Image description

বাদী নেই-আসামি আছে। মামলার কোনো অস্তিত্ব নেই-অথচ গ্রেফতারি পরওয়ানা আছে। থানায় সাধারণ ডায়েরি পর্যন্ত নেই- কিন্তু জেলের ঘানি টানতে হচ্ছে মাসের পর মাস। এমন অদ্ভুত আইন ও বিচার ব্যবস্থাপনার গ্যাঁড়াকলে পড়ে হাজারও নিরীহ নিরপরাধ মানুষ আছেন দৌড়ের ওপর। একের পর এক মামলা দেখিয়ে ‘প্রডাকশন ওয়ারেন্ট’র আওতায় নেয়া হচ্ছে এক কারাগার থেকে অন্য কারাগার। এক আদালত থেকে অন্য আদালতে। এমন দৃষ্টান্ত ভূরি ভূরি।

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রোগ্রাম অফিসার মো.আওলাদ হোসেনকে ৬৮দিন পর মুক্তি পেতে হয়েছিলো হাইকোর্টের নির্দেশে। ঢাকার ফ্রি-ল্যান্স ফটো সাংবাদিক জনি চৌধুরীকে ৬টি ভুয়া ওয়ারেন্টে কারাভোগ করতে হয় দেড় মাস। জালিয়াতচক্রের হোতা মামা শরীফুল ইসলামের ষড়যন্ত্রে জনি মিথ্যা মামলার ঘানি টানছে এখনো। খুলনার কয়রা উপজেলার অবিবাহিত অ্যাডভোকেট মফিজুল ইসলাম ফারাবীকে ‘বিবাহিত’ সাজিয়ে ভাড়াটে একজন নারীকে দিয়ে নারী মামলা করা হয় একের পর এক। ভুয়া মামলায় হাজতবাস করতে হয়েছে।

রাজধানীসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ভুয়া মামলা এবং ভুয়া ওয়ারেন্টে পালিয়ে বেড়াচ্ছে শত সহস্র নারী-পুরুষ। ব্যক্তিগত আক্রোশ, শত্রুপক্ষকে হয়রানি, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমন, সম্পত্তি থেকে ওয়ারিশদের বঞ্চিত করাসহ নানা কারণে দায়ের হচ্ছে ভুয়া মামলা। জনস্বার্থ, আদালত অবমাননা, মানহানি, রাষ্ট্রদ্রাহিতা, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত- ইত্যাদি অভিযোগে বিগত দেড় দশকে দায়ের করা হয়েছে বহু মামলা। কথিত এসব মামলা এবং ওয়ারেন্টের মামলার বাদী অনেক ক্ষেত্রেই ভাড়াটে পুরুষ কখনও বা নারী। আসামি চেনেন না বাদীকে। বাদী চেনেন না আসামিকে। এসব গায়েবি মামলাবাজ সিন্ডিকেটের নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে গত ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা প্রায়ই জড়ো হচ্ছেন সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে। বানোয়াট মামলা ও ভুয়া ওয়ারেন্টের ভুক্তভোগীরা এ বিষয়ে প্রধান বিচারপতি এবং আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ কামনা করেন। ভুয়া মামলার প্রতিবাদে মানববন্ধন করতে চাইলে আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী তাতে বিঘœ সৃষ্টি করেন। জড়ো হওয়া এক নারী জানান, তার বাবা এবং উপার্জনক্ষম একমাত্র ভাই ৫টি ভুয়া মামলায় কারাগারে আছেন। ঢাকার শান্তিবাগের একরামুল আহসান কাঞ্চনের বিরুদ্ধে দেয়া হয়েছিলো ৪৯টি মামলা। ঢাকার সিএমএম কোর্টে ১৩টি, ঢাকার বিভিন্ন থানায় ১৫টি। নারায়ণগঞ্জে মামলা রয়েছে ৮টি। পরিবারগুলো দাবি করেন- সবগুলো মামলাই ভুয়া। কি কারণে কেন এসব মামলা দায়ের করা হচ্ছে তারা তা জানেন না।

