
(Nazmul Ahasan)
সাংবাদিকতার অন্যতম কার্ডিনাল রুল হচ্ছে, একজন নিউজম্যান নিজেই যেন নিউজ না হয়ে উঠেন সেই চেষ্টা করা। কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হচ্ছে, মাঝেমাঝে সাংবাদিক নিজেই সংবাদ হয়ে যান। সেরকম ঘটনাই ঘটলো আমার সঙ্গে।
আমার নাম জনাব জুলকারনাইন সায়েরের লেখায় এসেছে। যদিও আমার নাম আমাদের কমন ‘কন্ট্যাক্ট’ আমার অনুমতি না নিয়েই তাকে ছাপাতে দিয়েছেন। আমার আপত্তির পর আমার নাম পরিবর্তন করে ‘কন্ট্যাক্ট’ লেখা হয়েছে, কিন্তু ড্যামেজ ইজ ডান। অনেক টেক্সট আর কল পেয়েছি। কাজেই, ‘সংবাদ’ যখন হয়েছিই, তাই কিছু কথা না বললেই নয়।
প্রথমে বলে রাখি: সায়ের খানের ‘কনফিড্যান্ট’ বা আমাদের অভিন্ন কন্ট্যাক্ট হলেন ডেইলি স্টারের একজন সাংবাদিক। এই পরিচয় গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন কারণে। সেই ব্যাখ্যা পরে কোনো একদিন প্রাসঙ্গিক হবে। আজ আপাতত আপনারা মাথায় নিয়ে রাখেন।
সায়ের খান ঠিকই লিখেছেন যে, আমি তিন ছাত্র নেতার বিষয়ে তার কনফিড্যান্টের সঙ্গে যোগাযোগ করি, যার ফলশ্রুতিতে তিনি নিজেই এর সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েন।
কিন্তু আমার মতো ছাপোষা সাংবাদিক কী করে তাদের সন্ধান জানলো! বিষয়টি একেবারেই কাকতালীয় ও অ্যাকসিডেন্টাল ঘটনা।
হাসপাতালে নজরবন্দী থাকা অবস্থায় ছিলেন হান্নান, মহীন সহ আরেকজন ছাত্রনেতা। নাহিদ সহ শীর্ষ ৫ সমন্বয়ক আটক হয়ে যাওয়ার পর তারা লাইমলাইটে চলে এসেছিলেন। ফলে অবধারিত ঝুঁকির মুখে পড়লেন। এই কারণে তারা সিদ্ধান্ত নিলেন, কোনো এক দূতাবাসে আশ্রয় নেয়া ছাড়া তাদের আর কোনো গতি নেই। এই ধারণা জন্মানোর একটি কারণ হলো তখন একজন অ্যাক্টিভিস্ট তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিলেন। সেই অ্যাক্টিভিস্ট ছাত্রদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন গার্ডিয়ানের এক সাংবাদিকের অনুরোধে।
যেহেতু খুব ভালনারেবল কমিউনিটি নিয়ে ওই অ্যাক্টিভিস্টের কাজ, সেহেতু ঢাকার বিভিন্ন দাতাসংস্থা ও দূতাবাসের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। তিনিই প্রথম নিজস্ব উদ্যোগে ছাত্রদের উদ্ধার করার চেষ্টা চালান। প্রথম থেকে একেবারে শেষ পর্যন্ত তিনি এই তিন ছাত্রের সঙ্গে ছিলেন। তার কথা তারা মেনে চলতেন, কারণ তিনি তাদের আস্থাভাজন হতে পেরেছিলেন। এই ব্যক্তির প্রধান চিন্তা “এক দফা” ঘোষণা করা ছিল না — ছিল এই ছেলেগুলোর জীবন বাঁচিয়ে রাখা। কিন্তু সায়ের খানের পুরো লেখায় এই ব্যক্তির কথা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। কেন তার ভূমিকা অনুপস্থিত, সেই বিচার একদিন ইতিহাস করবে। সেই ইতিহাস রচনার ভার আমি নিজের কাঁধে নিতে চাই না। তবে আমার দিক থেকে কিছু ক্ল্যারিফিকেশন দিয়ে রাখা ভালো।
ওই অ্যাক্টিভিস্ট যেসব দূতাবাসে যোগাযোগ করেন, সেখানেরই একজন কূটনীতিক আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তিনি জানান, তাদেরকে রিকোয়েস্ট করা হয়েছে হ্যান্নানদেরকে যেন দূতাবাস “এক্সট্র্যাক্ট” করে আনে। কিন্তু তাদের পক্ষে কাউকে এক্সট্র্যাক্ট করে আনা সম্ভব নয়; এগুলো শুধু হলিউড সিনেমাতেই ঘটে, বাস্তবে নয়। বিকল্প হিসেবে তিনি আমাকে অনুরোধ করেন যে তাদের হাসপাতালে কোনো চিত্রগ্রাহক পাঠানো যায় কিনা। যেন অন্তত তারা আটক হলেও নাহিদ বা আসিফের মতো ‘গুম’ না হয়ে যান। কেউ যেন স্বাক্ষ্য দিতে পারে যে ডিবি তাদেরকে তুলে নিয়েছে।
