
বাংলাদেশের প্রধান উন্নয়ন সহযোগী বন্ধু দেশ চীন। চীনের সাথে বাংলাদেশের বিরাট আমদানি ও রফতানি বাজার। দুই দেশের মধ্যে বার্ষিক প্রায় ৩২ বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা-বাণিজ্য কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ খাত তৈরি পোশাক শিল্পের জন্য ৭০ শতাংশ কাঁচামাল এবং ভারী ও হালকা যন্ত্রপাতি আসে চীন থেকেই। প্রায় দেড়শ’ কোটি জনসংখ্যার দেশ চীনে বাংলাদেশে উৎপাদিত উৎকৃষ্টমানের পণ্যসামগ্রী ও সেবাজাত-পণ্য রফতানি আরো প্রসারের ব্যাপক সুযোগ রয়েছে। কেননা চীন বাংলাদেশের উৎপাদিত ও রফতানিযোগ্য প্রায় সব ধরনের পণ্যসামগ্রীর রফতানিতে শতভাগ শুল্কমুক্ত ঘোষণা দিয়েছে। অথচ এই বিশাল সুযোগ-সম্ভাবনা এখনও প্রায় অধরা।
সম্প্রতি চীন ও চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরের মধ্যে সরাসরি জাহাজ চলাচল সফলভাবে শুরু হয়েছে। সুলভ শ্রমশক্তি ও নানাবিধ সুবিধা থাকায় বাংলাদেশে অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান রি-লোকেট করতে আগ্রহী চীনা উদ্যোক্তারা। বাংলাদেশের পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব দিকের দেশগুলোর সঙ্গে ‘পূর্বমুখী’ সম্পর্কের ক্ষেত্রে চীনের সাথে অধিকতর সম্পর্ক বা বন্ধুত্ব জোরদারের মাঝে রয়েছে বহুমাত্রিক সম্ভাবনা। এই সম্পর্কের সাথে উন্নয়ন, বিনিয়োগ-শিল্পায়ন, শিক্ষা, প্রযুক্তি, সংস্কৃতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, ভূ-কৌশলগত, প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তার প্রভূত গুরুত্ব এবং সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ।
বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যকার অকৃত্রিম বন্ধুত্ব দীর্ঘকালের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। হিউয়েন সাঙ, ফা হিয়েনসহ অগণিত পরিব্রাজক ও বণিক-ব্যবসায়ীর চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজবহর নিয়ে গমনাগমনের মধ্যদিয়ে হাজার বছর আগেই বন্ধুত্বের সেতুবন্ধন রচিত হয় বাংলাদেশ ও চীনা জনগণের মাঝে। চীন বর্তমান বিশ্বের উদীয়মান অর্থনৈতিক পরাশক্তি ও প্রভাবশালী দেশ হিসেবে শুধুই নয়; বরং বাংলাদেশের উন্নয়ন অভিযাত্রায় ধারাবাহিক প্রধান সহযোগী বন্ধু দেশ চীন। বর্তমানে সর্বাধুনিক বিজ্ঞান, প্রকৌশল ও প্রযুক্তিকে জয় করে অতি সুলভ মূল্যে বিশ^ময় ব্যাপক বাজার চাহিদা নিজের আয়ত্তের মাঝে রাখতে সক্ষম হয়েছে চীন। তবে নিজের ‘বড়ত্ব দিয়ে অন্যকে খর্ব না করাই’ মহাপ্রচীরের দেশ চীনের নীতি, ঐতিহ্য ও আদর্শ।
মহাপ্রাচীরের দেশ চীনের সাথে বাংলাদেশের বন্ধুত্ব ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বৃদ্ধির গুরুত্ব প্রসঙ্গে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ প্রফেসর মুহাম্মদ সিকান্দার খান ইনকিলাবকে বলেন, বাংলাদেশকে ‘পূর্বমুখী’ সম্পর্ক বৃদ্ধি করতেই হবে। এটাই স্বাভাবিক। এছাড়া বিকল্প নেই। পূর্বের দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের প্রধান উন্নয়ন সহযোগী এবং বিনিয়োগ, শিল্পায়ন ও ব্যবসা-বাণিজ্যের সহযাত্রী দেশ হচ্ছে চীন। চীনের সাথে বাংলাদেশের যোগাযোগ, বাণিজ্য, বিনিয়োগ, শিল্পায়নের সম্পর্ক উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটি ন্যাচারাল এবং ঐতিহাসিক সম্পর্কের ধারাবাহিকতা।