চট্টগ্রাম লোহাগাড়া আধুনগর নিবাসী মরহুম সিদ্দিক আহমদের দারিদ্র্য পীড়িত, নিরপরাধ পুত্রদের বিরুদ্ধে একের পর এক দায়ের করা হয় মিথ্যা মামলা। তার পুত্র দেলোয়ার হোসেন, হেলালউদ্দিন, হারুন অর রশিদ এবং আনোয়ার হোসাইনের বিরুদ্ধে একের পর এক মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকার আমলে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হতো ‘জামায়াত-শিবির’ তকমা দিয়ে। অন্তর্বর্তী সরকারের সময় তাদের বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হচ্ছে ‘ছাত্রলীগ-আওয়ামীলীগ’ তকমা দিয়ে। ‘নোমান গ্রুপ’ নামক একটি ব্যাংক লুটেরা প্রতিষ্ঠান তাদের বিরুদ্ধে নামে-বেনামে এসব মামলা দেয়া হচ্ছে। চট্টগ্রামে ‘বোমাবাজি’ এবং ঢাকার সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনালের মামলায় দীর্ঘ দিন ধরে কারাভোগ করছেন সিদ্দিক আহমদের পুত্র হারুন অর রশিদ। এসব মিথ্যা মামলার জাল ছিন্ন করে কবে তিনি কারামুক্ত হতে পারবেন- কেউ জানে না। আ’লীগ আমলে গ্রেফতার হয়ে দীর্ঘ কারাভোগ করছেন। এখন অন্তর্বর্তী সরকার আমলে গ্রেফতার হয়েও তিনি ভোগ করছেন কারা। আ’লীগ আমলে দেখা যেতো, রাজনৈতিক গায়েবি ও ভুয়া মামলার আসামিদের হাজিরার দিন প্রায়ই জনাকীর্ণ হয়ে উঠতো আদলত। আদালত প্রাঙ্গণে এখনো কমেনি ভিড়।

২০১৮ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর একটি রিট হয়েছিলো এ বিষয়ে। রিটে উল্লেখ করা হয়, ২০১৮ সালের ১ থেকে ২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন থানায় ৩ হাজার ৭৩৬টি গায়েবি কিংবা ভুয়া মামলা দায়ের হয়। এসব মামলায় আসামি করা হয় ৩ লাখ ১৩ হাজার ১৩০ জনকে ৷আর অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয় কয়েক হাজার। রিটে এসব ‘গায়েবি’ এবং ভুয়া মামলার বিষয়ে তদন্ত চাওয়া হয়। রিটে আরও উল্লেখ করা হয়, ১০ বছর আগে ইন্তেকাল করা ব্যক্তিকেও ভুয়া মামলার আসামি করা হয়েছে। শুনানিকালে কয়েকটি মামলার এজাহার পর্যবেক্ষণ করে আদালত বলেছিলেন, এ ধরনের মামলায় (গায়েবি) পুলিশের ভাবমর্যাদা ও বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হয়। বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী এবং বিচারপতি মো.আশরাফুল কামালের তৎকালীন ডিভিশন বেঞ্চ ওই রিটের বিভক্ত আদেশ দেন। পরে অবশ্য তৃতীয় বেঞ্চ রিটটি খারিজ করে দেন। গায়েবি কিংবা ভুয়া মামলার বিষয়ে আদালত কোনো রকম নির্দেশনা না দিয়ে এভাবেই হাসিনার ফ্যাসিস্ট সরকারের স্থায়িত্ব বাড়ায় তৎকালীন অনুগত সুপ্রিমকোর্ট।
ব্যাংকের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে নিরপরাধ পাটকল শ্রমিক জাহালমের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) দাখিল করেছিলো ৩৬টি ভুয়া চার্জশিট। এ ঘটনায় একটি ব্যাংককে অর্থদ- করা হলেও চার্জশিট অনুমোদনকারী কমিশনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের অদ্যাবধি জবাবদিহিতার আওতায় আনেনি বর্তমান কমিশন।

