
ভোররাতে মানুষ যখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, আচমকা এক মহাশক্তিশালী ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয় তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর গাজিয়ানটেপের কাছে। রিখটার স্কেলে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে প্রতিবেশী সিরিয়া, লেবানন, ইসরাইল, ফিলিস্তিন এবং সাইপ্রাসও। বেশ কিছু আফটারশকের পর এদিন দুপুরের দিকে ৭ দশমিক ৫ মাত্রার আরও একটি ভূমিকম্প আঘাত হানে। এর উৎপত্তিস্থল ছিল দক্ষিণ-পূর্ব তুরস্কের কাহরামানমারাস প্রদেশের এলবিস্তান জেলা।
মঙ্গলবার বাংলাদেশ সময় সকাল সাড়ে ৮টার দিকে এই খবর লেখা পর্যন্ত ভূমিকম্পে তুরস্ক ও সিরিয়ায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৩ হাজার ৮০০ ছাড়িয়ে গেছে। যারা বেঁচে গেছে, ভয়াবহ এই ভূমিকম্প আবার তাদের সামনে এনেছে প্রকৃতির খেয়ালের কাছে মানুষের অসহায়ত্বের চিরন্তন বাস্তবতাকে। ধ্বংসস্তুপের নিচ থেকে চাপা পড়া মানুষের আর্তনাদ ভেসে আসছে।
মৃতের সংখ্যা আরও বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। দুই দেশই জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে। ভূমিকম্প দুর্গত এলাকায় ভারী বৃষ্টি ও তুষারপাতের শঙ্কা রয়েছে, এতে উদ্ধার তৎপরতা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। উল্লেখ্য, যেখান থেকে ভূমিকম্পটির উৎপত্তি, তুরস্কের সেই দক্ষিণাঞ্চলের কাছেই আনাতোলিয়ান ফল্ট। বিশেষজ্ঞরা আগেই সতর্ক করেছিলেন, এই ফল্ট খুবই বিপজ্জনক।
দুই দেশের ক্ষয়ক্ষতি ও হতাহত : এই খবর লেখা পর্যন্ত ভূমিকম্পে তুরস্কে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ২ হাজার ৪১৪ জনে দাঁড়িয়েছে। আহত ৫ হাজার ৩০০ ছাড়িয়েছে বলে জানিয়েছে দেশটির রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম। এতে ২ হাজার ৮১৮টি ভবন ধসে পড়েছে। প্রতিবেশী সিরিয়ায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে ১ হাজার ৩৯৩ হয়েছে এবং দুই হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে দেশটির কর্তৃপক্ষ। হতাহতদের অধিকাংশই আলেপ্পো, লাতাকিয়া, হামা ও তারতুস প্রদেশের বাসিন্দা বলে দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের জিওলজিক্যাল সার্ভে (ইউএসজিএস) জানিয়েছে, স্থানীয় সময় ভোররাত ৪টা ১৭ মিনিটে শুরু হওয়া ভূমিকম্পটির উৎপত্তি গাজিয়ানটেপ শহরের কাছে ভ‚পৃষ্ঠের ১৭ দশমিক ৯ কিলোমিটার (১১ মাইল) গভীরে। তারপর থেকে পরবর্তী ঘণ্টাগুলোতে অনেক পরাঘাত অনুভূত হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালীটি ৬ দশমিক ৬ মাত্রার ছিল বলে তুরস্কের কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।
সিরিয়ার পশ্চিমাঞ্চলীয় উপকূলীয় শহর লাতাকিয়া থেকে শুরু করে ভূমিকম্পটি দক্ষিণে রাজধানী দামেস্ক পর্যন্ত অনুভূত হয়েছে। তুরস্ক জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে উদ্ধারকারীদের পরস্পরের মধ্যে সমন্বয়ে সহায়তা করতে জনসাধারণকে মোবাইল ফোন ব্যবহার না করার আহ্বান জানিয়েছে।
ভূমিকম্পের কারণে স্থানীয় বাসিন্দারা প্রচণ্ড শীতের মধ্যে তুষারে ঢাকা রাস্তায় নেমে আসতে বাধ্য হয়। প্রবল ঝাঁকুনিতে বহু ভবন ধসে পড়েছে, সেসব ধ্বংসস্ত‚পে এখনও বহু মানুষ আটকা পড়ে আছেন। তুরস্কের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুলেইমান সোইলু জানিয়েছেন, ভূমিকম্পে গাজিয়ানটেপ, কাহরামানমারাস, হতাই, ওসমানিয়ে, আদিয়ামান, মালাটিয়া, সানলিউরফা, আদানা, দিয়ারবাকির ও কিলিস- এই ১০টি শহর বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ধ্বংসস্তুপে চাপা পড়াদের আর্তনাদ : সিরিয়া ও তুরস্কের ধ্বংসস্ত‚পের নিচ থেকে চাপা পড়া মানুষের আর্তনাদ ভেসে আসছে। তুরস্কের উদ্ধারকারীরা বলেছেন, তারা উদ্ধার তৎপরতা চালাতে গিয়ে চাপা পড়া মানুষদের কান্না শুনছেন।
এদিকে সংবাদমাধ্যমে আসা ছবিতে দেখা গেছে, কাহরামানমারাস শহরে ধসে পড়া ভবনগুলোর চারপাশে লোকজন জড়ো হয়ে জীবিতদের খোঁজ করছে। তুরস্কের দক্ষিণপূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ সানলিউরফার গভর্নর সালিহ আয়হান টুইটারে বলেছেন, ‘আমাদের অনেক ভবন ধ্বংস হয়েছে।’
তিনি স্থানীয় বাসিন্দাদের নিরাপদ স্থানে চলে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। সিরিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত গণমাধ্যম আলেপ্পো প্রদেশে বহু ভবন ধসে পড়েছে বলে জানিয়েছে। দেশটির হামা প্রদেশের বেসামরিক পরিষেবা কর্মকর্তারা রয়টার্সকে জানিয়েছে, সেখানেও বেশ কিছু ভবন ধসে পড়েছে।
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরার প্রতিনিধি সুহাইব আল-খালাফ সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল থেকে বলেন, ‘মরদেহ বের করে আনার পর আমরা ধ্বংসস্ত‚পের নিচে মানুষের আর্তনাদ দেখছি; তারা (উদ্ধারকারীরা) একটি শিশু পেয়েছে; সে জীবিত বলে মনে হচ্ছে। পরে তাকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।’
সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক, লেবাননের রাজধানী বৈরুত এবং বন্দর শহর ত্রিপোলিতে ভূমিকম্পের কারণে লোকজন দৌড়ে রাস্তায় বের হয়ে যায়, তাদের ভবনগুলো ধসে পড়তে পারে আশঙ্কায় কেউ কেউ নিজেদের গাড়ি সেখান থেকে সরিয়ে নেয় বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন।
দামেস্কের বাসিন্দা সামের বলেন, ‘দেয়ালে ঝুলানো পেইন্টিংগুলো পড়ে যায়। আমি আতঙ্কিত হয়ে জেগে উঠি। এখন আমরা সবাই দরজায় নিচে দাঁড়িয়ে আছি।’ উভয় দেশে শত শত ভবনের ধ্বংসস্ত‚পের নিচে চাপা পড়া জীবিতদের রক্ষা করতে উদ্ধারকারীরা কাজ শুরু করেছেন।
পূর্ব আনাতোলিয়ান ফল্ট নিয়ে ছিল আগাম সতর্কতা : ভূমিকম্প হওয়ার জন্য ফল্ট লাইন বড় ভূমিকা রাখে। ভ‚মিকম্পবিদরা তুরস্কের ওই পূর্ব আনাতোলিয়ান ফল্টকে অনেক আগেই খুব বিপজ্জনক বলে শনাক্ত করেছিলেন। তুরস্কের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তের দক্ষিণ-পশ্চিম থেকে উত্তর-পশ্চিম বরাবর এই ফল্টের অবস্থান। যদিও গত ১০০ বছরের বেশি সময় ধরে সেখানে উল্লেখ করার মতো কোনো সক্রিয়তা চোখে পড়েনি। তবে তুরস্কের ইতিহাসে ভয়াবহ কয়েকটি ভ‚মিকম্পের জন্য দায়ী এই পূর্ব আনাতোলিয়ান ফল্ট। বিশেষ করে ১৮৮২ সালের ১৩ আগস্টের ভ‚মিকম্পের কথা উল্লেখ করা যায়। রিখটার স্কেলে সেই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৭ দশমিক ৪; যা আজকের ভ‚কম্পনের চেয়ে সামান্য কম। ওই ভ‚মিকম্পে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল।
দুর্গত এলাকায় ভারী বৃষ্টি ও তুষারপাতের শঙ্কা : তুরস্কের ভূমিকম্প দুর্গত এলাকায় আগামী কয়েক দিনে ভারী বৃষ্টি ও তুষারপাতের পূর্বাভাস দিয়েছে বিবিসি। সেখানে দিনের বেলা তাপমাত্রা ৩-৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকবে এবং রাতের বেলা তা আরও কমে যেতে পারে বলেও জানানো হয়েছে। এমনকি ওই এলাকায় ৩-৫ সেন্টিমিটার গভীর তুষারে ঢেকে যেতে পারে। তুরস্কের উত্তরের পাহাড়ি এলাকায় আরও বেশি তুষারপাতের আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। পাহাড়ে ৫০ থেকে ১০০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত তুষারপাত হতে পারে।
মরিয়া উদ্ধার তৎপরতা, প্রতি ১০ মিনিটে উদ্ধার একটি করে প্রাণহীন দেহ : কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরার প্রতিনিধি সুহাইব আল-খালাফ সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল থেকে বলেছেন, উদ্ধারকারীরা মরিয়া হয়ে ধ্বংসস্তুপ থেকে লোকজনকে বের করার চেষ্টা করছেন।
সুহাইব বলেন, ‘উদ্ধারকারীরা প্রত্যেক ১০ মিনিটে একটি করে মরদেহ বের করে আনছেন।’ সিরিয়াজুড়ে অসংখ্য ভবন ধসে পড়েছে। তিনি বলেন, এসব ভবনের ধ্বংসস্ত‚পের নিচে শত শত মানুষ আটকা পড়েছেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
আলজাজিরার এই প্রতিনিধি বলেন, সিরিয়ার দীর্ঘদিনের যুদ্ধের কারণে স্থানীয় চিকিৎসাসেবা খাত আগে থেকেই বিপর্যস্ত। ভ‚মিকম্পের কারণে হাজার হাজার মানুষ আহত হওয়ায় এখন সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছে স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলো।
তিনি বলেন, লোকজনকে হাসপাতাল, এমনকি হাসপাতালের বারান্দায়ও চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। রক্তের প্রচুর সংকট দেখা দিয়েছে।
আফটারশক চলতে পারে কয়েক দিন : প্রবল শক্তিশালী কোনো ভূমিকম্পের পরে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় আফটারশক চলতে পারে কয়েক দিন, কয়েক সপ্তাহ, এমনকি কয়েক মাস ধরেও। অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন ইউনিভার্সিটির স্কুল অব আর্থ অ্যান্ড প্ল্যানেটারি সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক ক্রিস এল্ডারস আলজাজিরাকে এ কথা জানিয়েছেন। অস্ট্রেলীয় এ বিশেষজ্ঞ মনে করেন, তুরস্ক-সিরিয়ায় প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্পের পরে ৪-৫ মাত্রার বেশ কয়েকটি আফটারশকের আঘাত রেকর্ড করা হয়েছে। ৭ দশমিক ৮ মাত্রার প্রথম ভূমিকম্পের তুলনায় এগুলোর তীব্রতা কম হলেও তা যথেষ্ট ‘উদ্বেগজনক’।