তিনি বলেন, আমাদের চাহিদার সমানুপাতে বাণিজ্য প্রসার সম্ভব পূর্বমুখী নীতি জোরালো করার মাধ্যমে। ভারত-নির্ভরতা কমিয়ে বাংলাদেশের জন্য এশিয়ার পূর্বদিকের দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে আমরাই লাভবান হবো। তাহলে আমাদের শিল্প-কারখানায় উৎপাদন, অর্থনীতির গতি ত্বরান্বিত হবে। তাছাড়া আসিয়ান-এর মতো শক্তিধর গ্রুপের সঙ্গে বাংলাদেশের বলিষ্ঠ যোগাযোগ বৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টি হবে। অতএব চীনের সাথে আমাদের বন্ধুত্ব ও যোগাযোগের বহুমুখী গুরুত্ব রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি প্রফেসর ড. মইনুল ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন, চীন তার বাজারে প্রবেশাধিকার উন্মুক্ত রেখে বাংলাদেশের উৎপাদিত পণ্যসামগ্রীর ওপর শতভাগ শুল্কমুক্ত ঘোষণা আগেই দিয়েছে। অথচ আমরা এখনও চীনে রফতানির বড়সড় সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারিনি। চীনে বাংলাদেশের পণ্য রফতানি বৃদ্ধির সুযোগ রয়েছে। ‘আসিয়ান’ অগ্রসর দেশগুলোর সাথে সমানতালে প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশকেও এগিয়ে আসতে হবে।
এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ সাবেক চবি অধ্যাপক ড. আবুল কালাম আযাদ ইনকিলাবকে বলেন, ‘পূর্বমুখী’ কূটনীতি, অর্থনীতিতে বিশেষ করে চীনের সাথে বাংলাদেশের ভূ-কৌশলগত, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব, প্রতিরক্ষা, নিরাপত্তা, স্বনির্ভরতাসহ বহুমুখী খাতে গুরুত্ব রয়েছে। সুযোগগুলোকে কাজে লাগানোর জন্য চীনের সাথে বন্ধুত্ব ও সম্পর্ক অধিকতর প্রসারের বিকল্প নেই। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সহযোগিতার ক্ষেত্র হতে পারে প্রচুর।
তিনি বলেন, সড়কপথে ইউনান প্রদেশের রাজধানী কুনমিং সিটির সাথে চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের ঘুনধুম হয়ে দূরত্ব খুবই কম। এই সহজতর যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হলে চীনের সাথে আদান-প্রদানের সম্ভাবনাকে ব্যাপকভাবে উদঘাটন করা সম্ভব হবে। এরফলে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, সেবা খাত, প্রযুক্তি, পর্যটন, নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, কৌশলগত বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশ হবে সুসমৃদ্ধ।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয় রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রফেসর ড. মাহফুজ পারভেজ ইনকিলাবকে বলেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবর্তন চীনকে দক্ষিণ এশিয়ায় তার প্রভাব বিস্তারের এবং ভারতের উচ্চাকাক্সক্ষাকে দমিয়ে দেয়ার একটি সুবর্ণ সুযোগ এনে দিয়েছে। তাছাড়া চীনের কাছে বাংলাদেশ কৌশলগতভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভারত মহাসাগরের পূর্বাংশে বঙ্গোপসাগরের উপকূলে বাংলাদেশের অবস্থান চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই)-এর জন্য কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। তিনি বলেন, বিশ্বব্যাপী অবকাঠামো প্রকল্প এবং বাণিজ্য নেটওয়ার্কগুলোর বাস্তবায়নের মাধ্যমে চীনের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যকার ভারসাম্যপূর্ণ সুসম্পর্ক উভয় দেশের জন্যই লাভজনক হতে পারে।
চীনের সাথে বাংলাদেশের যোগাযোগ ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিকভাবে ‘সহজ’ হলেও বাস্তবে আজও কঠিন। যা বলতে গেলে ‘বাড়ি কাছে, বাড়ির ঘাটা দূরে’ অবস্থা। দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক ইতিহাসের পাতায় আজও সোনালি হরফে লেখা ‘সিল্ক রুট’ (রেশমী পথ)। যা চট্টগ্রামের ওপর দিয়ে গেছে। চট্টগ্রাম থেকে সোজা পূর্বদিকে যেতে থাকলে মাত্র ৬শ’ কিলোমিটার সড়কপথ বা রেলপথ পাড়ি দিয়ে সহজেই পৌঁছা যাবে পূর্বচীনের ইউনান প্রদেশের রাজধানী কুনমিং। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার-ঘুনধুম হয়ে মিয়ানমারের কিছু অংশের উপর দিয়ে চীনের কুনমিং পর্যন্ত মহাসড়ক নির্মিত হলে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন সম্ভব। এতে পরিবহন খরচ অর্ধেক হ্রাস পাবে। চীনের সাথে দ্রুত ও সহজে সড়ক ও রেলপথে যোগাযোগে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মিয়ানমার হয়ে কুনমিং-এর সঙ্গে সংযোগ তৈরির জন্য প্রস্তুত চীন।