আমি বাংলাদেশ কাভার না করলেও, ওই ঘটনা সাংবাদিক হিসেবে আমার দায়িত্বের পরিধির বাইরে ছিল না বলেই আমি ডিটারমাইন করি এবং আমার পরিচিত বাংলাদেশী কলিগদের সঙ্গে যোগাযোগ করি।
এদের একজন ছিলেন নেত্র নিউজের সম্পাদক তাসনিম খলিল, যার ফটোগ্রাফার জীবন আহমেদ তখন আহত হয়ে হাসপাতালে। এরপর এএফপির তৎকালীন ব্যুরো চিফ শফিকুল আলম। মানবজমিন সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী। ফয়সাল মাহমুদ, যিনি এখন নয়াদিল্লিতে প্রেস মিনিস্টার। শহীদুল আলমের দৃক — পারভেজ আহমেদের মাধ্যমে। সর্বশেষ ডেইলি স্টারের ওই কন্ট্যাক্ট। আমার লেখা এই সংক্রান্ত একটি বিবরণী তখন আল জাজিরার তানভীর চৌধুরী, ফয়সাল মাহমুদ ও সম্ভবত দৃকের কারণে সাংবাদিক কমিউনিটিতে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু আমার জানা মতে, শুধুমাত্র দৃক ওই রাতে একজন ফটোগ্রাফারকে পাঠাতে রাজি করাতে পেরেছিল। আর কেউই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেখানে যেতে পারেননি।
কিন্তু ফটোগ্রাফার পৌঁছানোর আগেই আমার কাছে খবর এলো শিক্ষার্থীরা একটা অ্যাম্বুলেন্স ব্যবস্থা করে ওই দূতাবাসের পাশে চলে এসেছে। তখন আমাকে ওই দূতাবাসের কূটনীতিক জানান, তিনি সম্ভবত শিক্ষার্থীদের বোঝাতে পারছেন না ইংরেজিতে। আমি যেন বাংলায় একটু বুঝিয়ে বলি যে তাদেরকে দূতাবাসে আশ্রয় দেয়া সম্ভব নয়। দূতাবাস এমনিতেও বন্ধ। তাদেরকে বিকল্প চিন্তা করতে হবে।
কিন্তু এটা যখন তিনি আমাকে বলছিলেন, তখন তিনি কাদছিলেন। বাংলাদেশে কয়েক বছর কাজ করেই এই দেশের প্রতি তার অসম্ভব মমতা জন্মে যায়। তৎক্ষণাৎ কিছু করতে না পারার অনুভূতি তাকে তখন চিবিয়ে খাচ্ছিল।
যাই হোক, তার বার্তা পৌঁছে দিতে শিক্ষার্থীদের ফোন নম্বর দেয়া হলো আমাকে। কিন্তু বিদেশ থেকে তখন লাইন খুবই খারাপ। আমি কারো সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। তখন আরেকটি হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বার দেয়া হয়। এই নম্বরের মালিক তিন ছাত্রের একজন নন; তিনি আলাদা নিরাপদ স্থানে আছেন, এই কারণে তার ব্রডব্যান্ড কানেকশন ছিল। আমি যেন তার মাধ্যমে বার্তা পৌঁছে দেই।
হোয়াটসঅ্যাপে যার সঙ্গে আমি যোগাযোগ করি, ওই ব্যক্তির নাম ছিল সাদিক কায়েম। তিনি আমাকে সালমান বা কিছু বলেননি। আমি তাকে তার নামও জিজ্ঞেস করিনি। একেবারে শেষ পর্যায়ে তিনি জানান, তার নাম সাদিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।
যাই হোক, আমি তাকে জানাই যে দূতাবাস বলছে তারা জায়গা দিতে পারবে না। তখন সাদিক আমাকে বলেন, ‘স্যার, তাহলে তো ওদেরকে মেরে ফেলবে। কিছু একটা করেন।’
