Image description
সরজমিন: চার জেলা

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ছয় মাস পার করেছে। আসছে ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন হতে পারে এমন আশ্বাস দেয়া হয়েছে সরকারের তরফে। একইসঙ্গে প্রয়োজনীয় সংস্কারের কথাও বলছে সরকার। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সন্দেহ অবিশ্বাস। পরিস্থিতি নিয়ে চিন্তিত সাধারণ মানুষ। কি হবে, কি হচ্ছে নানা জিজ্ঞাসা। বিএনপিসহ বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল দ্রুত নির্বাচন চাইছে। নির্বাচন নিয়ে দলগুলোর দাবি আর সরকারের অবস্থান নিয়ে কি ভাবছে সাধারণ মানুষ। মানবজমিন তা জানার চেষ্টা করেছে। চারটি জেলার, বিভিন্ন উপজেলা, গ্রাম এবং শহর সরজমিন ঘুরে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের নানামুখী প্রতিক্রিয়া মিলেছে। বেশির ভাগ মানুষের মত যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন হবে তত পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। আবার কেউ কেউ সময় নিয়ে সংস্কারের কথাও বলেছেন। রাজনৈতিক সরকার হলে পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে এমনটা মনে করেছেন অনেকে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, পুলিশ, প্রশাসনসহ সরকারি নানা খাতে বিশৃঙ্খলার কারণে মানুষের মাঝে হতাশার চিত্র দেখা গেছে। মানুষ বলছে, কোথাও কারও নিয়ন্ত্রণ আছে বলে মনে হচ্ছে না। কেউ কারও কথা শুনছে না। 

মানুষ মনে করে ছয় মাসে সরকার প্রত্যাশা পূরণে যথেষ্ট কিছু করতে পারেনি। এভাবে চললে সামনে পরিস্থিতির খারাপ হতে পারে। এজন্য যথা সম্ভব নির্বাচন দিয়ে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হলে তারা হয়তো ভালো করতে পারে। জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক দলগুলোর কার্যক্রমও কঠোর নজরে রেখেছে সাধারণ মানুষ। তারা দলগুলোর কার্যক্রম মূল্যায়ন করেও মতামত দিয়েছেন। বলছেন, যে পরিবর্তনের দাবিতে ছাত্র-জনতা জীবন দিয়েছেন তা অর্জন করতে হলে দলগুলোর পুরনো অভ্যাস বদলাতে হবে। মানুষের জন্য কাজ করতে হবে। গত ছয় মাসে দলগুলো বড় কোনো আশা তৈরি করতে পারেনি। 

গাজীপুর: বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার গাজীপুর জেলার বিভিন্ন উপজেলা ও প্রান্তিক গ্রাম ঘুরে সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে মানবজমিন। কালিয়াকৈর উপজেলার তেলিরচালার বাজারের ভাঙাড়ি বিক্রেতা সাইফুল ইসলাম বলেন, যেভাবে দ্রব্যমূল্য বাড়ছে। সরকার সিন্ডিকেটও ভাঙতে পারছে না। সরকারে যারা বসে আছেন, তারা কোনো আশা দেখাতে পারছেন না। বলেন, এর চেয়ে ভালো নির্বাচন হোক, যা হবার পরে হবে। নির্বাচিত সরকার আসলে অস্থিরতা কমবে। 

হলি মডেল পাবলিক স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক এম এ করিম তার কার্যালয়েই কথা বলেন। জানান, যেভাবে দেশ চলছে তাতে দ্রুত নির্বাচন হলেই ভালো। রাস্তায় রাতের বেলা মানুষের চলাচলে খুবই সমস্যা। চুরি, ডাকাতি বেড়ে গেছে। গাজীপুর শিল্প এলাকা হওয়ায় এখানকার মানুষ বেশি নিরাপত্তা আশা করেন। রাতে রাস্তায় বের হলে দেখবেন পুলিশ নাই। মাঝেমধ্যে সেনাবাহিনীর একটা দুটো গাড়ি রাস্তা দিয়ে আসে। পোশাক কারখানাগুলোয় কাজ করেন ৮০ ভাগই নারী শ্রমিক। তারা রাতের বেলা বাসায় ফেরেন নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। আমরা আমাদের স্কুলের সবগুলো ক্লাসের বই এখনো পাইনি। 

