
অবশেষে সকল জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে তবলিগ জামাতের আলোচিত সাদ অনুসারীদের বিশ্ব ইজতেমা আজ শুক্রবার সকাল থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক প্রস্তুতিতে টঙ্গী তুরাগ নদীর তীরে শুরু হয়েছে। ৩১ জানুয়ারি থেকে শুরায়ে নেজামের দুই ধাপে ৬ দিনব্যাপী ইজতেমা শেষে সাদপন্থীদের বিশ্ব ইজতেমা শুরু হলো আজ থেকে। রোববার আখেরি মোনাজাতের মাধ্যমে শেষ হবে এ বছরের ৫৮তম বিশ্ব ইজতেমা।
সাদপন্থীদের অন্যতম মিডিয়া সমন্বায়ক মোহাম্মদ সায়েম জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা কোন শর্তের আবদ্ধে বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠান করছি না।
অপরদিকে শুরায়ে নেজামের মিডিয়া সমন্বায়ক হাবিবুল্লাহ রায়হান জনকণ্ঠকে বলেছেন, সাদপন্হীরা ইজতেমা ময়দানে আর কোনোদিন ইজতেমা করতে পারবে না এমন শর্ত জারি আছে।
আয়োজকদের পক্ষে শীর্ষ মুরুব্বী ডক্টর রেজাউল করিম বলেন, আপাতত কোনো শর্ত নিয়ে ভাবছি না। আগে সুষ্ঠুভাবে ইজতেমা সম্পন্ন করি, ভবিষ্যতে আমরা সাদ অনুসারীরা বিশ্ব ইজতেমা করতে পারবো কি পারবো না, ভবিষ্যতেরটা ভবিষ্যতে আল্লাহ পাকই ফয়সালা করবেন!
তাবলীগ জামাতের শীর্ষ মুরুব্বিরা জনকণ্ঠকে বলেছেন, বিশ্ব ইজতেমার ইতিহাসে এবারই প্রথম শবে বরাতের পুণ্যময় রজনীতে শুক্রবার দিন বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। ইজতেমা শুরুর দিন বিশ্ব ইজতেমার প্রথম রজনী শবেবরাত হওয়ায় মুসল্লীদের মাঝে বাড়তি আগ্রহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তাই এবারের ইজতেমা আরও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক হতে যাচ্ছে।
এ বিষয়ে জামিয়া কাশিফুল উলুম ঢাকার মহাপরিচালক বিশিষ্ট আলেমেদ্বীন ও গবেষক মাওলানা সৈয়দ আনোয়ার আবদুল্লাহ বলেন, এমন পবিত্র ও বরকতময় মর্যাদাপূর্ণ রাতে বিশ্ব ইজতেমার মতো বৃহৎ ইসলামী জমায়েতের আয়োজন নিঃসন্দেহে এক অনন্য ও ঐতিহাসিক ঘটনা
আজ শুক্রবার ইজতেমা ময়দানে উপমহাদেশের বৃহত্তম জুমার নামাজ অনুষ্ঠিত হবে। জুমার নামাজে লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসল্লি অংশগ্রহণ করবেন বলে আশা করছেন আয়োজকরা। ঢাকার জিরো পয়েন্ট থেকে ২২ কিলোমিটার উত্তরে টঙ্গীর তুরাগ নদীর পূর্ব তীরে ঢাকা ময়মনসিংহ মহাসড়ক সংলগ্নে আয়োজন এই বিশ্ব ইজতেমার।
বৃহস্পতিবার বাদ মাগরিব বয়ান করেছেন ভারতের মাওলানা ইয়াকুব সিলানী, তরজমায় ছিলেন মাওলানা মনির বিন ইউসুফ সাহেব। আজ শুক্রবার বাদ ফজর বয়ান করেন ভারতের মাওলানা আব্দুস সাত্তার সাহেব।
এদিকে সাদপন্থীদের বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে গাজীপুর মহানগর পুলিশ কমিশনার ডক্টর নাজমুল করিম খান টঙ্গী ইজতেমা ময়দানে এক প্রেসব্রিফিংয়ে বলেছেন, দেশের বহু সন্ত্রাসী গ্রেপ্তার এড়াতে তাবলীগ জামাত ব্যবহার করতে পারে! দেশের নানা প্রান্ত থেকে এসে এরা ইজতেমায় ভর করছে, তিনি এসব ডেভিলদের ধরিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন ইজতেমার মুরুব্বিদের কাছে। ইজতেমা ময়দানে অপরিচিত কোন লোকের সন্ধান পেলে তা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অবহিত করারও অনুরোধ করেন তিনি।
বৃহস্পতিবার দুপুরে টঙ্গী বিশ্ব ইজতেমা ময়দানের কেন্দ্রীয় পুলিশ কন্ট্রোল রুমে আয়োজিত সাদপন্থীদের বিশ্ব ইজতেমা শুরুর আগের দিন সাংবাদিকদের প্রেসব্রিফিংকালে এসব কথা বলেন গাজীপুর পুলিশ কমিশনার।
