এ হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব নাসিমুল গণি বলেছেন, ঝিনাইদহ শৈলকুপায় এই তিন জন খুুনের ঘটনায় নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন চরমপন্থি দল জড়িত কি না সেটা তদন্ত চলছে। যারাই এই ঘটনা ঘটিয়েছে অচিরেই রহস্য বের করা হবে। উল্লেখ্য, গত শুক্রবার রাতে ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার রমাচন্দ্রপুর গ্রামের শ্মশানঘাট এলাকায় তিন জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। নিহতরা হলেন, হানিফ আলী (৫৬), তার শ্যালক লিটন (৩৫) ও রাইসুল ইসলাম রাজু (২৫)। এদের মধ্যে হানেফ আলী নিষিদ্ধ চরমপন্থি সংগঠন পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির (জনযুদ্ধ) আঞ্চলিক কমান্ডার। নিহত চরমপন্থি নেতা হানিফের বিরুদ্ধে কমপক্ষে ১৩টি হত্যাসহ বিভিন্ন মামলা রয়েছে।
তিন খুনের ব্যাপারে স্থানীয়রা জানান, শুক্রবার ঘটনাস্থলের কাছে রাত ৯টার দিকে তিন থেকে চারটি গুলির শব্দ শুনতে পান এলাকাবাসী। এরপর ভয়ে আর কেউ ঘর থেকে বের হয়নি। পুরো এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এরপর এলাকাবাসী পুলিশকে খবর দিলে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে তিনটি মরদেহ ও দুইটি মোটরসাইকেল পড়ে থাকতে দেখেন। তিন জনকেই মাথায় গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। জাসদ গণবাহিনীর শীর্ষ নেতা কালুর নেতৃত্বে এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে বলে ধারণা করছেন পুলিশ ও স্থানীয়রা। কালুর বাড়ি কুষ্টিয়া সদর উপজেলার পশ্চিম আব্দালপুর গ্রামে। জাসদ গণবাহিনীর কথিত নেতা কালু একটি চিরকুট লিখে এই তিন হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছেন।
ঝিনাইদহের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইমরান জাকারিয়া জানান, শুক্রবার রাতে প্রতিপক্ষ বন্দুকধারীরা দুই সহযোগীসহ পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টির সামরিক কমান্ডার হানিফকে গুলি করে হত্যা করে। খবর পেয়ে রাত সাড়ে ১২টার দিকে শৈলকুপা উপজেলার ত্রিবেনী ইউনিয়নের রামচন্দ্রপুর শ্মশানঘাট এলাকার একটি ক্যানালের পাশ থেকে নিহতদের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। তিন জনের মাথায় গুলির চিহ্ন রয়েছে। পাশে দুইট মোটরসাইকেল ও নিহতদের ব্যবহূত হেলমেট পড়ে ছিল।
তিনি আরো বলেন, হত্যার দায় স্বীকার করে সাংবাদিকদের হোয়াস্টসআপে যে খুদে বার্তা এসেছে তা গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। তিন জনকে কীভাবে ঘটনাস্থলে আনা হলো তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। পুলিশ হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেফতারের চেষ্টা চালাচ্ছে।
খুদে বার্তায় ‘দায় স্বীকার’
তিন জনকে হত্যার দায় স্বীকার করে জাসদ গণবাহিনীর কালু পরিচয় দিয়ে ঝিনাইদহের স্থানীয় সাংবাদিকদের কাছে শুক্রবার রাতে যে মেসেজ পাঠানো হয়েছে সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘এতদ্দ্বারা ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, মাগুরা, কুষ্টিয়া, যশোর ও খুলনাবাসীর উদ্দেশে জানানো যাইতেছে যে, পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টি নামধারী কুখ্যাত ডাকাত বাহিনীর শীর্ষ নেতা অসংখ্য খুন, গুম, দখলদারি, ডাকাতি, ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্ত হরিণ্ডাকুণ্ডুু নিবাসী মো. হানিফ তার দুই সহযোগীসহ জাসদ গণবাহিনীর সদস্যদের হাতে নিহত হয়েছেন। তাদের লাশ রামচন্দ্রপুর ও পিয়ারপুর ক্যানালের পাশে রাখা আছে। অত্র অঞ্চলের হানিফের সহযোগীদের শুধরে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হলো, অন্যথায় আপনাদের একই পরিণতির মুখোমুখি হতে হবে। কালু জাসদ গণবাহিনী।’ তবে খুদে বার্তাটির প্রেরক সত্যিকারের কালু কি না তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। পুলিশের পক্ষ থেকে বিষয়টি নিয়ে তদন্ত হচ্ছে বলেও জানানো হয়েছে।
কে এই হানিফ আলী?
