
রংপুরের হারাগাছ সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেছেন ফাতেমা আক্তার লিজা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে প্রথম বর্ষ আন্ডারগ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রামের ভর্তি পরীক্ষায় তিন ইউনিটে (এ, বি ও সি) ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন তিনি। তবে ‘সি’ ইউনিটের (ব্যবসায় শিক্ষা) ভর্তি পরীক্ষায় তিনি দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন। এ ছাড়াও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘এ’ ইউনিটে ২১৩তম, ‘বি’ ইউনিটে ৯১তম এবং গুচ্ছ ভর্তির পরীক্ষায় ‘বি’ ইউনিটে তিনি রয়েছেন দশম স্থানে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার তীব্র জেদ ও ভর্তি পরীক্ষাকালীন সময়ের জার্নির গল্প নিয়ে মুখোমুখি হয়েছেন দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসের। তার কথাগুলো শুনেছেন—আমান উল্যাহ আলভী।
ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতিতে আপনার অনুপ্রেরণা কী ছিল?
সত্যি বলতে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতিতে অনুপ্রেরণা ছিল এক ধরনের তীব্র জেদ। আমাদের দেশে অধিকাংশ মানুষের মাঝে মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থীদের প্রতি একটা বাজে মনোভাব কাজ করে। তাদের মতে, দুর্বল শিক্ষার্থীরাই মানবিকে পড়াশোনা করে। তারা এটাও মনে করে যে দেশসেরা স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান ব্যতীত ঢাবিয়ান হওয়া সম্ভব নয়। যখন কাউকে বলতাম ঢাবির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি, তখন অনেকে সরাসরিই বলত, এখানকার পড়াশোনা দিয়ে ঢাবি অনেক কঠিন হবে। এমনকি আমার সামনে আমাদের ঘনিষ্ঠ একজন আত্মীয় আমার বাবাকেও একই কথা বলেছিলেন। তাতেই একটা তীব্র জেদ জেগেছিল। নিজের মনকে বলেছিলাম, `হবে কি না জানি না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাব।'
প্রস্তুতিকালীন কীভাবে পড়ালেখা করতেন?
নিয়মিত পড়াশোনা করতাম এবং চেষ্টা করতাম প্রতিদিনের পড়া প্রতিদিনই শেষ করতে। পড়া জমিয়ে না রাখার চেষ্টা করতাম এবং রাত জেগে পড়তাম না। ফজরের নামাজ পড়ে পড়াশোনা শুরু করতাম। তারপর কোচিংয়ে যেতাম। কোচিংয়ের পড়া, নোট তৈরি করা প্রত্যেক দিনের কাজ ছিল। ডেইলি, উইকলি, মান্থলি সব এক্সামকেই গুরুত্ব দিয়ে প্রস্তুতি নিতাম। নিয়মিত রিভিশন দিতাম এবং মুখস্থ অংশ পড়তাম। পুরো জার্নিতেই এ ধারাবাহিকতা মেনে চলেছি।
প্রস্তুতিকালীন অনেকের মধ্যে হতাশা কাজ করে পড়া নিয়ে, এই সময়গুলোতে কিভাবে নিজেকে সামলে নিতেন?
এ বিষয়টা আমার মনে হয় প্রত্যেক ভর্তি পরীক্ষার্থীকেই মোকাবিলা করতে হয়। সবার মতো আমিও বারবার হতাশ হয়ে যেতাম এটা ভেবে, আমি পারব তো? হবে তো আমাকে দিয়ে? কিন্তু যখনই হতাশ হয়ে যেতাম তখনই নিজের মনকে বলতাম, আমি হেরে গেলে তো আমার সঙ্গে আমার মা-বাবা পরিবারসহ আমার শুভাকাঙ্ক্ষীরাও হেরে যাবে। আর জিতে যাবে তারাই যারা আমাকে আর আমার বাবাকে বলেছিল, ‘ঢাব‘ হবে না। তখন নিজেকে বলতাম আমাকে পারতেই হবে। আমার জন্য এতগুলো মানুষকে হারতে হবে, এটাতো হতে দেওয়া যাবে না। আবার ফিরে যেতাম পড়ার টেবিলে।
পরীক্ষার হলে কিভাবে কৌশল অবলম্বন করে পরীক্ষা দিয়েছেন?
পরীক্ষার হলে আমি প্রথমত সময় নিয়ে খুব সচেতন ছিলাম। কোন প্রশ্নে কতটুকু সময় দেব তা ঠিক করে সে অনুযায়ী পরীক্ষা দিয়েছিলাম। নেগেটিভ মার্কস থাকার কারণে খুব সতর্কতার সঙ্গে এমসিকিউ দাগিয়েছিলাম। আর লিখিত পরীক্ষার ক্ষেত্রে কোচিংয়ের শিক্ষকদের পরামর্শে পরিমাণ নয় বরং মানের দিকে মনোযোগী ছিলাম।
আরো পড়ুন: স্বতন্ত্র পরিচয় গড়ার সংকল্প থেকে আইইউটিতে প্রথম তাসনিম
কোন বিষয়ে পড়ার ইচ্ছা এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
ম্যানেজমেন্ট বিষয় নিয়েছি এবং ভবিষ্যতে বিসিএস ক্যাডার হওয়ার ইচ্ছা আছে।
ঢাবিতে সুযোগ না হলে পরিকল্পনা কী ছিল?
ঢাবিতে সুযোগ না হলে, অন্য যে কোনো পাবলিক ভার্সিটির একটা সিট দখল করার জন্য লড়াই করার মতো দৃঢ় সংকল্প ছিল।
পরবর্তীতে যারা পরীক্ষা দেবে তাদের জন্য আপনার পরামর্শ কী হবে?
পরবর্তীতে যারা ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করবেন, তাদের উদ্দেশ্যে এটা বলতে চাই প্রথমেই নিজের লক্ষ্য সম্পর্কে সচেতন হোন। তারপর, দৃঢ় সংকল্প নিয়ে পড়াশোনা করুন। সময় এমনিতেই অনেক কম থাকে—৪ থেকে ৫ মাস। তাই পড়া জমিয়ে রাখার অভ্যাস তৈরি করবেন না। অধ্যবসায়ী হতে হবে। মেধাবীরাও হেরে যেতে পারেন কিন্তু পরিশ্রমীরা কখনও হেরে যান না। এটা সবসময় মাথায় রেখে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। তবেই স্বপ্ন জয় করা অসম্ভব কিছুই না।
বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়ার পর প্রথম ঈদ উৎযাপনের অনুভূতি কেমন ছিল?
চান্স পাওয়ার পর মনে হচ্ছিল যেন, ঈদের আনন্দ দ্বিগুণ হয়েছে। মা-বাবাসহ পুরো পরিবার দ্বিগুণ আনন্দে ছিল এবং এই আনন্দের অন্যতম একটা কারণ ছিলাম আমি। এর থেকে বড় প্রাপ্তি আর কী-বা হতে পারে। যারা বলত, ‘ঢাবিতে হবে না, সম্ভব না’। এখন দেখি তাদের চোখে-মুখে ফুটে ওঠে একটা বিস্ময়ের আভা। আর এখন আমার পরিবার গর্ব করে বলতে পারে, হারাগাছ কলেজ থেকেও ঢাবিতে চান্স পাওয়া সম্ভব। শুধু চান্সই নয় বরং শীর্ষস্থানও দখল করা সম্ভব। এসব দেখার বা শোনার পর মনের মধ্যে যে অদ্ভুত এক অনুভূতির জন্ম নেয় তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।