তিনি আরো বলেন, শুক্রবার থেকে শুরু হওয়া সাদ অনুসারীদের বিশ্ব ইজতেমাও শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হবে।
৫ টি সেক্টরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা সাজানো হয়েছে। ইজতেমা ময়দানের ভেতর বাহির এবং চতুর্দিকে ৭ হাজার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বয়ে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলা হয়েছে। সারাদেশে ডেভিল হান্ট অপারেশন চলমান থাকায় অনেক ডেভিলও ইজতেমা ময়দানে লুকিয়ে থাকতে পারে। সেসব ডেভিল থেকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানানো হয় প্রেসব্রিফিংয়ে।
পুলিশ কমিশনার আরো বলেন, আখেরি মোনাজাতের দিনও রাস্তায় গাড়ি চলাচল বন্ধ হবে না। গাড়ি চলতেই থাকবে। পাশাপাশি রাস্তায় কোন লোক দাঁড়াবে না, চলতেই থাকবে। রাস্তার আশেপাশে কোনো হকারও বসবে না।
টঙ্গীতে বিশ্ব ইজতেমার শুরায়ে নেজামের প্রথম পর্বের আয়োজন শেষে সাদপন্থীদের বিশ্ব ইজতেমা আয়োজন উপলক্ষ্যে মেট্রোপলিটন পুলিশের পুলিশ কমিশনার ডক্টর মোহাম্মদ নাজমুল করিম খান বলেন, সাদ অনুসারীদের বিশ্ব ইজতেমা শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠানে আগের মতো সকল প্রস্তুতি অব্যাহত থাকবে।
কড়া নিরাপত্তায় যেকোনো বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি এড়াতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী আগের চাইতে আরো বেশি সজাগ ও সতর্ক থাকবে। বিশ্ব ইজতেমার পক্ষ থেকে তাবলিগের কাজে নিয়োজিত প্রায় দশ হাজার স্বেচ্ছাসেবী পুলিশের সাথে থেকে আইনশৃঙ্খলার দায়িত্ব পালন করবে।
তিনি আরো বলেন, আপাত দৃষ্টিতে দেখা না গেলেও ইজতেমা ময়দানে মুসল্লী বেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা মাঠের ভেতরে সাদা পোষাকে কাজ করছে। বিশ্ব ইজতেমা চলাকালে ময়দানে ক্যামেরা ড্রোন উড়াতে গেলে পুলিশ কমিশনারের অনুমতি নিতে হবে। অন্য কোন সংস্থা যেন ইজতেমা ময়দানে ড্রোন উড়াতে না পারে এবং সাবোটেজ বন্ধে ড্রোন উড়ানোয় পুলিশের পক্ষ থেকে এমন নির্দেশনা এখনও বলবৎ আছে।
ডেভিল হান্ট অভিযান চলমান জানিয়ে তিনি বলেন, কোন দুষ্কৃতকারী যদি ইজতেমায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চায়, কোনো ডেভিল যদি পান তাহলে ধরিয়ে দিবেন। সাদপন্থীদের পক্ষে শীর্ষ মুরুব্বী ডক্টর রেজাউল করিম, রেজা আরিফ, সফিকুর রহমান, হাজী মনির ও মিডিয়া সমন্বয়কারী মোহাম্মদ সায়েম এসময় উপস্থিত ছিলেন।
আয়োজকদের পক্ষে শীর্ষ মুরুব্বী ডক্টর রেজাউল করিম বলেন, সুন্দরভাবে ইজতেমা করতে দেওয়ায় সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সবাইকে ধন্যবাদ জানাই।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আপাতত কোনো শর্ত নিয়ে ভাবছি না। সুষ্ঠুভাবে ইজতেমা সম্পন্ন করতে তিনি সকলের প্রতি আহ্বান জানান।
উল্লেখ্য, ৩১ জানুয়ারি থেকে ৫ ফেব্রুয়ারি দুই ধাপে টানা ৬ দিন শুরায়ে নেজামের (জুবায়েরপন্থি) ইজতেমা সম্পন্ন হয়। এখন বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্বে মাওলানা সাদ অনুসারী মুসল্লিরা অংশ নিচ্ছেন। বৃহস্পতিবার বাদ আসর থেকে ইজতেমায় বয়ান শুরু হয়েছে। আজ শুক্রবার বাদ ফজর আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছে সাদপন্থীদের তিন দিন ব্যাপী বিশ্ব ইজতেমা। ১৬ ফেব্রুয়ারি রোববার আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে দ্বিতীয় পর্ব তথা বিশ্ব ইজতেমার ৫৮তম আসর।
