লেখক, কবি ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ফরহাদ মজহার বলেছেন, আমি বরাবরই গণমানুষের রাজনীতি করেছি। তাই বাম ও প্রগতিশীলের ইসলাম নির্মূল রাজনীতির বিরোধিতা করেছি। বাংলাদেশের বামপন্থি রাজনীতি ইসলাম বিদ্বেষী।
তিনি বলেন, এই ধর্ম বিদ্বেষ শ্রেণী রাজনীতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, তাই বরাবরই এর বিরোধিতা করেছি। আজ ‘মব’ কিম্বা ‘মব জাস্টিসের ভয় দেখিয়ে যেভাবে জনগণের ন্যায় সঙ্গত ক্ষোভকে দাবিয়ে দেবার চেষ্টা হচ্ছে, সেটা ঠিক নয়।
বুধবার দুপুরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে তিনি এসব কথা বলেছেন।
ওই পোস্টে তিনি বলেছেন, ইসলাম বিদ্বেষ এবং ইসলাম নির্মূল রাজনীতি বাংলাদেশে সেকুলার জাতিবাদী ফ্যাসিস্ট রাজনীতির মর্মবস্তু। এই ভুল রাজনীতির কারণে শ্রমিক, কৃষক ও মেহনতজীবী শ্রেণীর পক্ষে শক্তিশালী গণরাজনৈতিক ধারা গড়ে তোলা যায় নি। অভূতপূর্ব জুলাই গণ অভ্যুত্থানের পর শ্রেণী সচেতন রাজনীতির বিকাশ এবং নির্বাচন-সর্বস্ব লুটেরা ও মাফিয়া শ্রেণীর রাজনীতির বিরুদ্ধে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ রাখার ওপর গণ অভ্যুত্থানকেপূর্ণ বিজয়ের পথে নিয়ে যাবার সাফল্য নির্ভর করে। অথচ জনগণকে শ্রেণী ও শ্রেণী সচেতনতার জায়গা থেকে নয় – বরং ইসলাম বনাম ইসলাম নির্মুল রাজনীতির বিভাজন দণ্ড দিয়ে বিভক্ত রাখবার কায়দা দিয়ে আমরা বুঝি। এটা ঠিক নয়। এই কারণেই বাংলাদেশে বিপ্লবী রাজনৈতিক ধারা বিকশিত হতে পারে নি। =
ফরহাদ মজহার বলেন, ‘তোহিদী জনতা’ হিসাবে নিজের পরিচয় দিতে অনেককে খুব শরমিন্দা ও অপরাধী মনে হচ্ছে। অন্যদিকে যারা নিজেদের বাম ও প্রগতিশীল দাবি করেন, তারা ‘তৌহিদি জনতা’র রণধ্বণিকে ‘মব’ ও সন্ত্রাস গণ্য করেন এবং আইনের শাসনের নামে মূর্ছা যান।
অতীতের জব জাস্টিসের সংস্কৃতির কথা বলতে গিয়ে ফরহাদ মজহার বলেন, মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ও নির্যাতিত স্বজনদের উদ্যোগে এবং জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’ গঠিত হয়। সেই সংগঠন ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ ঢাকায় গণআদালত (People’s Tribunal) আয়োজন করে। সেটা ছিল বিদ্যমান সংবিধান, আইন ও আদালতের বাইরে এবং রাষ্ট্রের বিপরীতে ‘মব জাস্টিস’-এর বিশুদ্ধ নমুনা।
‘ইনসাফ হবে যদি গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য তোহিদী জনতাও ‘গণ আদালত’ কায়েম করে। কিন্তু তারা সেটা করে নি। শুধু একুশের বই মেলায় গণ অভ্যুত্থান বিরোধী একজন লেখিকার বই প্রত্যাহারের দাবি করেছে। তাতেই তৌহিদী জনতাকে ‘মব’ ডাকা এবং মব জাস্টিসের ভীতি দেখানো শুরু হয়ে গিয়েছে। ভাল।’
তিনি বলছেন, এরই প্রতিক্রিয়ায় সেকুলার জাতিবাদী ফ্যাসিস্ট ধারার বিপরীতে বাংলাদেশে ধর্মীয় জাতিবাদী ফ্যাসিস্ট রাজনীতির উত্থান ঘটেছে। ধর্মীয় জাতিবাদ এবং পরিচয় সর্বস্ব রাজনীতির আড়াল ইসলামের ইহলৌকিক, মানবিক এবং সার্বজনীন মর্ম ও আবেদন মুখ থুবড়ে পড়ছে বার বার। বিপজ্জনক আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ভূরাজনৈতিকবা বাস্তবতায় আমাদের রণনীতি ও রণকৌশলের নির্ণয় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। কার্যকর ভাষা আমরা তৈরি করতে পারি নি।