প্রায় ৫৫ বছর বয়সি হানিফ আলী, তার বাড়ি ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডু উপজেলার আহাদনগর গ্রামে, পিতার নাম রাহাজ উদ্দিন। হানিফ আলী পশ্চিমাঞ্চলের শীর্ষ চরমপন্থি সংগঠন পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টি জনযুদ্ধ (লাল পতাকার) আঞ্চলিক কমান্ডার। ৯০-এর দশকে হত্যা ও ডাকাতির মাধ্যমে এলাকায় অপরাধজগতে একক আধিপত্য বিস্তার করে। হানিফের নামে হরিণাকুণ্ডু, ঝিনাইদহ সদর, চুয়াডাঙ্গা, আলমডাঙ্গাসহ দেশের বিভিন্ন থানায় ১৪টি হত্যা, অপহরণ ও ডাকাতির মামলা আছে। গত সাত-আট বছর ধরে হরিণাকুণ্ডু নারায়ণকান্দি কায়েতপাড়া বাঁওড় দখল করে মত্স্য চাষ করে আসছিল। ২০১৪ সালে জেল থেকে বের হয় হানিফ। পরে ২০১৮ সালে ঐ বাঁওড়ের মত্স্যজীবী সমিতির সভাপতি জিয়াউর রহমান জিয়াকে জবাই করে হত্যা করে বাঁওড়ের দখল নেয় হানিফ। সম্প্রতি বাঁওড় দখলকে কেন্দ্র করে এলাকার কয়েকটি নিষিদ্ধ চরমপন্থি সংগঠনের মধ্যে বিরোধ চলে আসছিল। এ কারণেই প্রতিপক্ষ জাসদ গণবাহিনী তাকে হত্যা করেছে বলে ধারণা এলাকাবাসীর।
চরমপন্থি হানিফের এক ভাই হরিণাকুণ্ডু উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও আরেক ভাই উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও উপজেলা সেচ্ছাসেবক লীগের বর্তমান সহসভাপতি। হানিফ নিজে হরিণাকুণ্ডু উপজেলা মত্স্যজীবী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি ছিলেন ।
এই গ্রামে আগেও ঘটেছিল হত্যাকাণ্ড
স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, একই স্থানে ২০০৩ সালের ৫ ডিসেম্বর পাঁচ জনকে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। তারা হলেন, শৈলকূপা উপজেলার শেখপাড়া গ্রামের শহীদ খা, ত্রিবেনী গ্রামের শাহনেওয়াজ, একই গ্রামের ফারুক, নুরু কানা ও কুষ্টিয়ার ভবানীপুর গ্রামের কটাকে গুলি ও জবাই করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা।
এই মামলায় ২০২৪ সালের ২৯ অক্টোবর ঝিনাইদহ জেলা জজ আদালতে কুষ্টিয়ার আলী রেজা ওরফে কালু ও জেলার পিয়ারপুর গ্রামের মহসিন আলীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। এই অঞ্চলে এক সময় ‘শ্রেণিশত্রু খতম’ করার নামে চরমপন্থি পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি জনযুদ্ধ, লাল পতাকা, জাসদ, এমএল, কমিউনিস্ট পার্টির হক গ্রুপ ভিন্ন ভিন্ন গ্রুপে ভাগ হয়ে একে অন্যকে হত্যা করত। ঐ হত্যার পর দায় স্বীকার করে বিবৃতি দিয়েছিলেন চরমপন্থিরা।
হত্যাকাণ্ডে চরমপন্থি দল জড়িত কিনা সেটা তদন্ত চলছে : স্বরাষ্ট্র সচিব
ঝিনাইদহ শৈলকুপায় ত্রিপল মার্ডারে নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন চরমপন্থি দল জড়িত কিনা সেটা তদন্ত চলছে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব নাসিমুল গণি। শনিবার দুপুরে যশোর পিটিআই মিলনায়তনে দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মানবাধিকার ও পরিবেশের ওপর গুরুত্বসহ আইন প্রয়োগ বিষয়ক কর্মশালা অনুিষ্ঠিত হয়। কর্মশালা শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ মন্তব্য করেন।
সিনিয়র সচিব নাসিমুল গণি বলেন, ‘ঝিনাইদহের বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে। যারাই এই ঘটনা ঘটিয়েছে অচিরেই রহস্য বের করা হবে। তিনি বলেন, দেশে আইনশৃঙ্খলার যে অবস্থা ছিল, সেটা অনেক উন্নতি ঘটেছে। আরো উন্নতি ঘটাতে আমাদের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। আমরা পুলিশের বিধ্বস্ত বাহিনী পেয়েছিলাম। তারা আস্তে আস্তে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে। কোমর তুলে দাঁড়াচ্ছে। তাদের সঙ্গে কথা বলে তাদের মনের ভাব বুঝছি, তাদের উন্নয়ন ঘটানোর সকল উদ্যোগ নিচ্ছি। পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেট একত্রে আমরা দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটাতে কাজ করছি। দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করতে একটি গোষ্ঠী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপতথ্য ছড়াচ্ছে বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, তিলকে তাল করে একটি গোষ্ঠী কল্পনার ফানুস উড়াচ্ছে। পুরোনো কোনো ঘটনার ছবি বা ভিডিও নতুন করে পোস্ট করে অস্থিতিশীল সৃষ্টি করছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।