Image description

বেসরকারি চাকরিজীবী সিদ্দিকুর রহমানের অফিস রাজধানীর মতিঝিলে। কিন্তু স্ত্রী-সন্তান নিয়ে থাকেন বাড্ডার একটি ভাড়া বাসায়। প্রতিদিন অফিসে আসা-যাওয়ার পথে বাদুড়ঝোলা হয়ে গণপরিবহনে যাতায়াত করতে হয় তাকে।

অফিস থেকে এত দূরত্বে বাসা নেওয়ার কারণ জানতে চাইলে সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘বাড়তি বাসা ভাড়ার কারণেই দূরে থাকা। মতিঝিলের দিকে বাসা ভাড়া অনেক বেশি, সে তুলনায় এদিকে এসে থাকতে কিছুটা কম টাকা লাগে। তবু এখানে যে বাসা ভাড়া পরিশোধ করি তাতেই বেতনের সিংহভাগ চলে যায়। তারপরও গত বছরে ১ হাজার টাকা বাসা ভাড়া বাড়িয়েছেন বাড়ির মালিক।’

তিনি আরও বলেন, ‘ঢাকা শহরে আমরা যারা জীবিকার তাগিদে থাকি, তাদের আয়টা মনে হয় বাসা মালিকদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্যই। আমরা সাধারণ ভাড়াটিয়ারা বর্তমানে বাসা ভাড়ার বাড়তি চাপে চ্যাপ্টা হয়ে যাচ্ছি।’

সিদ্দিকুর রহমানের মতো রাজধানীর বাসিন্দাদের কাছে বাড়ি ভাড়া এখন যন্ত্রণার আরেক নাম। বছরের শেষ মাস ডিসেম্বর এলেই আতঙ্কে থাকেন ভাড়াটিয়ারা। কারণ, মৌখিক নোটিশে তাকে জানিয়ে দেওয়া হতে পারে, আগামী মাস থেকে বাসা ভাড়া বাড়বে।

নানা শ্রেণির মানুষের স্বপ্ন গড়ার শহর ঢাকা। সেজন্য দিন দিন এ নগরে মানুষ বেড়েছে জ্যামিতিক হারে। আর এসব মানুষকে বসবাস করতে অতিরিক্ত বাসা ভাড়ার চাপ নিতে হয়। বছরের পর বছর ধরে রাজধানীতে বাড়ি ভাড়ায় ‘নৈরাজ্য’ চলছে।

ভোক্তাদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২৫ বছরে রাজধানীতে বাসা ভাড়া বেড়েছে প্রায় ৪০০ শতাংশ। একই সময়ে নিত্যপণ্যের দাম যতটা বেড়েছে, সে তুলনায় বাসা ভাড়া বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। ঢাকার ২৭ শতাংশ ভাড়াটিয়া আয়ের প্রায় ৩০ শতাংশ, ৫৭ শতাংশ ভাড়াটিয়া প্রায় ৫০ শতাংশ, ১২ শতাংশ ভাড়াটিয়া আয়ের প্রায় ৭৫ শতাংশ ব্যয় করেন বাসা ভাড়া পরিশোধে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সিটি করপোরেশনগুলোয় বসবাসকারীদের মধ্যে ৭২ শতাংশই ভাড়া বাসায় থাকেন। এসব এলাকায় নিজের বাসায় থাকেন মাত্র ২৫ দশমিক ৮৫ শতাংশ মানুষ। সিটি করপোরেশনের বাইরে অন্য শহরে বসবাসকারীদের মধ্যে ভাড়ায় থাকেন ১৮ শতাংশ।

বিবিএসের তথ্যও বলছে, দেশে বাসা ভাড়া বাড়ছে অস্বাভাবিক হারে। তাদের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর সময়ে শহরে বাসা ভাড়া বেড়েছে ৫ দশমিক ৮৯ শতাংশ। দেশের মোট জনসংখ্যার ১৫ শতাংশ মানুষ ভাড়া বাসায় থাকেন। যার মধ্যে গ্রামে ৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ, শহরে ১৭ দশমিক ৯৯ শতাংশ আর সিটি করপোরেশনে ৭২ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ। আর দেশে ভাড়া ছাড়াই থাকেন ১ দশমিক ৯৬ শতাংশ মানুষ।

রাজধানীর শেওড়াপাড়া এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় থাকেন বেসরকারি চাকরিজীবী আনিসুর রহমান। তিনি বলেন, ‘আমি একটি কোম্পানিতে চাকরি করি, বেতন ৪০ হাজার টাকা। দুই সন্তান, স্ত্রীসহ দুই রুমের একটি বাসায় থাকছি। ভাড়া বাবদ মাসে ১৮ হাজার টাকা চলে যায়। ১৫ হাজার টাকা ফ্ল্যাটের ভাড়া। সেইসঙ্গে গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট, ময়লার বিল সবমিলিয়ে আরও ৩ হাজার টাকা। আমার বেতনের ৪০ হাজার টাকার মধ্যে ১৮ হাজার, বলতে গেলে প্রায় ৫০ শতাংশ বাড়িভাড়া পরিশোধেই চলে যাচ্ছে।’