কয়েক মুহূর্তের জন্য আমি ভুলে গেলাম আমি একজন পেশাদার সাংবাদিক। মানুষ হিসেবে ওই ছেলেদের পরিস্থিতির কথা ভেবে আমি না করতে পারিনি। তবে কোনো প্রতিশ্রুতি না দিয়ে, আমি শুধু বললাম, ‘আচ্ছা, দেখি।’ আমি ফোন দিলাম আমার বন্ধু মোহাম্মদ আলীকে। বললাম, আমাদের এক সাবেক মেসে তাদের রাখা যায় কিনা। আলী আরেকজনের বাসা ম্যানেজ করে দিলো। আমি ফোন দিলাম আরেক বন্ধু সাবহানাজ রশিদ দিয়াকে। সে ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের শিকার ব্যক্তিবিশেষের জন্য থাকা একটি আশ্রয়কেন্দ্র ম্যানেজ করে দিলো। কিন্তু তার চেয়ে ভালো অপশন এসেছে আরেক জায়গা থেকে।
আমার সঙ্গে যোগাযোগ থাকা কূটনীতিক নিজেই জানালেন তিনিও বাসা খুঁজছেন। এদের মধ্যে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় কর্মরত এক ভারতীয়র বাসা ম্যানেজ করেছেন। একই সময়ে টেক্সট আসে ডেইলি স্টারের সাবেক সহকর্মী ও সায়ের খানের কনফিডেন্ট-এর। তিনিও ঠিক একই ব্যক্তির কথা বললেন।
(ফান ফ্যাক্ট: সাহায্য এসেছে এক নাস্তিক, এক গে রাইটস ওয়ার্কার, এক খ্রিস্টান কূটনীতিক, ডেইলি স্টারের এক সাংবাদিক আর এক ভারতীয় নাগরিকের কাছ থেকে। কী বাজে পরিস্থিতি! LoL!)
অর্থাৎ একই সময়ে বিভিন্ন মানুষ এই কাজে লেগে গিয়েছিলেন। ঢাকার ট্রাই-স্টেট এরিয়া আসলেই অনেক ছোট। এরপর আমি সিদ্ধান্ত নিই যে এই আন্তর্জাতিক সংস্থার কর্তাব্যক্তির বাসাই সবচেয়ে নিরাপদ হবে। তারপর সেই ঠিকানা ও ফোন নম্বর দিলাম সাদিককে, যেহেতু তার সঙ্গেই আমি যোগাযোগ করতে পেরেছি।
এরপর চার শিক্ষার্থী সেখানে পৌঁছায়। সাদিক আমাকে কনফার্ম করে। আমি ডেইলি স্টারের সাংবাদিককে সাদিকের নম্বর দিয়ে রাখি। আমার ভূমিকা — অন্তত এই এপিসোডে — এখানেই শেষ।
এই লেখা দেখে মনে হচ্ছে না আমি কী না কী করে ফেলেছি?! আদতে আমি কিছুই করি নাই। কয়েকটা ফোন, আর কয়েকটা টেক্সট। কিছু মানুষকে আমি চিনি, আর কিছু মানুষ আমাকে চেনে। আমার কিছু সোস্যাল ক্যাপিটাল আছে; সেখান থেকে যৎসমানি খরচ হয়েছে, এই যা! আর তো কিছু না? (আমি প্রচণ্ড বিব্রত এই কথাগুলো লিখছি; প্রথম আমি ইঙ্গিত দিতে বাধ্য হয়েছিলাম সাদিক ও শিবিরের মিসলিডিং এসর্শনের কারণে; আর এবার আরেক পোস্টের প্রেক্ষিতে।)
যাই হোক, আমার এই সামান্য রোল এমন লম্বা করে লেখার কারণে মনে হচ্ছে গোয়েন্দা গল্প লিখে ফেলেছি। এটাকে আরও নাটকীয় করে উপস্থাপনের সুযোগ আমার ছিল। আমি বিরত থেকেছি।
আমি এই কারণে এত লম্বা ঘটনার অবতারণা করলাম যে সবাই যখন নিজের ভিন্টেজ পয়েন্ট থেকে একটা ঘটনাকে দেখেন, তখন মনে হয় তিনিই কী না কী করে ফেলেছেন। সাদিকের মনে হচ্ছে, সে আন্দোলনের “নেতৃত্ব” দিয়েছে — আমাকে কয়েকদিন আগে ফোন করে সে এই কথাই বলেছে। শফিকুল ভাইয়ের মনে হয়েছে যে, মাস্টারমাইন্ড হলো মাহফুজ। আবার চার শিক্ষার্থীর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি আছে। তারা নিজের কলিজা হাতে নিয়ে ঢাকার এই পাশ থেকে ওই পাশ গিয়েছে। ভয়ঙ্কর চাপে ছিল — “এক দফা”র ঘোষণা দিতে বিভিন্ন পক্ষ থেকে তাদের হত্যার হুমকিও দেয়া হয়েছিল। বিএনপি, জামায়াত সহ সবার ভেস্টেড ইন্টারেস্ট ছিল যেন তারা এক দফার ঘোষণা দেয়। আমি একশভাগ নিশ্চিত, শুধু হান্নান নয়, কাদের নয়; একই রকম চাপে কমবেশি নাহিদও পড়েছিলেন। কিন্তু শেষ জাজমেন্ট কলটা তারাই দিয়েছেন। এবং ইট ওয়ার্কড, খাপে খাপ!