পাশের তেলিরচালা মডেল পাবলিক স্কুলের শিক্ষক ফারুক হোসাইন বলেন, পাঠ্য বই সবগুলো এখনো পাইনি। আইনশৃঙ্খলা নড়বড়ে। এখনকার রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে রেষারেষি বেড়েছে। এখন যে অবস্থা তার চেয়ে ভালো নির্বাচন হয়ে গেলে। 

কালিয়াকৈর বাজারে জুতা সারাইয়ের কাজ করেন পর্বত। তিনি বলেন, বিগত ৬ মাসে কি এমন পরিবর্তন হয়েছে। এখনো তো মানুষ নিরাপদ বোধ করছে না। আমাদের এখানে আওয়ামী লীগ আর বিএনপিকেই মানুষ চেনে। আওয়ামী লীগ নেই। এখন বিএনপি’র জনপ্রিয়তাই বেশি। 

একই বাজারে আমিনুল ইসলাম নামে শরবত বিক্রেতা বলেন, আমাদের আসনে ভোট হলে বিএনপিই জিতবে। কিন্তু বিগত সরকার যা যা করছে এখন অনেকে তাই তাই করছে। ড. ইউনূস মানুষ ভালো। তিনি কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছেন না। এভাবে চালানোর থেকে নির্বাচন দিয়ে দেয়াই ভালো। তিনি বলেন, এবার আমার মনে হয় জামায়াত ভালো করবে। 

গণেশ নামে একজন চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বলেন, জামায়াতের প্রভাব খুব একটা আমাদের কালিয়াকৈরে নেই। এ আসনে বিএনপি’র আধিক্যই বেশি। 

ফুটপাথে আচার বিক্রেতা ফরিদ উদ্দিন বলেন, আমাদের কাজ করেই খেতে হচ্ছে। তবে নির্বাচনটা হলেই ভালো। ইউনূস সাহেব ভালো মানুষ। তিনি তো জোর দিয়ে কিছু করতে পারছেন না। নির্বাচনে বিএনপি বা অন্য দল যারাই ক্ষমতায় আসুক অন্তত নিরাপত্তাটা ঠিকমতো পাওয়া যাবে বলে মনে হয়। এখন তো কোনো কিছুই ঠিক নেই। আল্লাহর ওয়াস্তে দেশ চলছে। 

একই বাজারের চা বিক্রেতা কার্তিক সাহা বলেন, এখনকার যারা মুক্তিযোদ্ধা আছেন। অনেকেই তো  ভুয়া। দলের নাম ব্যবহার করে রাজনীতি করে বেশির ভাগই মুক্তিযোদ্ধা হয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি নেই, দ্রব্যমূল্য মানুষের কেনা কষ্ট, দফায় দফায় দাম বাড়ছে। রমজানকে কেন্দ্র এভাবে সিন্ডিকেট হচ্ছে। সরকার কিছু করতে পারছে না। আশা ছিল ছাত্র-জনতার সরকার নতুনভাবে দেশ চালাবেন। সবকিছু জনসাধারণের সাধ্যের মধ্যে থাকবে। সে আশা পূরণ হয়নি। 

শ্রীপুর উপজেলার শ্রীপুর বাজারে চা বিক্রেতা রিপন মিয়া বলেন, কাউকেই তো ভালা পাইতেছি না। বাজারে আসা ক্রেতা আজিজ মিয়া বলেন, যেই লাউ সেই তো কদুই পাইলাম। পরিবর্তন তো হইলো না। মাস ছইডা হইয়া গেল। সরকার কি করতে পারছে। নির্বাচন হোক মানুষ অন্তত স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারবে। যে জিতে সেই দেশ চালাক। 

যা ভাবছেন নারায়ণগঞ্জের মানুষ: বন্দর উপজেলার ঝুঁকিপাড়া গ্রামের নূর মোহাম্মদ প্রান্তিক চাষি। তার সোজা কথা- আমাদের সামনে আর ভালো কিছু নেই। যা ভালো ছিল তা আমরা অতিক্রম করে ফেলেছি। সহসাই দেশের পরিস্থিতি ভলো হবে না। 