চীনের সাথে সরসারি যোগাযোগ স্থাপিত হলে ‘পূর্বমুখী’ আন্তঃদেশীয় বন্ধুত্ব বৃদ্ধির পথরেখা ধরে বাংলাদেশের জন্য সোনালি সম্ভাবনার স্বর্ণ-দুয়ার খুলে যাবে। চীন হয়ে জাপান, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ডসহ পূর্বদিকের এশীয় দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ও বাণিজ্যিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে নব-উত্তরণ ঘটবে। এসব দেশে বাংলাদেশের জন্য রয়েছে অবারিত রফতানি বাজার সম্ভাবনা। যা অনায়াসেই আয়ত্তে নিতে পারবে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের সঙ্গে চীনসহ পূর্বমুখী সম্পর্ক জোরদার করে পতিত পলাতক ফ্যাসিস্ট হাসিনার আমলের একতরফা ভারত তোষণ নীতি, ভারত-নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসা এবং নিজের দরজা উন্মুক্তকরণের জন্য বর্তমান সময়েই সুবর্ণ সুযোগ তৈরি হয়েছে। এর ফলে আসিয়ান-এর শক্তিধর দেশগুলোর সাথে বাংলাদেশের অর্থবহ সম্পর্কের আদান-প্রদান গড়ে উঠবে।
চীনের আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতায় চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন স্থাপন এবং কর্ণফুলী টানেল নির্মাণের ফলে চীনের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আরও জোরদার এবং দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতির ভিত্তি রচিত হয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে রেলপথ সম্প্রসারণ করা হবে কক্সবাজারের শেষ পূর্ব প্রান্ত মিয়ানমারের কাছে ঘুনধুম সীমান্ত পর্যন্ত। সম্প্রসারিত হতে চলেছে চট্টগ্রামের মীরসরাই থেকে বন্দরনগরী হয়ে সমুদ্র তীর ঘেঁষে কক্সবাজারের টেকনাফ পর্যন্ত মেরিন ড্রাইভওয়ে। চট্টগ্রামের আনোয়ারায় স্থাপনের কাজ চলছে ‘স্পেশাল চায়না ইকোনমিক জোন’।
বাংলাদেশ-চীন যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজতর এবং সহযোগিতার ক্ষেত্র আরো প্রসারিত হলে বন্দর-শিপিং, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্পায়ন, বিনিয়োগ, অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তি কলা-কৌশল বিনিময়, সেবাখাত, কৃষি-খামার, প্রযুক্তি, শিক্ষা, ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্প, পর্যটন ও মানবদক্ষতা উন্নয়নে দেশ এগিয়ে যাবে। অর্থনীতিতে খুলে যাবে সমৃদ্ধি অর্জনের বহুমুখী দ্বার। সহযোগিতার মেলবন্ধনে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় উদীয়মান ‘নিউক্লিয়াসে’ এবং ‘হাব’-এ পরিণত হবে বন্দরনগরীসহ চট্টগ্রাম অঞ্চল।
সম্প্রতি চীনের সমুদ্র বন্দরের সাথে দেশের প্রধান চট্টগ্রাম বন্দরের সরাসরি জাহাজ চলাচল শুরু হয়েছে। এই প্রথম চীন থেকে পণ্য নিয়ে সরাসরি জাহাজ ভিড়ে চট্টগ্রামে। বাংলাদেশ-চীন সরাসরি প্রথম বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচলকে একটি শুভ সঙ্কেত হিসেবে দেখছেন পোর্ট-শপিং সেক্টর ও শিল্প-ব্যবসায়ী খাত সংশ্লিষ্টরা। গত ১৬ সেপ্টেম্বর’২৪ ইং সিঙ্গাপুরের পতাকাবহী জাহাজ ‘এমভি কোটা আংগুন’ নামক জাহাজ চীন থেকে পণ্য নিয়ে মাত্র ৯ দিনে চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙর করে। অথচ এর আগে চীনের বন্দর থেকে সিঙ্গাপুর, কলম্বো কিংবা মালয়েশিয়া হয়ে দীর্ঘ ঘুরপথে চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্যবাহী জাহাজ পৌঁছাতে ২০ থেকে ২৫ দিন পর্যন্ত সময় লেগে যায়।
বিশ্বের ব্যস্ততম সমুদ্র বন্দরের শীর্ষস্থানে থাকা চীনের পোর্ট অব নিংবোঝুশান থেকে চীনা পণ্য বোঝাই ৫৫২টি কন্টেইনার নিয়ে আসে উক্ত জাহাজ। চায়না-চিটাগাং এক্সপ্রেস (সিসিই) নামক সার্ভিসে একাধিক প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন জাহাজের একটি কনসোর্টিয়াম গঠিত হয়েছে। এর আওতায় সরাসরি এলো জাহাজ। চীন-চট্টগ্রাম বন্দর সরাসরি জাহাজ পরিচালনা পুরোদমে চালু হলে শিপিং, ট্রান্সশিপমেন্টের বাড়তি খরচ অনেকাংশে কমে আসবে। এই সার্ভিস স্থায়ী ও টেকসই করার জন্য প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তাগণ।