একদিন আগে বা পরে এক দফার কল দিলে সেটা হয়তো সফল হতো না, কিংবা হতো — আমরা জানি না। শেষ পর্যন্ত নাহিদদের টাইমিংটাই সফল হয়েছে, এটাই সত্য। কাউন্টার ফ্যাকচুয়াল সফল হতো কি হতো না, সেটা অন্তর্যামী জানেন। আমরা শুধু জানি, জো জিতা ও হি সিকান্দার।
আন্দোলনের পেছনে অনেক ব্যক্তির অনেক ভূমিকা থাকে। আমার মতো আরামে বসে শ্যাডো হিসেবে অনেকেই ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু যেই লোকের মুখ থেকে ঘোষণা আসে, তারাই জানে কত ধানে কত চাল। আপনি মানেন আর না মানেন: কাদের, হান্নান আর মাহীনদের মতো দৃঢ়তা, সাহস আর একাগ্রতা এই ঢাকার বুকে কোনো বাপের ব্যাটা আর বেটির ওই মুহূর্তে ছিল না। দে হ্যাড দ্যা মোস্ট টু লুজ। কারণ দেয়ার ফেইস ওয়াজ অন দ্যা ওয়্যাল। এভরিথিং এলস ওয়্যাজ সেকেন্ডারি।
যারা নিজের ঘরে আশ্রয় দিয়েছেন, তারা ঝুঁকি নিয়েছেন। লেনিনের মতো যারা নিজে স্বশরীরে তাদের এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিয়ে গেছেন, তারা ঝুঁকি নিয়েছেন। যারা টেক্সট আর কল করে, নিজের সোশ্যাল ক্যাপিটাল খরচ করে পরিচিতজনদের বাসা জোগাড় করে দিয়েছেন, তারাও ঝুঁকি নিয়েছেন। কিন্তু কোনো ঝুঁকিই এই কয়েকটা ছেলের ঝুঁকির চেয়ে বেশি নয়।
এই ছেলেগুলোর বাইরে আপনি যদি নিজেকে আর নিজের স্বার্থকে সরিয়ে এই পুরো ঘটনাপ্রবাহের দিকে তাকান, তাহলে আপনি দেখবেন যে আপনি একটা গ্র্যান্ড স্কিম অব থিংস—এর ছোট্ট একটা অংশ মাত্র। একটা বিরাট বড় চেইনের একটা লিঙ্ক মাত্র। জুলাই আন্দোলন এতো বিশাল আর সর্বব্যাপী ছিল যে কোন চেইন থেকে কোন ঘটনা ঘটেছে, সেটা এক দুইজন ব্যক্তির নিজের ইগো-কেন্দ্রিক বর্ণনা থেকে বোঝা যাবে না। এটার জন্য কমপক্ষে ৫০০টা সাক্ষাৎকার নিতে হবে। এরপর এটার একটা স্কেলেটন দাঁড়াবে। দুঃখজনক হচ্ছে সেটা বোধ হয় কখনোই হবে না। ইতিহাস কথনের প্রিম্যাচিউর ইজাকুলেশন হয়ে গেলে ক্ষতি ইতিহাসেরই।