উপজেলার লাঙ্গলবন্দ কাঁচা বাজারে পাশেই লিটন ইলেক্ট্রনিক্স-এ কথা হয় খায়রুল বাশার নামের এক জনের সঙ্গে। পত্রিকা কিনতেই প্রতি দিন বাজারে আসেন। নিয়মিত পত্রিকা পড়েন এ ছাড়া সময় কাটে না তার। বলেন, এখন প্রতি ঘরে ঘরে রাজনীতিবিদ। কিন্তু রাজনৈতিক দক্ষতা নেই। 

পাশেই বসা লিটন নামের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী জানান, শুধুমাত্র কৃষিপণ্যের মূল্য কিছুটা কম হলেও বাকি সব দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বগতি। এ অবস্থায় কৃষক বাঁচবে কীভাবে। 

মো. আব্দুল রাজ্জাক নামের অটো রিকশাচালকের চিন্তা রাস্তাঘাটের বেহাল দশা নিয়ে। দৈনিক জমা খরচ বাদ দিয়ে প্রায় ৮০০ টাকার মতো ইনকাম তার। এ নিয়েই দিনযাপন করছেন। কিন্তু স্থানীয় চেয়ারম্যান পলাতক থাকায় রাস্তাঘাটের শোচনীয় অবস্থা। এ কারণে অটো চালাতে কষ্ট হয় তার। 

আলাউদ্দীন ভূঁইয়া নামের এক চা বিক্রেতা বলেন ৫ই আগস্টের পর বেচাবিক্রি কমেছে। ৩ বছর ধরে বাজারে চায়ের দোকান করেন। দেশের অর্থনীতির অবস্থা খারাপ, এলাকায় আওয়ামী লীগের লোকজনের বসবাস বেশি ছিল, ফলে তারা গা ঢাকা দেয়ায় এলাকায় তেমন লোকজন নাই। এতে তার বেচাবিক্রির এই দুরবস্থা। 

মো. শামীম এবং আবু হানিফ পুকুরে হারানো স্বর্ণের অলংকার খোঁজে দেন। তারা পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে এ কাজ করেন। তারা বলেন, কাজের সুবাদে সারা দেশেই আমাদের ঘুরতে হয়। দেশের যে পরিস্থিতি তাতে আমরা খুবই ভয়ে থাকি। বেদে পল্লীতে আগে কোনো চুরি-ডাকাতি হতো না। কিন্তু এখন পল্লীতেও ঘটছে এসব নানা অপরাধ।

শীতলক্ষ্যা নদীর তীরবর্তী বন্দর থানার ২২নং ওয়ার্ড। বন্দর খেয়াঘাটে জসিম টি স্টলে কথা হয় মো. রাসেল নামের এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে। তিনি বলেন, বর্তমানে দ্রব্যমূল্যসহ বাজারের পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিকই আছে। কিন্তু এই সরকার রাজনৈতিক সরকার না হওয়ায় তৃণমূলে তাদের নিয়ন্ত্রণ নাই। সুতরাং তারা ব্যর্থ হলে ব্যক্তি হিসেবে দুর্নাম হবে। কিন্তু রাজনৈতিক সরকার ব্যর্থ হলে দল হিসেব একটা বড় ধাক্কা খায়। তাই রাজনৈতিক সরকার দেশ পরিচালনায় সচেতন থাকে বেশি এবং সব জায়গায় নিয়ন্ত্রণ থাকায় সিন্ডিকেট করাটা কঠিন হয়ে যায়। তাই দ্রুত ভোটদানের মাধ্যমে জনগণের সরকার গঠন হলে, টেকসই পরিবর্তন হতে পারে। 

বন্দর প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন সিদ্দিকী বলেন, নভেম্বরের শেষের দিকে এখানে একটু ভাঙচুর হয়েছে।  এ উপজেলার মুক্তিযোদ্ধাদের ক্লাবগুলো বন্ধ রয়েছে। বর্তমানে এলাকার সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলেই তারা বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। প্রেস ক্লাবের সভাপতি আত্মগোপনে আছেন জানিয়ে তিনি বলেন, সরকারের উচিত মবের অবসান ঘটানো। 

