১২টি সাধারণ অডিট আপত্তি উত্থাপিত হয়। জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান ও টিকাটুলি বলধা গার্ডেনের পরিচালক থাকাকালীন সময় তার বিরুদ্ধে সর্বমোট ২০ কোটি টাকা উন্নয়ন কাজের বরাদ্দের সীমাহীন দুর্নীতির অভিযোগ উঠে। গভীর নলকূপ স্থাপনে ৩০ লাখ টাকা খরচ হলেও দেখানো হয় সাড়ে ৭০ লাখের বেশি। পতিত পুকুর খননের নামে বিপুল অঙ্কের টাকা আত্মসাৎসহ ভুয়া প্যাড কাগজ এবং বিল ভাউচারের মাধ্যমে বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে।
মোল্যা রেজাউল করিমের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের চিঠি
এদিকে বন অধিদফতর সুত্রে জানা গেছে, বন অধিদফতরে কর্মরত ২০ জন ফরেস্টার ২০১৯ সালে মোল্যা রেজাউল করিমের দুর্নীতি তদন্ত এবং তার স্বৈরাচারী আচরণ থেকে মুক্তি পেতে দুর্নীতি দমন কমিশন, বন সচিব এবং প্রধান বন সংরক্ষকের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন।
অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, চাকরি জীবনের শুরুতে রাঙ্গামাটি দক্ষিণ বন বিভাগের কাপ্তাই রেঞ্জ কর্মকর্তা পদে প্রশিক্ষণকালেই মোল্যা রেজাউল ঘুষ লেনদেনে জড়িয়ে পড়েন। কাপ্তাই রেঞ্জে সেগুন বাগান বিক্রি করে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেন। পরবর্তীতে তৎকালীন সহকারী বন সংরক্ষক শাহাবুদ্দিন মোল্যা রেজাউলের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেও বন বিধ্বংসী কার্যক্রম থামাতে পারেননি। ফেনী ডিভিশনের দায়িত্বে থাকাকালীন তিনি বাগান সৃজন ও ইকোপার্ক প্রকল্পের টাকা আত্মসাৎ করেন। তদন্তে প্রমাণ পেয়ে তৎকালীন প্রধান বন সংরক্ষক ইউনুছ আলী মোল্যা রেজাউলের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে বন মন্ত্রণালয়ে লিখিত প্রস্তাব পাঠান। যদিও তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের সহযোগিতায় প্রস্তাবের সেই ফাইল মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে ধামাচাপা পড়ে যায় বলে অভিযোগ উঠেছে। মোল্যা রেজাউল বাগেরহাট ডিভিশনের দায়িত্বে (ডিএফও) থাকাকালীন তৎকালীন সরকারের আমলে পিরোজপুরে ইকোপার্ক নির্মাণ প্রকল্পের বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
গত সরকারের সময় মোল্যা রেজাউল করিমের ফেসবুক পোস্ট
এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুদকের পরিচালক (জনসংযোগ) আকতার উল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কারও বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেলে তা স্বাভাবিক নিয়মেই তদন্ত হবে। এখানে ব্যত্যয় ঘটার কোনও সুযোগ নাই। বন অধিদফতরের কর্মকর্তা মোল্ল্যা রেজাউলের বিরুদ্ধে আনীত অফিযোগও তদন্ত হবে, এবং তদন্ত শেষে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এ ব্যাপারে সাবেক এক প্রধান বন সংরক্ষক (সিসিএফ) জানান, মোল্যা রেজাউলের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগগুলো তদন্ত হয়েছিল। তদন্তে দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পেয়ে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে বন মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়। তবে সেই প্রস্তাব আর আলোর মুখ দেখেনি।
৫ আগস্টের পর মোল্যা রেজাউল করিমের ফেসবুক পোস্ট
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে প্রধান বন সংরক্ষক আমীর হোসাইন চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কারও বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়। আমি বিষয়টি খতিয়ে দেখছি।’
তবে অভিযোগের বিষয়ে মোল্যা রেজাউল করিম জানান, তার বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ মিথ্যা। যোগদানের মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে তিনি সব দুর্নীতি করে ফেলেছেন বিষয়টি এতো সহজ নয়।