Image description
আরিফ বিন আকরাম হোসাইন  (Afjal Bin Akram Hossain)
১/আপনাদের ইতিমধ্যেই বলেছি, অনেকটা এরকম রুমে আমি আর মীর ইবরাহীম দুজন ছিলাম।এখানে আবছা আলো আর ২০১৯ এর জুন মাসের প্রচন্ড গরমে টিকতে না পেরে আমরা ফ্যানের বাতাস চাইতাম।
আমাদের যিনি খাবার দিতো, সে দরজার নিচ দিয়ে ফ্যান শুইয়ে রেখে বাতাসের ব্যাবস্থা করতো,সেই ফ্যান ছাড়লে,প্রচন্ড বিকট মাথা ধরা শব্দ হতো,আর বাতাসের গরম এতোটাই বেশি ছিলো যে,সেই বাতাসে মনে হতো আমাদের শরীরে যেন শত শত শুই ফুটিয়ে দিচ্ছে কেউ।
 
২/আমাদের রুমের ঠিক বাম পাশে ফারুক থাকতো,ফারুকের বাড়ি ছিলো কক্সবাজার, ফারুক গাজীপুরে গার্মেন্টস এ জুটের ব্যাবসা করতো।
ফারুকের ভাষ্যমতে ফারুক সেখানে কমপক্ষে ৫ বছর ধরে গুম আছে,তার ব্যাবসায়ীক পার্টনার Rab কে মাত্র এক লক্ষ টাকা কনটাক্ট দিয়ে তাকে গুম করে ফেলে।
সে যেহেতু কোন রাজনীতি করেনা তাকে উদ্ধারের জন্য কেউ হয়তো এগিয়ে আসবেনা।।
ফারুক প্রচণ্ড আতংক নিয়ে প্রায় বলতো,তার মলদ্বার দিয়ে আজ মাছ বেড় হয়েছে,আবার সাপ বেড় হয়েছে,আমরা যাতে পানি পড়া দেই।।
আমি বোঝতাম,ফারুকের হয়তো মতিভ্রম হচ্ছে, নয়তো কৃমি রোগ হয়েছে,কিন্তুু আয়নাঘরে কোন চিকিৎসা করা হয়না।তাই দাওরা হাদীসের ছাত্র ইব্রাহিম, ফারুক ভাইকে ছোট বোতলে পানি পড়া দিতো,এটা খেয়ে ফারুক খুব আত্মতৃপ্তিতে বলতো,পানি পড়া খেয়ে সে ভাল হয়ে গেছে,আমরা নিশ্চয় আল্লাহর খুব প্রিয় বান্দা, আমাদের শীঘ্রই ছেড়ে দিবে ইনশাআল্লাহ।।
 
৩/আমাদের রুমের ডান পাশে থাকতো জামাল ভাই,তার ভাষ্যমতে সে দেড় বছর ধরে সেখানে থাকছে।।তার পকেটে RAB ইয়াবা ডুকিয়ে দিয়ে এখানে তুলে আনে।
আমাদের দেখা আয়নাঘরে যাকে যে পোশাকে তুলে আনা হতো,সপ্তাহ হোক,মাস হোক কিংবা বছরের পর বছর হোক তাকে সে পোশাকেই থাকতে দেওয়া হতো।
চুল কাটা,ব্রাশ করা,ভালভাবে গোসল করা,গোপনাঙ্গ পরিষ্কার করা মাসের পর মাস, বছরের পর বছর এসবের কিছুই ঘটতো না।।
এভাবে থাকতে থাকতে ইব্রাহিমের দাত গুলো কালো হয়ে ওঠেছিলো, Saiful আর হেমায়েত ভাইয়ের শরীর সাপের খোলস পড়ার মতো ময়লা হয়ে ফেটে গিয়েছিলো!
 
৪/ওদের নির্যাতন তো আছেই,সাথে তীব্র গরম থেকে বাঁচতে জামাল,ফারুক সহো আয়নাঘরের অনেক বন্দি উলঙ্গ থাকতো।
আমি কখনও শুধু শার্ট পরতাম,কখনও শুধু প্যান্ট,নিরুপায় হয়ে পড়লে বাধ্য হয়ে কখনও অন্তর্বাস পড়ে কম্বলে জড়িয়ে থাকতাম।।
মাস্ক পড়ে টর্চ লাইট দিয়ে আমাদের উলঙ্গ শরীর দেখতে আসা RAB কর্মকর্তারা হয়তো পৈচাশিক আনন্দই পেতো।
আমাদের টর্চ লাগতো না,অন্ধকারে থাকতে থাকতে সবাই বেশ ভালই দেখতাম,বরং আমাদের চোখে আলো সহ্যই হতোনা।
 
৫ বছর চুল দাড়ি না কাটা ফারুক দেখতে কতটা ভয়াবহ হতে পারে তা নিয়ে আমার বেশ কৌতুহল ছিলো।কিন্তু আমাদের যখন টর্চার/জিজ্ঞাসাবাধে নিয়ে যেতো,তখন কয়েকজন এসে এই রুমে থাকতেই পিছনে হাত নিয়ে হ্যান্ডকাফ পড়িয়ে চোখ বেধে নিয়ে যেতো।
তাই টর্চারসেলে নেওয়ার সময় ফারুক আমাকে দেখলেও আমার আর দেখা হয়নি।।
 
ফারুক ভাই,আমাদের কাছে তার পরিবারের নম্বার মুখস্থ বলে অনুরোধ করেছিলো, আমরা যাতে সুযোগ পেলে তার বউকে জানাই "ফারুক তার তিন সন্তান আর বউকে অনেক ভালবাসে,বউ যাতে ফারুককে তালাক না দেয়"।
দেড় বছরের জামাল, মাইরের চোটে সব ভূলে যাওয়াতে আমাদের কোন নম্বার দিতে পারেনি।
।পরবর্তীতে একই রকম টর্চারে আমরাও ফারুকের দেওয়া নম্বার মনে রাখতে পারিনি।
যখন বিদুৎ চলে যেতো,তখনি কেবল আমরা কথা বলার সুযোগ পেতাম,বিদ্যুৎ আসলেই ফ্যানের গরম বাতাস আর বিকট শব্দে বেঁচে থাকাটাই দ্বায় হয়ে দাড়াতো..
 
৫/আপনি যদি প্রশ্ন করেন আয়না ঘরের সব থেকে বেশি নির্যাতন কিভাবে করা হয়।
আমরা বলবো,আয়নাঘরের অবস্থান করা প্রতিটা মুহুর্ত এতো বড় নির্যাতন যে মুক্তজীবন দিয়ে এর তূলনায় করা যায়না।।
সেখানে অসুস্থ হলে কোন ডাক্তার বা চিকিৎসা দেওয়া হয়না,আমি প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে পড়লে ইব্রাহিম অনেক বলে কয়ে দুটো প্যারাসিটামল নিয়েছিলো সেটাও ছিলো মেয়াদোত্তীর্ণ।।
একটা ভেজা গামছা মুখের উপর দিয়ে তারা অল্প অল্প করে পানি ডালতো,আমরা শ্বাস নিতে গেলেই দম বন্ধ হয়ে মনে হতো মৃত্যুর কাছাকাছি চলে যেতাম,পিছনে হাত মুড়ে বেধে লাঠি দিয়ে দুজন করে সে হাতের উপর দাড়িয়ে যেতো,উপুর করে ফেলে পায়ের উপর ডান্ডা দিয়ে দুজন দাড়িয়ে যেতো,তাদের মনমতো উত্তর না হলেই চুল টেনে এলোপাতাড়ি চড় মাড়তো,এতো নির্যাতনেও তারা মজা না পেলে তলপেটে আর অন্ডকোষে লাথি মারতো এভাবে চলতো যতদিন ভিক্টিম তাদের মনমতো না হয়ে ওঠে...
 