সদর উপজেলার ফতুল্লা ইউনিয়নের শামসুল আলমের মোড়ে অবস্থিত ‘জামিয়াতুর রহমান তানজিমুস সুন্নাহ’ মাদ্রাসার পরিচালক মাওলানা আরিফুল ইসলাম বলেন, নারায়ণগঞ্জ শহরের কাছেই এই ইউনিয়ন হলেও যাতায়াত ব্যবস্থার কারণে এখানে প্রতিটি পণ্যের দাম ৫ থেকে ১০ টাকা বেশি। দীঘুলী রোডের মোড়ে বাবুল নামের মুদি দোকানি বলেন,  এখানকার চেয়ারম্যান অসুস্থ থাকায় বিভিন্ন প্রয়োজনে ইউনিয়নে যেতে হয় তার। সেখানের মানুষের মতামত হচ্ছে এখনই যদি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নিজেদের মধ্যে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে, তবে তৃতীয় শক্তি ক্ষমতায় চলে আসবে। যেহেতু বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী দুইটা বড় রাজনৈতিক দল, সুতরাং আওয়ামী লীগ নির্বাচনে না গেলে তারাই হবে সরকারি এবং বিরোধী দল। তাই তাদের মধ্যে মতপার্থক্য থাকবে এটাই স্বাভাবিক। 

রূপগঞ্জ উপজেলায় তারাবো পৌরসভা। বাসস্ট্যান্ড থেকে একটু দূরে গাজী টায়ারের কারখানার নিরাপত্তা কর্মী মো এরশাদুল ইসলাম। তিনি দীর্ঘ ১১ বছর এ কারখানায় নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছেন। তিনি বলেন, কারখানায় আগুন দিয়ে ও লুটপাট করে সব নিয়ে যাওয়ার কারণে দেশে টায়ারের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেক শ্রমিক বেকার হয়ে যাওয়ায় মানবেতর জীবনযাপন করছে। তিনি বলেন, এই অবস্থার চাইতে দ্রুত নির্বাচন হলে রাজনৈতিক দল দেশ চালাতে পারবে। তখন দেখা যাবে কী হয়। 

‘স্বর্না মহল’ সিনেমা হলের টিকিট মাস্টার আমীর হোসেন জানান, দিনে ৩টা শো চলে। কিন্তু গাজী টায়ারের কারখানা ধ্বংসের কারণে প্রভাব পড়েছে এ সিনেমা হলে। ৮ থেকে ১০ জন দর্শক নিয়ে চালাতে হচ্ছে হল। এতে কোনো রকমে হল খরচটা উঠছে কিন্তু লাভ কিছুই থাকছে না।

রূপগঞ্জের জামিরাতুল বুশরা মাদ্রাসার মুহতামিম যুবায়ের আহমেদ বলেন, দ্রুত নির্বাচনটা হয়ে যাওয়া উচিত। এতে জনগণের সরকার হবে। জনগণের সরকার হলে মানুষ আরও স্বস্তি পাবে। 

একই এলাকায় স্টিলের পণ্য তৈরির কারখানার মালিক আব্দুল্লাহ বলেন, নির্বাচনটা দ্রুত হলে ভালো। নির্বাচন হয়ে গেলে কোনো দল বা পক্ষ একক নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। তিনি বলেন, আমাদের এলাকায় চুরি ছিনতাই বেড়ে গেছে।   