বিশ্ব ইজতেমা মাঠে শূরায়ে নেজাম, সাদপন্থিদের জোড় ইজতেমা করতে না দেওয়ার ঘোষণায় গত ১৮ ডিসেম্বর ভোররাতে হামলা ও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে ৪ মুসল্লি নিহত ও শতাধিক আহতের ঘটনায় সাধারণ মুসল্লিদের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করলেও সব ভয় আতঙ্ক দূর করে দলে দলে সাদ অনুসারী মুসল্লিরা ইজতেমা ময়দানে ছুটে আসছেন।
সরকার এবং ইজতেমার বিবদমান দু’গ্রুপের সমন্বয়ে ইজতেমার তারিখ নির্ধারণ করা হলেও ইজতেমা মাঠে হামলা গন্ডগোলে দুপক্ষের মধ্যে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। শূরায়ে নেজামের কথা হচ্ছে গন্ডগোল করে সাদপন্থীরা টঙ্গী ইজতেমা ময়দানে বিশ্ব ইজতেমা করার নৈতিক অধিকার হারিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ইজতেমা ময়দানে সাদপন্থিদের বিশ্ব ইজতেমা করতে না দেওয়ার ঘোষণা দেয় শূরায়ে নেজাম। এমনকি এবছরের পর আর কোনদিন টঙ্গী ইজতেমা ময়দানে সাদপন্হীরা আর বিশ্ব ইজতেমা করতে পারবে না এমন শর্তের কথাও উল্লেখ করে শুরায়ে নেজাম। সরকারের হস্তক্ষেপে ১৪, ১৫ ও ১৬ ফেব্রুয়ারি সাদপন্থীদের ইজতেমা অনুষ্ঠান করার তারিখ নির্ধারণ হলে স্বস্তি নেমে আসে সাদপন্হীদের মাঝে।
শুক্রবার বাদ ফজর ইজতেমা ময়দান সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, সাদপন্থী তবলিগ অনুসারী মুসল্লিরা দলে দলে জামাতবদ্ধ হয়ে দেশের নানা স্থান থেকে ইজতেমা ময়দানে আসছেন। জামাতবন্দি মুসল্লিরা মাঠের নানা জায়গায় প্যান্ডেলের নিচে অবস্থান নিচ্ছেন। নিজের জানমাল খরচ করে তবলিগ অনুসারী মুসল্লিরা ইজতেমা করে থাকেন। তাবলিগের ৬ উছুল নিয়ে বৃহস্পতিবার মাগরিবের পর থেকে বয়ান শুরু হয়েছে। বিরতিহীনভব্বা রোববার আখেরি মোনাজাতের পূর্ব পর্যন্ত বয়ান চলবে।
শবেবরাতের ফজিলতের রাতের কারণে এবারের বিশ্ব ইজতেমা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও আধ্যাত্মিক বরকতে ভরপুর হবে। এ রাতে মুসলীম উম্মাহর জন্য লাখ লাখ মানুষ আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করবেন এই ময়দানে সমবেত হয়ে।শবেবরাত ইসলামের বরকতময় রাতগুলোর মধ্যে অন্যতম, যেখানে বান্দাবান্দিদের জন্য আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে বিশেষ রহমত ও মাগফিরাতের দরজা উন্মুক্ত হয়। গুনাহ মাফ হয় ভাগ্যের পরিবর্তন হয়। হাদিস শরিফে শবেবরাতের রাতকে গুনাহ থেকে মুক্তি, তাকদির নির্ধারণ এবং দোয়া কবুলের রাত হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। বান্দার এক বছরে ভাগ্য নির্ধারণ করা হয় শবেবরাতের রজনীতে। বান্দার গুনাহ মাফ ও আশাও পূর্ণ করা হয়।
এই রাত মুসলমানদের কাছে বিশেষ সম্মান ও মর্যাদার। সেই সাথে বিশ্ব ইজতেমায় রাতে ইমান আমলের বয়ান শুনে মুসলমানরা নিজেদেরকে আরো পূত-পবিত্র করে তুলবেন। সাদপন্থীদের মিডিয়া মুখপত্র মোহাম্মদ সায়েম জনকণ্ঠকে বলেন, শবে বরাতের রাতে মুসল্লীরা দেশ জাতি ও মুসলিম উম্মাহর শান্তি কল্যাণ কামনা করে বিশেষ দোয়ার আয়োজন থাকছে এবারের বিশ্ব ইজতেমায়। সবকিছু মিলিয়ে সাদপন্থীদের এবারের বিশ্ব ইজতেমা বরকতময় আর রহমতে ভরপুর থাকায় লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ সাদপন্থী মুসল্লীরা ছুটছেন টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমা ময়দানের দিকে!