পুলিশ সদর দপ্তরের এক পরিসংখ্যানে উল্লেখ করা হয়, ২০১৭ সালে নারী নির্যাতনের মামলা হয়েছে ১৫ হাজার ২১৯টি, ২০১৬ সালে ১৬ হাজার ৭৩০টি, ২০১৫ সালে ১৯ হাজার ৪৮৬টি, ২০১৪ সালে ১৯ হাজার ৬১৩টি, ২০১৩ সালে ১৮ হাজার ৯১টি, ২০১২ সালে ১৯ হাজার ২৯৫টি এবং ২০১১ সালে ১৯ হাজার ৬৮৩টি। কিন্তু পুলিশি তদন্তে মামলাগুলোর ৯০ শতাংশই ভুয়া প্রমাণিত হয়।

মিথ্যা এবং উদ্দেশ্যমূলক মামলা প্রসঙ্গে আইনজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, ফৌজদারি কার্যবিধিতে আগে মামলা রুজুর আগে প্রাথমিক যাচাই-বাছাইয়ের একটি বিধান ছিল। এটি বাতিল করে দেয়া হয়েছে। এর ফল ভালো হয়নি।
হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পীস ফর বাংলাদেশের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, দ-বিধির ২১১ ধারা অনুযায়ী মিথ্যা মামলা করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কেউ যদি তার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা আদালতে মিথ্যা প্রমাণ করতে পারেন, তাহলে বাদীর বিরুদ্ধেও একই ধারায় পাল্টা মামলা করা যায়। ফৌজদারি কার্যবিধি ২৫০ ধারা অনুযায়ী মিথ্যা মামলায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণের আদেশ দিতে পারেন আদালত। কোনো পুলিশ কর্মকর্তা আমলযোগ্য নয়, এ রকম কোনো মামলায় মিথ্যা প্রতিবেদন দাখিল করলে তার বিরুদ্ধেও এ ধারা অনুযায়ী ভিকটিমের পক্ষে আদালত ক্ষতিপূরণের রায় দিতে পারেন।

ঢাকা বারের ফৌজদারি মামলায় অভিজ্ঞ অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমানের মতে, সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদের যথেচ্ছ ব্যবহারে ‘উদ্দেশ্যমূলক’ ও ‘ভুয়া মামলা’র হার বাড়িয়েছে। অপ্রয়োজনীয় মামলার কারণে আটকে থাকছে গুরুত্বপূর্ণ বহু মামলার শুনানি। অপ্রয়োজনীয় মামলার শুনানি গ্রহণে দিনের পর দিন ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে আদালতকে। বিচারপ্রার্থীর দুর্ভোগ বাড়ছে। অর্থ ব্যয় হচ্ছে। উদ্দেশ্যমূলক, মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা মানুষের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনেও বিপর্যয় নামিয়ে আনছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য জনকভাবে এ প্রবণতায় জড়িয়ে পড়ছে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এটি বন্ধ হওয়া প্রয়োজন।