আনিসুর বলেন, ‘এরপর আছে সংসারের খরচ, সন্তানদের স্কুলের খরচ, বাড়িতে বাবা-মার ওষুধের জন্য টাকা পাঠানো, আমার আসা-যাওয়ার খরচ। নিত্যপণ্যের দামও যেভাবে বেড়েছে, এতে সংসার টানাটানির মধ্যেই চলে। প্রতি মাসেই ধারদেনা করতে হয়।’

ঢাকায় বর্তমানে আড়াই কোটির বেশি মানুষের বসবাস। প্রতি বছর রাজধানীতে ৬ লাখ ১২ হাজার মানুষ নতুন করে যুক্ত হচ্ছে। এক দিনের হিসাবে ১ হাজার ৭০০ জন। পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল শহরগুলোর তালিকায় ঢাকা অন্যতম। কিন্তু আয়তন ও জনসংখ্যার হিসাবে ঢাকা সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহরের একটি। এ শহরে প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করে ৪৩ হাজার ৫০০ মানুষ।

বনশ্রী এলাকার ভাড়া বাসার বাসিন্দা রোকনুজ্জামান রোকন বলেন, ‘বছর এলেই বাসার মালিকদের ভাড়া বৃদ্ধির পাঁয়তারা চলতে থাকে। দূরে বাসা নিয়েছি সে কারণে হয়তো যাতায়াতের সমস্যা হবে, কিন্তু আয়-ব্যয়ের সঙ্গে সংগতি রাখতে এ কষ্ট মেনে নিতেই হয়।’

রাজিব চৌধুরী নামে এক বাসিন্দা বলেন, ‘বাসা ভাড়া নীতিমালা যদি থাকে বাস্তবায়ন করুন। ভাড়াটিয়াদের বাঁচান। লাগামহীন বাসা ভাড়া নগরবাসীর জন্য চাপা কষ্টের চেয়েও ভয়ংকর।’

এম এস রাতুল নামে আরেকজন বলেন, ‘এলাকাভিত্তিক স্কয়ার ফুট হিসাবে সরকারিভাবে ভাড়া নির্ধারণ করে দেওয়ার জন্য জোরালো অনুরোধ করছি।’

মধ্যবাড্ডা এলাকায় পাঁচ কাঠা জায়গার ওপর তৈরি সাততলা একটি বাড়ির মালিক রুহুল আমিন। তিনি অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা। বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধি নিয়ে কথা হয় তার সঙ্গে।

রুহুল আমিন বলেন, ‘একজন বাড়ির মালিক সারা জীবনের অর্জিত অর্থ দিয়ে, ধারদেনা, ব্যাংক লোন করে একটি বাড়ি নির্মাণ করেন। এরপর রয়েছে নানা ধরনের খরচ। অনেক বাড়ির মালিক আছে যার একমাত্র আয়ের উৎস বাড়ি ভাড়া। বর্তমানে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, জীবন পরিচালনার ব্যয় বেড়ে গেছে। বাসা ভাড়া না বাড়ালে আমরা চলব কীভাবে? যারা চাকরি করেন তাদের বেতন বাড়ে, ইনক্রিমেন্ট হয়। আর যারা ব্যবসা করেন তাদের লাভ হয়, লস হয়, অতিরিক্ত লাভও হয়। কিন্তু যারা বাড়ির মালিক তাদের তো এমন কিছু হয় না। অনেকে বছরে একবার ১ হাজার, ২ হাজার টাকা বাড়ি ভাড়া বাড়ান। এটা তো অন্যায় কিছু না। যারা চাকরি করেন তাদের তো ইনক্রিমেন্ট হয়, তাহলে আমরা যারা বাড়ির মালিক তারা কি বছরে বাড়ি ভাড়া বাড়াতে পারি না? এমন যুক্তি থেকে ভেবে দেখবেন বছরে একবার বাড়ি ভাড়া বাড়ানো অন্যায় কিছু না।’

বাসা ভাড়া বৃদ্ধির বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান কালবেলাকে বলেন, ‘লাখ লাখ মানুষের বসবাস ব্যবস্থা গড়ে তোলা ছাড়া কোনো উন্নয়ন সম্ভব নয়। রাজধানীর নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের আবাসনের ব্যবস্থা নিয়ে উদ্যোগ নেওয়া খুবই জরুরি। এজন্য এলাকাভিত্তিক ম্যাপিং করতে হবে। ওয়ার্ডভিত্তিক পরিকল্পনার মাধ্যমে আবাসন সমস্যার সমাধান করতে হবে।’

