
ত্রিবেণী শ্মশান খালে ফাইভ মার্ডারের ২২ বছর পর একই স্থানে একই স্টাইলে ঘটল ট্রিপল মার্ডার। আতঙ্ক আবার দানা বাঁধছে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের একসময়কার চরমপন্থি অধ্যুষিত ঝিনাইদহে। এরইমধ্যে নিষিদ্ধ ঘোষিত চরমপন্থি সংগঠন জাসদ গণবাহিনীর কালু গ্রুপের প্রধান কমরেড কালু হোয়াটসঅ্যাপে সাংবাদিকদের খুদে বার্তা পাঠিয়ে হত্যার দায় স্বীকার করেছে। দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে নতুন করে আবার চরমপন্থি সংঘাত ছাড়িয়ে পড়তে পারে।
কুষ্টিয়া সদর উপজেলার পিয়ারপুর গ্রামের একটি বড় মাঠ। মাঠ পেরোলেই ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার রামচন্দ্রপুর গ্রাম। দুই জেলার দুই গ্রামের মধ্যবর্তী দুই কিলোমিটার জুড়ে মাঠ। এটাই ত্রিবেণীর শ্মশানঘাট এলাকা। এ মাঠেই শুক্রবার রাতে তিনজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
নিহতদের মধ্যে রয়েছে চরমপন্থি সংগঠন পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টি এমএল জনযুদ্ধ লাল পতাকার আঞ্চলিক প্রধান ও মৎস্যজীবী লীগ নেতা হানিফ উদ্দিন ওরফে হানেফ মণ্ডল (৫৫)। তিনি ঝিনাইদহের হরিণাকুন্ডু উপজেলার দৌলতপুর ইউনিয়নের আহাদনগর গ্রামের বাসিন্দা। অন্যজন একই উপজেলার হানেফের শ্যালক শ্রীরামপুর গ্রামের লিটন মিয়া (৩৮) এবং অন্যজন হানেফের দেহরক্ষী কুষ্টিয়ার ইবি থানার পিয়ারপুর গ্রামের রাইসুল ইসলাম (৩৫)।
এদিকে জাসদ গণবাহিনীর নেতা পরিচয়ে জনৈক কালু হোয়াটসঅ্যাপ বার্তায় দাবি করেন, ‘এতদ্বারা ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, মাগুরা, কুষ্টিয়া, যশোর ও খুলনাবাসীর উদ্দেশে জানানো যাইতেছে যে, পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টি নামধারী কুখ্যাত ডাকাত বাহিনীর শীর্ষ নেতা অসংখ্য খুন, গুম, দখলদারি, ডাকাতি, ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্ত হরিণাকুন্ডু নিবাসী মো. হানিফ তার দুই সহযোগীসহ জাসদ গণবাহিনীর সদস্যদের হাতে নিহত হয়েছেন। অত্র অঞ্চলের হানিফের সহযোগীদের শুধরে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হলো। অন্যথায় আপনাদের একই পরিণতির মুখোমুখি হতে হবে।’
এই খুদে বার্তা পাওয়ার পর রাত ১২টার দিকে তিনটি মৃতদেহ রামচন্দ্রপুর-পিয়ারপুর ক্যানেলের পাশ থেকে উদ্ধার করে পুলিশ।
পুলিশ জানায়, দুদল চরমপন্থি শুক্রবার রাত ৮টার দিকে ত্রিবেণী শ্মশান খাল এলাকায় কায়েতপাড়া বাঁওড় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। উভয় পক্ষের মধ্যে প্রায় ৮/১০ রাউন্ড গুলিবিনিময় হয়। গুলির শব্দে রামচন্দ্রপুর, পিয়ারপুর ও ত্রিবেণী গ্রামবাসীর মধ্যে উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়ে। ঘটনাস্থল শৈলকুপার ত্রিবেণী শ্মশান খাল বিস্তৃত হরিণাকুন্ডু ও শৈলকুপা এবং কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থানার মধ্যবর্তী দুর্গম বিল এলাকায় গোলাগুলির একপর্যায়ে আতঙ্কিত গ্রামবাসী শৈলকুপার রামচন্দ্রপুর ফাঁড়িতে খবর দিলে পুলিশ এসে তিন চরমপন্থির লাশ এবং তাদের ব্যবহৃত দুটি পালসার মোটরসাইকেল ও একটি ম্যাগাজিনসহ বেশকিছু গুলির খোসা উদ্ধার করে। নিহতদের সবাইকে মাথায় গুলি করে ও কুপিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়েছে বলে রামচন্দ্রপুর পুলিশ ফাঁড়ির আইসি মতিয়ার রহমান নিশ্চিত করেছেন।
পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, দীর্ঘদিন ধরে ঝিনাইদহ, হরিণাকুন্ডু আলমডাঙ্গা, চুয়াডাঙ্গা ও কুষ্টিয়াসহ বিভিন্ন এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টি এমএল জনযুদ্ধ ও জাসদ গণবাহিনী নামের দুটি চরমপন্থি দলের মধ্যে বিরোধ চলে আসছিল। শুক্রবার রাতে রামচন্দ্রপুর শ্মশানঘাট এলাকায় পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টি এমএল জনযুদ্ধের নেতাদের গোপন বৈঠকের খবর পেয়ে যায় প্রতিপক্ষ গ্রুপ। জাসদ গণবাহিনীর শীর্ষ নেতা কালুর নেতৃত্বে এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে থাকতে পারে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে।
পুলিশ সূত্রে আরও জানায়, নিহত হানিফ মণ্ডলের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় কমপক্ষে ১৩টি হত্যাসহ একাধিক মামলা রয়েছে। বিগত ২০০৩ সালের ৫ ডিসেম্বর ত্রিবেণী শ্মশান খালের ওই একই স্থানে অন্য পাঁচজনকে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। নিহত ‘জনযুদ্ধের’ আঞ্চলিক প্রধান হানেফ মৃত্যুদণ্ডের আসামি ছিলেন। হরিণাকুন্ডু উপজেলার কুলবাড়িয়া গ্রামের আলফাজ হত্যা মামলায় তার ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। উচ্চ আদালতেও ফাঁসির রায় বহাল থাকলে বিগত হাসিনা সরকারের সময় তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের বিশেষ ক্ষমায় প্রাণভিক্ষা পেয়ে এলাকায় ফিরে আবার ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে আসছিলেন হানেফ। এরপর মৎস্যজীবী লীগের হরিণাকুন্ডু উপজেলা কমিটির সহসভাপতি হন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতনের পর দুর্ধর্ষ চরমপন্থি হানেফ আবার রাজনৈতিক রঙ পাল্টে এলাকায় প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেন।
ট্রিপল মার্ডারের নেপথ্যে
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, এই ট্রিপল মার্ডারের নেপথ্যে রয়েছে চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার কায়েতপাড়া ও ঝিনাইদহের হরিণাকুন্ডু উপজেলার পোলডাঙ্গা বাঁওড়। বাঁওড়টিতে বছরে কোটি টাকার ওপরে মাছের চাষ হয়। সম্প্রতি মৎস্যজীবী লীগ নেতা পরিচয়ে হানেফ বাঁওড়ে মাছ ধরা ও প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করলে বিবাদমান একাধিক গ্রুপের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। সেই সূত্র ধরেই হানেফসহ তার দুই সহযোগী হত্যা সংঘটিত হয় বলে এলাকাবাসীর ধারণা। এই বাঁওড়ের আধিপত্য নিয়ে গত ৩০ বছরে অর্ধশত মানুষ খুনের শিকার হয়েছে।
এলাকাবাসী জানায়, চরমপন্থি নেতা হানেফ আগে কুলবাড়িয়া গ্রামের আলফাজ, তিওরবিলা গ্রামের লুৎফর রহমান, তাহেরহুদার আব্দুল কাদের ও পোলতাডাঙ্গার ইজাল মাস্টারসহ প্রায় ১০-১২ জনকে গুলি করে এবং গলা কেটে হত্যা করে। এর মধ্যে ইজাল মাস্টারকে হত্যার পর তার মাথা কেটে ফুটবল খেলেছিলেন হানেফ।
কী ঘটেছিল ২২ বছর আগে
একই স্থানে ২০০৩ সালের ৫ ডিসেম্বর শৈলকুপার শেখপাড়া গ্রামের শহীদ খাঁ, ত্রিবেণী গ্রামের শাহনেওয়াজ, একই গ্রামের ফারুক, নুরু কানা ও কুষ্টিয়ার ভবানীপুর গ্রামের কটাকে গুলি করে ও গলা কেটে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। এ মামলায় ২০২৪ সালের ২৯ অক্টোবর কুষ্টিয়ার আলী রেজা ওরফে কালু ও কুষ্টিয়ার ইবি থানার পিয়ারপুর গ্রামের মহসিন আলীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ঝিনাইদহ জেলা জজ দ্বিতীয় আদালতের বিচারক মো. জাকারীয়াহ এই দণ্ডাদেশ দেন।
শৈলকুপা থানার ওসি মাসুম খান জানান, এলাকায় আধিপত্য নিয়ে এ হত্যার ঘটনা ঘটেছে। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে তিনটি লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য ঝিনাইদহ সদর হাসপাতাল মর্গে পাঠিয়েছে। মরদেহের কিছু দূরে সড়কের ওপর দুটি কালো রঙের পালসার মোটরসাইকেল উদ্ধার করা হয়েছে। ঘটনায় পুলিশ এখনো পর্যন্ত কাউকে আটক করতে পারেনি।
ঝিনাইদহ অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইমরান জাকারিয়া জানান, শুক্রবার রাতে প্রতিপক্ষ বন্দুকধারীরা দুই সহযোগীসহ পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টির সামরিক কমান্ডার হানিফকে গুলি করে হত্যা করে। খবর পেয়ে রাত সাড়ে ১২টার দিকে শৈলকুপা উপজেলার ত্রিবেণী ইউনিয়নের রামচন্দ্রপুর শ্মশানঘাট এলাকার একটি ক্যানেলের পাশ থেকে গুলিবিদ্ধ তিন লাশ উদ্ধার করা হয়। লাশগুলোর মাথায় গুলির চিহ্ন রয়েছে। পাশে দুটি মোটরসাইকেল ও ব্যবহৃত হেলমেট পড়েছিল। নিহত হানিফ প্রায় দুই ডজন হত্যা মামলার আসামি।
হানেফ নিহতের খবর ছড়িয়ে পড়লে হরিণাকুন্ডু, চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গাসহ বিভিন্ন এলাকায় সাধারণ মানুষের মধ্যে যেমন স্বস্তি ফিরেছে, অন্যদিকে আতঙ্কও বিরাজ করছে তাদের মধ্যে। নিহত হানেফের ভাই হরিণাকুন্ডু উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান সাজেদুল ইসলাম ইসা জানান, ‘আমার ভাই সারাদিন মাঠে রসুনক্ষেতে কাজ করছিল। বিকেলে ভাইয়ের ফোনে কল আসে। পরে বাড়িতে এসে গোসল করে মোটরসাইকেলে তার শ্যালক লিটনকে সঙ্গে নিয়ে চলে যায়। পরে রাতে সংবাদ পেলাম আমার ভাই হানেফকে গুলি করে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। যারা ভাইকে হত্যা করেছে, আমি তাদের বিচার চাই।’