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’র গণআদালত ইসলাম নির্মূল রাজনীতি ও ‘মব জাস্টিস’-এর বিশুদ্ধ নমুনা আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’র গণআদালত ইসলাম নির্মূল রাজনীতি একইসঙ্গে ছিল দিল্লির আগ্রাসন ও হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির তাবেদারি। আজকাল যারা কথায় কথায় ‘মব’ এবং ‘মব জাস্টিস’-এর কথা বলছেন তারা পুরোনো ইতিহাস মনে রাখবেন, প্লিজ। বাম ও প্রগতশীলরা নিজেদের ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি’ দাবি করে আইন বা সংবিধানের তোয়াক্কা করে নি। চিরকাল ‘মব জাস্টিস’ করে গিয়েছে। এখন তৌহিদী জনতা বর্গটির বিরুদ্ধে তাদের আক্রোশ চরম বিনোদনের জন্ম দিয়েছে।
তসলিমা নাসরিনের বিষয়ে বলতে গিয়ে ফরহাদ মজহার বলেন, তসলিমা নাসরিন স্রেফ একজন লেখক নন, তিনি ঘোষণা দিয়েই জুলাই গণ অভ্যুত্থানের বিরোধী। তাকে বাংলাদেশের জনগণ দিল্লির আগ্রাসী স্বার্থ এবং হিন্দুত্ববাদের প্রপাগান্ডিস্ট হিসাবেই গণ্য করে। জুলাই গণ অভ্যুত্থানের পর দিল্লির আগ্রাসন ও হিন্দুত্ববাদের একজন রাজনৈতিক প্রপাগান্ডিস্টকে ‘লেখকের স্বাধীনতা’র আড়ালে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা করবার তৎপরতা বিচার সাহিত্য নয়, রাজনৈতিভাবেই করতে হবে।
তিনি বলছেন, আবার দেখুন, খোদ একুশের বই মেলাতেই লেখকের স্বাধীনতার নামে হিন্দুত্ববাদী দিল্লির আগ্রাসি সাংস্কৃতিক রাজনীতি প্রতিষ্ঠিত করবার চেষ্টা কেন? কারা এটা করছে? কেন করছে? স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেই এর জবাবা দিতে হবে।
‘এটা কি শুধু লেখকের স্বাধীনতার মামলা? না। লেখকের স্বাধীনতার নামে হিন্দুত্ববাদী দিল্লির আগ্রাসি সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক প্রচার প্রচারনার কৌশল। এর বিপরীতেই ‘তৌহিদী জনতা’-র প্রতিরোধ এবং তাদের রণধ্বনি । এই রণধ্বনি সকল প্রকার গোলামির বিরুদ্ধে জুলাই গণ অভ্যুত্থানের স্পিরিট রক্ষার শ্লোগান হিসাবে হাজির হয়েছে। উপদেষ্টা সরকারকে বুঝতে হবে এর পেছনে জনগণের শ্লোগান আছে।’
একুশের বই মেলায় ঘটে যাওয়া বিষয় নিয়ে তিনি বলেন, খেয়াল করুন, যখন একের পর এক মাজার ভাঙা চলছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তার কোন বিহিত করে নি। এখন তসলিমা নাসরিনের বইতের স্টলে জনগণ প্রতিবাস করায় তাদের বিরুদ্ধে অপারেশান ডেভিল হান্ট লেলিয়ে দেবার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। একুশের বই মেলায় ‘তৌহিদী জনতা’র ক্ষোভ-বিক্ষোভ ন্যায় সঙ্গত। যারা সহ্য করতে পারছেন না, তারা তৌহিদী জনতাকে ‘মব’ বলে নিন্দা করতে কুন্ঠিত হচ্ছেন না।
ফরহাদ মজহার বলেন, ভুলে যাবেন না, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সৃষ্ট ক্ষত শুকাবার আগে রাজাকারের ফাঁসি ফাঁসি ফাঁসি চাই হুংকারে বাংলাদেশের আকাশ বাতাস বাম ও প্রগতিশীলরা জাতিবাদী বামগালিদের কন্ঠে কন্ঠ মিলিয়ে বাংলাদেশ প্রকম্পিত করেছিল। আমি কে তুমি কে বাঙালি বাঙালি’ বলে উচ্চ বর্ণের হিন্দুর তৈরি বাঙালি পরিচয়কেই তারা একমাত্র পরিচয় দাবি করেছে। তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক প্রকল্প হচ্ছে ইসলাম নির্মূল। নির্মূলের রাজনীতিই বাঙালি জাতিবাদী ফ্যাসিবাদ, ফ্যাসিস্ট শক্তি ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার ভিত্তি। তোহিদী জনতার তকবিরে তাই অনেকের হৃদকম্পন শুরু হয়। তৌহিদী জনতা নিকৃষ্ট জাতিবাদী ও ফ্যাসিস্ট রাজনীতির বিপরীতেই গড়ে উঠেছে।
সবশেষ তিনি বলেন, ‘নিজেদের বদলান, অন্যেরাও বদলে যাবে। বাংলাদেশও বদলে যাবে।’