মুন্সীগঞ্জের যে চিত্র: মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার সমিতি মার্কেট এলাকার বাসিন্দা আব্দুস সোবহান বলেন, সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা ছিল অনেক। কিন্তু সরকার আমাদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। এখন শীতের মৌসুম তাই সবজির দাম কম। সয়াবিন তেল, চালের দাম এখন অনেক বেশি। সামনে রমজান আসতেছে পণ্যের দামের কী অবস্থা হবে তা কেউ বলতে পারে না, আমরা আতঙ্কিত। নির্বাচন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রশাসনে যেহেতু আওয়ামী লীগ সরকারের কর্মকর্তারা এখনো রয়েছে তাই সব সংস্কার করে নির্বাচনটা একটু পরে দেয়াটাই ভালো। কারণ প্রশাসন এখনো ঠিকমতো পুরোদমে কাজ করছে না, সে ক্ষেত্রে  নিবাচনের পরিবেশ তৈরি করার জন্য  সরকারকে সময় দিতে হবে। একটা নির্বাচন দিলে যেই পরিমাণে সংঘর্ষ হবে দলীয় কোন্দল থাকবে তা  নিয়ন্ত্রণ করার মতো সক্ষমতা সরকারের এখনো হয়নি।

রসুলপুর বাজারের ব্যবসায়ী আমিনুল ইসলাম বলেন, সরকার আসে, সরকার যায়- আমাদের অবস্থার পরিবর্তন নাই। কী যে একটা বিপদে আছি আগে নেতা ছিল একজন এখন প্রতি ঘরে ঘরে নেতা। আওয়ামী লীগের লোকজন যা করতো এখনো কেউ কেউ তা করছে। তিনি বলেন,  স্থানীয় নির্বাচন এই সরকারের আমলেই হোক কারণ হচ্ছে বিগত বছরগুলোতে আমরা দেখেছি, যে দল ক্ষমতায় থাকে সে দল  নির্বাচনে সুবিধা নেয়। 

বাউশিয়া ইউয়নিয়নের আব্দুলাহপুর বাজারে চায়ের আড্ডায় কথা হয় মকবুল মিয়ার সঙ্গে। বলেন, যেইভাবে সরকার দেশ চালাচ্ছে এইভাবে চালানোর চেয়ে নির্বাচন দ্রুত দিয়ে দেয়াই ভালো। কোনো কিছু নিয়ন্ত্রণ নিতে পারেনি এইটা কি বিপ্লবী সরকারের নমুনা? নির্বাচিত সরকার আসলে যদি পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণে আসে তাহলে নির্বাচন দেয়াই ভালো। তাহলে চেইন অব কমান্ড থাকবে, এখন তো কেউ কারও কথাই শুনছে না। নির্বাচিত সরকার আসলে পরিস্থিতির হয়তো উন্নতি হবে তখন সবকিছু একটা নিয়মশৃঙ্খলার মধ্যে থাকবে। 

মুক্তারপুরে কথা হয় হাসিব মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, সরকার যদি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে না পারে তাহলে এভাবে দেশ চালানোর কোনো মানেই হয় না, নির্বাচন দিয়ে দিক। এই যে ছাত্রনেতারা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আন্দোলন করে একদিনও তো দেখলাম না যে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ দাবি করে রাস্তায় নামতে। এই যে সয়াবিন তেলের দাম ২০০ টাকা, চালের দাম বাড়তি এই নিয়ে কোনো ছাত্র প্রতিনিধি কিংবা রাজনৈতিক ব্যক্তি কথা বলেছে? সবার একটাই চিন্তা শুধু ক্ষমতায় যাওয়া আর কিছুই না। বাজারের সিন্ডিকেট কি শেখ হাসিনা থেকে শক্তিশালী নাকি? ছাত্রজনতা বুলেটের সামনে বুক পেতে দিয়েছে আর সিন্ডিকেট তো ফুঁ দিলেই উড়ে যাওয়ার কথা।

মুন্সীগঞ্জ পৌরসভার হাটলক্ষীগঞ্জ এলাকার সোহাগ বলেন, সরকার যদি চাঁদাবাজি, জমি দখল, টেন্ডারবাজি নিয়ন্ত্রণ নিতে না পারে তাহলে আমরা চাই দুই মাসের মধ্যে নির্বাচন দিয়ে দিক। যেহেতু পুলিশ প্রশাসন কাজ করছে না বা তাদের লোকবল সংকট সেক্ষেত্রে একটা কাজ করতে পারে। আট বিভাগে আট দিনে নির্বাচন দিতে পারে। তাহলে ভালোমতো নিরাপত্তা জোরদার করা যাবে, সারা দেশে একদিনে নির্বাচন হলে কোনো কেন্দ্রে পাঁচজন বা আটজন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য দায়িত্ব পালন করে এতে নিরাপত্তার বিঘ্ন ঘটে। 

