Image description

মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার কুদ্দুস বেপারী (৩২) লিবিয়ায় গিয়ে এখন নিখোঁজ। চার মাস আগে অবৈধভাবে ইতালি যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে দালালকে লিখে দিয়েছেন দুই বিঘা জমি। স্বামী আর জমি হারিয়ে এখন নিঃস্ব কুদ্দুসের স্ত্রী। অসহায় হয়ে পড়েছে কুদ্দুসের একমাত্র সন্তান। বাংলাদেশ থেকে লিবিয়ায় গিয়ে বন্দি থাকেন এক জায়গায়, যাকে দালালদের ভাষায় বলা হয় ‘গেম ঘর’। সম্প্রতি লিবিয়ায় নৌকাডুবির ঘটনার পর থেকে কুদ্দুস বেপারী নিখোঁজ। ওই ঘটনার পর থেকে পরিবারের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই তাঁর। কুদ্দুস জীবিত নাকি মৃত, কিছুই জানে না কেউ। তিনি বাংলাদেশে ছিলেন মোবাইল মেকানিক।

কুদ্দুস বেপারীর স্ত্রী দিনা আক্তার বলেন, ‘তিন বছর আগে আমাদের বিয়ে হয়। আমাদের সংসারে আট মাস বয়সের একটি ছেলে আছে। হঠাৎ দালাল মনির শেখের প্রলোভনে পড়ে প্রায় ৬০ লাখ টাকা দামের জমি গোপনে লিখে দেয় আমার স্বামী। আমরা কিছুই জানতাম না। বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় আমার স্বামী জানায় মনির দালালের মাধ্যমে লিবিয়া হয়ে ইতালি যাচ্ছে। চার মাস লিবিয়ায় ছিল। তখন তার সঙ্গে কথা হয়েছে। কিন্তু গত প্রায় ১৪ দিন কোনো কথা হয় না। তার কোনো খোঁজও পাচ্ছি না। এদিকে দালালও পালিয়ে গেছে, তারও ফোন বন্ধ।’

দিনা আক্তার বলেন, ‘একপর্যায়ে জানতে পারি গত ২৪ জানুয়ারি নাকি লিবিয়ার বেনগাজি থেকে ৪৩ জনকে গেম ঘরে নেওয়া হয়েছে, তাদের অনেকেই মারা গেছেন। অনেকেই নিখোঁজ। সেদিন থেকে আমার স্বামীরও কোনো খোঁজ নেই। এখন আমার ছেলেকে নিয়ে আমি কীভাবে বাঁচব? দালালের কঠোর বিচার চাই।’ ইতালির জন্য ‘গেম’ দিয়ে নিখোঁজ কুদ্দুস, নিঃস্ব হয়েছে পরিবার।

মানব পাচার নিয়ে গবেষকরা বলছেন, ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে এই অনিয়মিত পথে ইউরোপে ঢোকার চেষ্টার সময় গত এক দশকে ২৫ হাজারের বেশি অভিবাসনপ্রত্যাশীর মৃত্যু হয়েছে। এই পথে গড়ে প্রতি বছর অন্তত ৫০০ বাংলাদেশি মারা যান বলে ধারণা করা হয়।

জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনের (ইউএনএইচসিআর) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ১০ মাসে ২৯টি দেশের ৫৫ হাজার ৪১৩ জন ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালিতে ঢুকেছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১১ হাজার ২৩১ জন বাংলাদেশি, যা সাগর পাড়ি দিয়ে ইতালিতে ঢোকা মোট সংখ্যার ২০ দশমিক ৩ শতাংশ। ইউএনএইচসিআরের সর্বশেষ হিসাব বলছে, ২০২৩ সালে সাগর পাড়ি দিয়ে ১ লাখ ৫০ হাজার ২৭৩ জন ইতালিতে ঢুকেছেন। লিবিয়া থেকে ইতালিতে ঢোকা অভিবাসীদের মধ্যে বাংলাদেশিরা শীর্ষে। এ বছর ১২ হাজার ৩০৩ জন বাংলাদেশি লিবিয়া হয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালিতে ঢুকেছেন। ইউএনএইচসিআরের পরিসংখ্যান বলছে, ২০২১ ও ২০২২ সালে নাগরিকত্বের ভিত্তিতে সাগর পাড়ি দিয়ে ইতালিতে ঢোকার পরিসংখ্যানে বাংলাদেশ ছিল তৃতীয়। এই ২৪ মাসে ২২ হাজার ১০৫ জন বাংলাদেশি সাগর পাড়ি দিয়ে ইতালিতে গেছেন।

লিবিয়াফেরত ৫৫৭ জন বাংলাদেশির কাছ থেকে তথ্য নিয়ে গত ফেব্রুয়ারিতে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে ব্র্যাক। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, লিবিয়াফেরত এসব বাংলাদেশির ৬০ শতাংশের পরিবারকে স্থানীয় দালালরা ভালো চাকরির লোভ দেখিয়েছিল। কিন্তু ৮৯ শতাংশই চাকরি বা কোনো কাজ পাননি। উল্টো নানা ধরনের ঝুঁকিতে পড়েছেন। সব মিলিয়ে মানব পাচারের এক বিরাট বাণিজ্যকেন্দ্র এই লিবিয়া।

বিশাল অঙ্কের বাণিজ্য : মাদারীপুর শহরের কুলপদ্বি এলাকার হারুন তালুকদারের ছেলে হাবিবুল্লাহ (২৮)। তাঁকে ইউরোপের দেশ স্পেনের বিলাসী জীবনের স্বপ্ন দেখানো হয়। প্রথমে নেওয়া হয় শ্রীলঙ্কা, এরপর দুবাই তারপর মিসর। মিসর থেকে লিবিয়াতে নিয়ে চালানো হয় অমানুষিক নির্যাতন। পরিবারের কাছ থেকে দালাল বোম্বাই রিপন আদায় করেন ৩৩ লাখ টাকা। হাবিবুল্লাহ প্রায় তিন মাস নির্যাতনের পর দেশে ফিরে মামলা করেছেন।

কিন্তু সহায়সম্বল বলতে তাঁর কিছুই নেই।

তিনি বলেন, ‘আমাকে নির্যাতন করে আমার কাছ থেকে ৩৩ লক্ষ টাকা নিয়েছে। আমার সহায়সম্বল বলতে কিছু নেই। বোম্বাই রিপন মাদারীপুরের মূল দালাল। তিনি অনেক মানুষকে লিবিয়াতে নিয়ে নির্যাতন করেন। লিবিয়ার গেম ঘরে হাজার হাজার মানুষ আটক আছে। ঠিকমত খাবার দেওয়া হয় না। গোসল করার সুযোগ দেওয়া হয় ১৫-২০ দিন পরপর।’

আরেক ভুক্তভোগী শহরের কুলপদ্বি এলাকার আজাদ বলেন, ‘মাফিয়ারা গেম ঘরে হাত-পা বেঁধে নির্যাতন করে। পরে ভিডিও ধারণ করে স্বজনদের কাছে পাঠিয়ে দাবি করা হয় মোটা অঙ্কের টাকা। পরিবার বাধ্য হয় টাকা দিতে। এভাবে আমার কাছ থেকে ৩২ লক্ষ টাকা নিয়েছে। কিন্তু স্পেন যাওয়া হয়নি।’

এ রকম নির্যাতনে কতজন নিহত কিংবা প্রতারণার শিকার হয়েছে তার কোনো পরিসংখ্যান নেই পুলিশ কিংবা প্রশাসনের কাছে।