Image description

ক্ষমতা ধরে রাখতে পদে পদে মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ভারতে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার। আন্দোলন দমাতে অতিরিক্ত শক্তিপ্রয়োগ, বিচারবহির্ভূত হত্যা, গণগ্রেপ্তার, চিকিৎসাসেবায় বাধা, ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ, সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমের ওপর আক্রমণ, নারী ও শিশুদের লক্ষ্যবস্তু করাসহ গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে স্বৈরাচার সরকার। এসব কাজে পুলিশ ও দলীয় বাহিনীর পাশাপাশি সামরিক ও গোয়েন্দা সংস্থা ব্যবহার করা হয়েছে। সম্প্রতি জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর (ওএইচসিএইচআর)-এর তথ্যানুসন্ধান প্রতিবেদনে এ চিত্র উঠে এসেছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, আন্দোলনের শুরুর দিকে ১৫ জুলাই ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ সমর্থকরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ছাত্রদের ওপর ধারালো অস্ত্র ও লাঠি দিয়ে আক্রমণ চালান। এ সময় নারী শিক্ষার্থীদের যৌন সহিংসতার হুমকি দেওয়া এবং মারধর করা হয়। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজে চিকিৎসাধীন আহত শিক্ষার্থীদের ওপর পুনরায় হামলা চালায় ছাত্রলীগ। এর পর থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) ছাত্র-জনতার ওপর অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করে। সামরিক রাইফেল ও শটগান ব্যবহার করে নির্বিচার গুলি চালানো হয়। অনেককে সরাসরি কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করার প্রমাণ পেয়েছে জাতিসংঘ। ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত ১ হাজার ৪০০-এর বেশি মানুষ নিহত হয়, যার ১২-১৩% শিশু। বলপ্রয়োগের পাশাপাশি ১১ হাজার ৭০০-এর বেশি বিক্ষোভকারীকে আটক করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পুলিশের ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চ (ডিবি) ও ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স (ডিজিএফআই) বিক্ষোভকারীদের অপহরণ ও গোপনে আটকে রাখে। আটকদের অনেককে বৈদ্যুতিক শক, মারধর ও মানসিক নির্যাতনের মাধ্যমে জবানবন্দি দিতে বাধ্য করা হয়। অনেক শিশুও আটক ও নির্যাতনের শিকার হয়। কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের সদর দপ্তর শিশুসহ নির্বিচার আটকদের বন্দিস্থান হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল।

প্রতিবেদনে বলা হয়, আন্দোলনে আহত বিক্ষোভকারীদের অ্যাম্বুলেন্স আটকে হাসপাতালে যাওয়া বাধাগ্রস্ত করা হয়। ডিজিএফআই, এনএসআই এবং গোয়েন্দা শাখার সদস্যরা আহতদের জীবন রক্ষাকারী চিকিৎসাসেবা বাধাগ্রস্ত করেন। প্রায়ই হাসপাতালে রোগীদের জিজ্ঞাসাবাদ, আহতদের গ্রেপ্তার এবং চিকিৎসাকর্মীদের ভয়ভীতি দেখাতে থাকে। চিকিৎসকদের জিম্মি করে মেডিকেল রেকর্ড নষ্ট করে মিথ্যা রিপোর্ট তৈরিতে বাধ্য করা হয়। জাতিসংঘ জানায়, বিক্ষোভ দমন করতে কৌশলগতভাবে ইন্টারনেট এবং সমাজমাধ্যম বন্ধ করে দেয় তৎকালীন সরকার। বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন (বিটিআরসি) এবং ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি)-এর মাধ্যমে ইন্টারনেট বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়। এদিকে আন্দোলনে পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় সাংবাদিকদের ওপর আক্রমণ করা হয়। এতে অন্তত ছয়জন সাংবাদিক নিহত এবং ২০০-এর বেশি আহত হন। পাশাপাশি গোয়েন্দা সংস্থাকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে বিক্ষোভ সম্পর্কে সত্য প্রতিবেদন প্রকাশ না করার জন্য চাপ দেওয়া হয়।

সর্বশেষ ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচি শক্ত হাতে দমনে সিদ্ধান্ত নেন শেখ হাসিনা। ৪ আগস্ট বিবৃতিতে আন্দোলনকারীদের সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যায়িত করে শক্ত হাতে দমন করার আহ্বান জানান। এ ছাড়া মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচি ঠেকাতে রাজধানীর প্রবেশপথগুলোয় পুলিশের পাশাপাশি সেনাবাহিনী ও বিজিবি মোতায়েনের ঘোষণা দেন। যেখানে সেনাবাহিনী ও বিজিবি সাঁজোয়া যান ও সেনা মোতায়েন করে ঢাকার প্রবেশের পথগুলো অবরুদ্ধ করে বিক্ষোভকারীদের প্রবেশে বাধা দেবে। অন্যদিকে পুলিশ উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে নিয়ন্ত্রণ করবে। যদিও সেনাবাহিনীর অসহযোগিতার কারণে শেষ মুহূর্তে তাঁর এ পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। মানবাধিকারকর্মী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, জাতিসংঘের এ তথ্যানুসন্ধ্যান প্রতিবেদন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ প্রতিবেদনে শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী শাসনামলের গুম-খুন, নিপীড়ন-নির্যাতন, গণতন্ত্র ও বাকস্বাধীনতা হরণ, দুর্নীতি, জমি দখলসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের সব বিষয় উঠে এসেছে। জমিদার আমলের মতো আয়নাঘর তৈরি করে মানুষকে নির্যাতন করেছেন শেখ হাসিনা। এ প্রতিবেদনের মাধ্যমে সারা বিশ্ব জানল, জুলাই-আগস্টের আন্দোলনসহ ১৫ বছরে বাংলাদেশে কী ঘটেছে। সরকারের পক্ষ থেকে হাসিনার বিরুদ্ধে যদি আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করা হয় তাহলে এ প্রতিবেদন একটি দালিলিক প্রমাণ। দেশের আদালতে চলমান মামলাগুলোর ক্ষেত্রেও এটা দালিলিক প্রমাণ হিসেবে কাজ করবে। ভারতের যে মিডিয়াগুলো বাংলাদেশ নিয়ে মিথ্যা অপপ্রচার চালাচ্ছে তাদের এ প্রতিবেদন দেখার পর থেমে যাওয়া উচিত।