সিরাজদিখান উপজেলার রাজদিয়া গ্রামের বাসিন্দা সালাউদ্দিন বলেন, আমি বিএনপি সমর্থন করি কিন্তু তারপরও আমি চাই ইউনূস সরকার সফল হোক। কিন্তু এখনো পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি, চাঁদাবাজি, জমি দখল, টেন্ডারবাজি আগে থেকে বহু গুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। এগুলো যত দ্রুত সম্ভব নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। বিএনপি বিগত ১৫ বছর ধরে আন্দোলন করেছে। ছাত্র-জনতা আন্দোলন করে রক্ত দিয়ে স্বৈরাচার সরকারের পতন ঘটিয়েছে। আমরা একটি নতুন বাংলাদেশ চাই। 

কুচিয়ামোড়া আদর্শ ডিগ্রি কলেজের ছাত্র তারেক হোসেন বলেন, আমরা চাই ইউনূস সরকার থাকুক। তিনি একজন স্বনামধন্য ব্যক্তি আন্তর্জাতিক বিশ্বে তার খুবই সুনাম এবং যোগাযোগ রয়েছে। কিন্তু তিনি সবকিছু নিয়ন্ত্রণ নিতে পারেননি। থানা পুলিশ ঠিক মতো কাজ করছে না, তাদেরকে সক্রিয় হতে  হবে। সরকার যদি কঠোর হয় ছিনতাই, চাঁদাবাজি, জমি দখল নিয়ে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করে তাহলে আমরা সরকারের প্রতি সন্তুষ্ট থাকবো। যদি সরকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ নিতে না পারে তাহলে দ্রুত নির্বাচন দিয়ে দিক। তিনি বলেন, পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, আগে খেতো সলিমুল্লাহ এখন খাচ্ছে কলিমুল্লাহ পার্থক্য এতটুকুই। 

রাদিপ নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, আমরা চাই সংস্কার করে নির্বাচন হোক। কারণ এ সরকার সংস্কার করতে না পারলে অন্য কোনো সরকার সংস্কার করতে পারবে না। ফলে আমরা বার বার স্বৈরাচার সরকার দেখতে পাবো। ইতিমধ্যেই দখলবাজি চাঁদাবাজি টেন্ডারবাজি চলছে সরকারকে এগুলো প্রতিরোধ করতে হবে, না হলে আমাদের ছাত্রদের রক্ত বৃথা যাবে। তিনি বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচন এ সরকারের আমলে জাতীয় নির্বাচনের আগেই হওয়া উচিত। স্থানীয় নির্বাচনের ফলে সরকারের সক্ষমতাও যাচাই করা যাবে ফলে সরকার বুঝতে পারবে জাতীয় নির্বাচনের জন্য সরকারের সক্ষমতা কতোটুকু।   
মানিকগঞ্জ: সাটুরিয়া উপজেলার বালিয়াটি গ্রামের বাসিন্দা আক্কাস আলী বলেন, ড. ইউনূস কূটনৈতিকভাবে দেশকে এগিয়ে নিচ্ছেন। পরে যে সরকার আসবে তারা হয়তো  তা পারবে না। এখন যা দেখা যাচ্ছে তাতে মনে হয় নির্বাচন দেয়া উচিত। নির্বাচন দিলে অস্থির দেশ শান্ত হবে। একটা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় চলবে। 

অটোরিকশাচালক উজ্জ্বল বলেন, অবশ্যই নির্বাচন দিতে হবে। এভাবে দেশ চলে না। এখন সরকারই নেই বলে মনে হয়। 

বালিয়াটি ইউনিয়নের পশ্চিম বাড়ি বাসস্ট্যান্ডে চা বিক্রেতা কাবেল আলী বলেন, এখন দেশের সব জায়গায় মারামারি, কাটাকাটি হচ্ছে। আমার মনে হচ্ছে দেশ আসলে ভালো নেই। আমি মনে করি নির্বাচিত সরকার না থাকায় এসব হচ্ছে। নির্বাচন দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। কারণ তখন সরকারই সব নিয়ন্ত্রণ করবে। না পারলে নির্বাচিত সরকার দায় নেবে।  

সাটুরিয়া উপজেলার পুলক নামের কীটনাশক বিক্রেতা বলেন, ড. ইউনূস যেভাবে দেশ চালাচ্ছেন এভাবে চললেও সমস্যা নেই। ভালোই চলছে। তবে হ্যাঁ, নির্বাচন হয়ে গেলেও ভালো।  সরকার আসবে, দেশ একটা নিয়মের মধ্যে আসবে।  

রামচন্দ্রপুর গ্রামের সাবের আলী বলেন, নির্বাচন দেয়া এখনই দরকার। নির্বাচন হলে দাবি-দাওয়ার আন্দোলন, অবস্থান এসব বন্ধ হবে। 

সিংগাইর উপজেলার মানিকনগরের বাসিন্দা সাদেক বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার তো নির্বাচিত সরকার না। তাদের থেকে দেশের কি উন্নয়ন আশা করবো। কেয়ারটেকার দিয়ে যেমন বাড়ি চলে না, কেয়ারটেকার সরকার দিয়েও তেমন দেশ চলে না। তাই নির্বাচন দিতে হবে। নির্বাচন দেয়ার পর দেশ স্থিতিশীল হবে।

একই এলাকার অটোরিকশাচালক আবদুল খালেক বলেন, আগে পরে তো নির্বাচন দিতেই হবে। নির্বাচিত সরকার ছাড়া দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। ড. ইউনূসের অনেক মেধা আছে, কিন্তু দেশ চালাতে হলে অনেক অভিজ্ঞ মানুষের দরকার। তাই দেশ চালাবে দলীয় সরকার। যাদের দেশ পরিচালনায় অভিজ্ঞতা রয়েছে। 

সিংগাইর উপজেলার রামচন্দ্রপুর গ্রামের বিএনপি’র ওয়ার্ড পর্যায়ের একজন কর্মী বলেন, এ সরকার থাকলে আমার সমস্যা নেই। কিন্তু সরকারকে তো তাদের কাজ করতে হবে। তাই দেশ চালনার জন্য নির্বাচিত সরকার আসতে হবে। সরকার সে যেই হোক আমার বিএনপি হলেও উচিত কথা বলতেই হবে। 

আলী আকবর নামের ডাউটিয়া বাজারের একজন বলেন, ছাত্ররা যে সরকার বসিয়েছে তিনি তো সব সময়ের জন্য না। এখন পরিস্থিতি হচ্ছে যার পয়সা আছে চলতেছে ঠিকই। যার নাই, সে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। এখন সুষ্ঠু নির্বাচন দিয়ে দিলে দেশ নিয়ন্ত্রণে আসবে। দেশ এখন এলোমেলো, কারও কথা কেউ মানে না। এখন সবাই সরকার। ড. ইউনূস সরকার সব কিছু নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না। উনার জন্য এসব কষ্টকর। এখন জনগণ সুন্দর একটা নির্বাচন চাইছে। সরকারের উচিত এমন একটা নির্বাচন আয়োজনের দিকে যাওয়া। 

সিংগাইর উপজেলার সাগর নামে মানিকনগর বাজারের এক হোটেল ব্যবসায়ী বলেন, ইউনূস সরকার অনেক গুরুত্বপূর্ণ। অল্প সময়ে যাই করুক, একটা সময়ে দেশের হাল ধরেছে।

সুতক্ষিরা গ্রামের মান্নান কৃষিকাজ করেন। তিনি বলেন, ড. ইউনূসের মতো লোকই পারবে দেশকে স্থিতিশীল করতে। তার মেধা আর জ্ঞান অনেক বেশি। সব সরকারেরই খারাপ দিক আছে। তাই দেশে এখন যে দলগুলো নির্বাচনের জন্য আছে এসব দলের বাইরে আমরা অন্য দল চাই। যা দেশের জন্য মঙ্গল হবে। ড. ইউনূস এখন যে পথে আছেন এটাই সঠিক।