এদিকে ভুয়া গ্রেফতারি পরওয়ানা ঠেকাতে উচ্চ আদালত সাত নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু মনিটরিং না থাকায় সুফল মিলছে না এসব নির্দেশনার। হাইকোর্টের দেয়া নির্দেশনাগুলোর মধ্যে ছিলো, (১) গ্রেফতারি পরওয়ানা ইস্যুর সময় গ্রেফতারি পরওয়ানা প্রস্তুতকারী ব্যক্তিকে ফৌজদারী কার্যবিধির ধারা ৭৫ এর বিধানমতে নির্ধারিত ফরমে উল্লেখিত চাহিদা অনুযায়ী সঠিক ও সুস্পষ্টভাবে তথ্যপূরণ করতে হবে। যেমন- (ক) যে ব্যক্তি বা যেসব ব্যক্তি পরওয়ানা কার্যকর করবেন, তার বা তাদের নাম এবং পদবি ও ঠিকানা সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে। (খ) যার প্রতি পরওয়ানা ইস্যু করা হচ্ছে অর্থাৎ অভিযুক্তের নাম ও ঠিকানা এজাহার নালিশি মামলা কিংবা অভিযোগপত্রে বর্ণিত সংশ্লিষ্ট মামলার নম্বর ও ধারা এবং ক্ষেত্রমতে আদালতের মামলার নম্বর এবং ধারা সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে। (গ) সংশ্লিষ্ট জজ (বিচারক)/ম্যাজিস্ট্রেটের স্বাক্ষরের নিচে নাম ও পদবির সিল এবং ক্ষেত্রমতে দায়িত্বপ্রাপ্ত বিচারকের নাম ও পদবির সীলসহ বামপাশে বর্ণিত সংশ্লিষ্ট আদালতের সুস্পষ্ট সীল ব্যবহার করতে হবে। (ঘ) গ্রেফতারি পরওয়ানা প্রস্তুতকারী ব্যক্তির (অফিস স্টাফ) নাম, পদবি ও মোবাইল ফোন নম্বরসহ সিল ও তার সংক্ষিপ্ত স্বাক্ষর ব্যবহার করতে হবে, যাতে পরওয়ানা কার্যকরকারী ব্যক্তি পরওয়ানা সঠিকতা সম্পর্কে কোনো সন্দেহের উদ্বেগ হলে পরওয়ানা প্রস্তুতকারীর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করে সঠিকতা নিশ্চিত হওয়া যায়। (২) গ্রেফতারি পরওয়ানা প্রস্তুত করা হলে স্থানীয় অধিক্ষেত্র কার্যকর করার জন্য সংশ্লিষ্ট পিয়ন বইতে এন্ট্রি করে বার্তা বাহকের মাধ্যমে তা পুলিশ সুপারের কার্যালয় কিংবা সংশ্লিষ্ট থানায় প্রেরণ করতে হবে। এবং পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের/থানার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা কর্তৃক ওই পিয়ন বইতে স্বাক্ষর করে তা বুঝে নিতে হবে। গ্রেফতারি পরওয়ানা প্রেরণ ও কার্যকর করার জন্য পর্যায়ক্রমে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার কাজে লাগানো যেতে পারে। (৩) স্থানীয় অধিক্ষেত্র বাইরের জেলায় গ্রেফতারি পরওয়ানা কার্যকরের ক্ষেত্রে পরওয়ানা ইস্যুকারী কর্তৃপক্ষ গ্রেফতারি পরওয়ানা সিলগালা করে এবং অফিসের সিল ছাপ দিয়ে সংশ্লিষ্ট জেলার পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে প্রেরণ করবেন।

এছাড়া আরও চার দফা নির্দেশনা রয়েছে হাইকোর্টে। তবে এসব নির্দেশনাও এখন আর প্রতিপালিত হচ্ছে না। একাধিক থানা, পুলিশ সুপারের কার্যালয় এবং আদালত সহায়ক কর্মচারীরা জানান, ভুয়া ওয়ারেন্টের হয়রানিটা হয় অসাধুচক্র এবং ওয়ারেন্ট তামিলকারী পুলিশ সদস্য এবং আদালত কর্মচারীদের যোগসাজশে। তাই উদ্দেশ্যমূলক ভুয়া ওয়ারেন্ট নিয়ে তারা কোনো সন্দেহ পোষণ করে না। তারা হয়রানির শিকার ভুয়া আসামির কাছে ওয়ারেন্টের কোনো কপি হস্তান্তর করে না। ফলে হয়রানিও বেড়েছে। তবে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা শতভাগ বাস্তবায়ন হলে ভুয়া ওয়ারেন্টে নিরীহ মানুষকে হয়রানি ক্রমেই বন্ধ হয়ে আসবে বলে মনে করেন আইজ্ঞরা।