৬/
আয়নাঘরের সমাপ্তি ঘটতো মূলত ৩ ভাবে;
এক:এরকম অমানবিক নির্যাতন থেকে বাঁচতে আয়নাঘরে বন্দি ভিক্টিম যেকোন শর্তে রাজি ছিলো,সেই সুযোগে তাদের থেকে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি নিয়ে তাদের মনমতো স্কীপ্ট সাজিয়ে মামলা দিয়ে নতুন করে গ্রেফতার দেখাতো।এরফলে ভিক্টিম সরাসরি কারাগারের সেলে চলে যাওয়াতে গণমাধ্যম বা মিডিয়াতে কোন মন্তব্য করতে পারতোনা,সহসা তাদের জngi ও মাদক মামলা দেওয়াতে তাদের অপরাধকেও অনেক বড় করে দেখানো হতো।
 
হেমায়েত আর ইব্রাহিমকে সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালের একটা কাউন্টারে সিভিলে RAB এভাবেই একটা কালো ব্যাগ দিয়ে রেখে আসে,১০ সেকেন্ড না যেতেই সেখানে পোশাকধারী RAB এসে তাদের নাটক সাজিয়ে গ্রেফতার দেখায়,পাবলিক কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাদের স্বাক্ষর নিয়ে সাক্ষী বানিয়ে, তাদের মনগড়া মামলা সাজায়।
 
দুই:ঐ যে বললাম, চুল দাড়ি কাটার কোন সুযোগ মাসের পর মাস আয়নাঘরে থাকতো না।এর ফলে গ্রেফতার দেখানো বা ক্রসফায়ারে দেওয়ার আগে তাদের চুল দাড়ি সাইজ করে দেওয়া হতো,এর ফলে একদিকে মনে হতো তারা বুঝি মুক্তই ছিলো,নইলে চুল কাটতো কিভাবে.?!আবার বড় চুল দাড়ির কারণে প্রফেশনাল মাদক ব্যাবসায়ী বা জngi হিসেবে মিডিয়াকে সহজে বিশ্বাস করানো যেতো...
 
তিন;অনেকের শেষ পরিণতি হতো ব্যারিষ্টার আরমান,জেনারেল আযমীদের মতো, মানে কোনদিনই আর আয়নাঘর থেকে বের হতে পারবেনা।।
এই ক্যাটাগরিতে ইলিয়াস আলী,সাজেদুল, শিবির নেতা ওয়ালিউল্লাহ,মোকাদ্দাস ও আমাদের সাথের ফারুক ও জামাল ভাইয়েরা পড়ে।
 
এই ক্যাটাগরির লোকেরা বেঁচে আছে না মরে গেছে তারা দ্বায় শিকার না করলে আপনি নির্দিষ্ট করে বলতেও পারবেন না।
 
৭/আমি এতোক্ষন যা লিখলাম খুব দায়িত্ব নিয়ে আমরা এর সত্যতা প্রমান করতে পারবো।গতকাল থেকে আয়নাঘরের অনেক ভিক্টিম আমাদের মতো লিখছে,উনাদের মাঝে যারা মোহাম্মদপুর, বসিলা Rab ক্যাম্পে ছিলো তারা আশা করি আমাদের দেওয়া বিবরণে একমত হবেন।
এর প্রতিটা বাক্যের সত্যতা নিশ্চিতে ২০১৯ এর জুন জুলাইতে মোহাম্মদপুর, বসিলা RAB ক্যাম্পে দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মধ্যস্থতায় আমাদের মুখোমুখি করুন..
গুম পরবর্তী দ্বায়েরকৃত সকল মিথ্যা,বানোয়াট মামলা প্রত্যাহার করুন,হাসিনা সহো দোষীদের গ্রেফতার করুন,এখনো নিখোঁজদের দ্রুত উদ্ধার করুন।
আমার এই লিখা,তাদের পক্ষ থেকে, যারা আয়নাঘর অমানুষিক নির্যাতনের স্বীকার হয়েও আমাদের মতো লিখতে বা বলতে জানেন না।