সার্বিক বিষয়ে ভাড়াটিয়া পরিষদের সভাপতি মো. বাহারানে সুলতান বাহার বলেন, ‘দিন দিন ঢাকায় বাসা ভাড়া বেড়েই চলেছে। বলতে গেলে তারা ভাড়াটিয়াদের ওপর জুলুম করে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছেন। ঢাকাসহ সারা দেশে ভাড়াটিয়ারা নিষ্পেষিত। কোনো নিয়মনীতি না মেনে বাড়ির মালিকরা যা ইচ্ছা তাই করছেন, বছরে বছরে নানা অজুহাতে বাসা ভাড়া বাড়িয়ে দিচ্ছেন। রাজধানীর লাগামহীন বাসা ভাড়া রোধে প্রয়োজন আইনের সঠিক প্রয়োগ। ভাড়াটিয়াদের সমস্যা সমাধানে সিটি করপোরেশনের মনিটরিংয়ের পাশাপাশি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে হবে।’

বাড়ছে সাবলেট: বাসা ভাড়ার বাড়তি চাপ সামলাতে পারছেন না অনেক ভাড়াটিয়া। এ কারণে তারা সাবলেটে বাসা ভাড়া নিচ্ছেন। ফলে দিনদিন বাড়ছে সাবলেট ভাড়াটিয়াদের সংখ্যা।

মালিবাগে একটি ফ্ল্যাটে পরিবারসহ থাকেন সাজ্জাদ হোসেন নামের একজন। এর জন্য প্রতি মাসে ভাড়া পরিশোধ করতে হয় ১৬ হাজার টাকা। এ ভাড়া আয়ের তুলনায় বেশি হয়ে যাওয়ায় বাড়ির মালিকের অনুমতি নিয়ে একটি সাবলেটের বিজ্ঞপ্তি টানিয়েছেন তিনি।

সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ‘১৬ হাজারের সঙ্গে অন্য চার্জ মিলিয়ে বাসা ভাড়া পরিশোধ করতেই আয়ের বড় অংশ চলে যায়। বর্তমানে এ ব্যয়ভার আরও বেড়েছে। সে কারণে বাসার মালিকের অনুমতি নিয়ে সাবলেট হিসেবে একটি ছোট পরিবারকে ভাড়া দিচ্ছি। টু-লেট টানানোর পর অনেকেই যোগাযোগ করেছেন। আমি একটি রুম ভাড়া দিচ্ছি ৭ হাজার টাকায়। এতে আমাদের থাকতে একটু সমস্যা হলেও সাবলেট ভাড়াটিয়াদের ভাড়ায় কিছুটা সাপোর্ট হবে। এ ভাবনা থেকেই ভাড়া দিচ্ছি।’

মোহাম্মদপুর এলাকার একটি বাসায় স্ত্রীসহ সাবলেট রুমে থাকেন আনিস আহমেদ নামের একজন বেসরকারি চাকরিজীবী। তিনি বলেন, ‘পুরো ফ্ল্যাট নিয়ে সেটার ভাড়া পরিশোধ করার মতো সামর্থ্য বর্তমানে আমার নেই। যে কারণে বাধ্য হয়ে সাবলেট বাসায় থাকছি। দুজনের একটি বাসায়ও বর্তমানে সবমিলিয়ে ১৫ হাজার টাকার মতো খরচ পড়ে যায়। কিন্তু আমার বেতনই ২৫ হাজার টাকা, যা দিয়ে পুরো বাসা নিয়ে থাকা সম্ভব নয়।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০০৭ সালে ঢাকা সিটি করপোরেশনের ৭৭৫টি এলাকায় ১০টি রাজস্ব আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিল্প, কাঁচাবাড়ি, পাকা ঘর, সেমি পাকা, মেইন রোডের তিনশ ফুট ভেতরে এবং বাইরে পাঁচ থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত প্রতি বর্গফুট ভাড়া নির্ধারণ করা করে দেওয়া হয়েছিল। তবে এটির প্রয়োগ কোথাও নেই। এ ছাড়া বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন-১৯৯১-এ আইনের ১৬ ধারা মতে, বড় কোনো ধরনের নির্মাণকাজ বা পরিবর্তন আনা ছাড়া বাসার মালিক দুই বছরের মধ্যে মূল ভাড়া বাড়াতে পারবেন না, যা মানেন না কেউই।

ভাড়াটিয়া-বাড়িওয়ালাদের নিয়ে বসছে ডিএনসিসি: প্রতি বছর যে যার মতো করে ভাড়া বাড়ান বাড়ির মালিকরা। এমন পরিস্থিতিতে বাড়ি ভাড়ার লাগাম টানার উদ্যোগ নিয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। ডিএনসিসি ঢাকা শহরে ভাড়াটিয়া ও বাড়িওয়ালাদের অধিকার নিয়ে প্রথমবারের মতো গোলটেবিল বৈঠক আহ্বান করেছে।

আজ বৃহস্পতিবার দুপুর দেড়টায় ঢাকার গুলশান-২-এর ডিএনসিসির প্রধান কার্যালয় নগর ভবনে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। বৈঠকে বাড়ি ভাড়া নির্ধারণের হার, বছরে বৃদ্ধির হার নিয়ে আলোচনা হবে। বৈঠকে সভাপতিত্ব করবেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ।